বিশ্ব বই দিবস ও আমাদের বই পড়া
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২৭
বই পড়া শব্দদ্বয় দ্বারা প্রকৃতপক্ষে কয়েকটি বিষয় বোঝানো হয়। সেগুলো হলো আমাদের পাঠ্যবই যা ছাত্রাবস্থায় পড়ি, অন্যটি হলো চাকরির বই পড়া এবং সর্বশেষ বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ বা এ জাতীয় বই পড়া যেখানে আসলে বিনোদন নেওয়া ছাড়া বা মানসিক পরিতৃপ্তির বিষয় ছাড়া কোনো উদ্দেশ্য নেই। এবং এটাই হলো প্রকৃত বই পড়া। বই পড়া বলতে এই লাভহীনভাবে বইয়ের সাথে সময় কাটানোকে বোঝায়। যেমনটা আজকাল আমরা মোবাইল গেমস বা আড্ডায় সময় ব্যয় করছি, সেরকম। অতীতে অনেককে দেখেছি নিজেদের শখ হিসেবে বই পড়াকে বেছে নিতেন। আজ বই পড়াকে শখ হিসেবে নেন এমন পাঠক খুব একটা পাওয়া যায় না। হয়তো আগ্রহ কমেছে অথবা বইয়ের বিকল্প এসেছে সেজন্যও হতে পারে। মানুষ কেন বই পড়ে? আসলে এর নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। মূলত বই পড়ার উদ্দেশ্য আত্মার খোরাক মেটানো। এখন বিতর্ক হলো বই পড়ার প্রবণতা কি কমে যাচ্ছে? এসব বিতর্কের মধ্যেই প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস পালিত হয়। এই দিবস অন্য দিবসগুলোর মতো ঘটা করে পালিত হতে দেখিনি। হয়তো বই পড়ার মতো একটা বিষয় ঘটা করে পালন করা যায় না- এমন অজুহাতেই অনেকটা নিরবেই দিবসটি চলে যায়। অথচ অন্যসব দিবসে মোবাইলে শুভেচ্ছার ভিড় লাগে। এই দিনে খুব একটা তোড়জোড় চোখে পরে না। আমার ধারণা অনেকেই জানেন না যে এই নামে একটি দিবস আছে। হতেই পারে। আমাদের যে সব জানতেই হবে এমন কথা নেই। ২৩ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো প্রথমবারের মত বিশ্ব বই দিবস উদযাপন করে। এরপর থেকে দিবসটি সারাবিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। ”বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না”- বই পড়া নিয়ে প্রমথ চৌধুরির এই উক্তিটি বইয়ের চিরন্তন গ্রহণযোগ্যতাকে প্রকাশ করে। তবে আজকাল বইয়ের খরচও বেড়ে গেছে এ সত্য কথা অস্বীকার করারও উপায় নেই। লেখক, প্রকাশক এবং বইয়ের ক্রেতা মাত্রই তা স্বীকার করবেন। কোন আদিকালে মানুষ বইয়ের প্রেমে পড়েছিল? বুঝেছিল নিঃস্বার্থভাবে যদি কোনো কিছু ভালোবাসা যায় তা এই বই। মানুষের প্রকৃত বন্ধু হয়ে সেই তখন থেকে বই সাথে রয়েছে। মানুষও সার্বক্ষণিকভাবে বই সাথে রেখেছে। বাসে, ট্রেনে বই পড়তে পড়তে ভ্রমণ করা মানুষের দেখা পাওয়া যায়। যদিও আজ সে দৃশ্য প্রায় অপ্রতুল। বই মানুষ কেন কেনে? বই পড়া এবং কেনার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যারা বই পড়ে তারা যেমন বই কিনে পড়ে তেমনি বই ধার করেও পড়ে। যেখানে যত বই পায় সব পড়ে।
বই পড়াটা তাদের কাছে নেশার মতো হয়ে যায়। আর যারা বই কেনে তারা নিজে পড়ার জন্যও কিনতে পারে আবার উপহার দেয়ার জন্যও কিনতে পারে। অনেকে আবার কেবল দেখানোর জন্যও কিনে থাকে। তবে যাই হোক বই পড়ার মধ্যেই সেই বইয়ের স্বার্থকতা। বই মানুষের মনের খোরাক যোগায়। তবে পেটের খোরাক যোগায় না জন্য আজকাল যেনো বই পড়–য়ার সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে। অবশ্য মনের খোরাকের চেয়ে পেটের তাগিদই বেশি! এ প্রসঙ্গে স্পিনোজা’র একটি উক্তি বলা যায়। তিনি বলেছেন, ভালো খাদ্য বস্তু পেট ভরে কিন্তু ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। নতুন বই বইমেলা কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। নতুন লেখক বইমেলা কেন্দ্রীক। এমনকি বই কেনাটাও সেই বইমেলা কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। সারাবছর কোন তেমন নতুন বইয়ের দেখা পাওয়া যাবে না। কিন্তু বইমেলা এলেই বই প্রকাশের হিড়িক লেগে যায়। তা হোক। মেলাতে এমনটাই হবে। তবে বই নিয়ে এমন আগ্রহ যদি সারা বছর থাকতো তাহলে বেশ ভালো হতো। কিন্তু সারাবছর নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে খুব কম। পাঠকও অপেক্ষা করে থাকে কখন বইমেলা আসবে, তার লেখকের বই বের হবে সেই সময়ের জন্য। প্রতি বছর বইমেলায় নতুন লেখক, প্রকাশক এবং নতুন বই আসছে। আবার বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। তবে বইয়ের পাঠক কমছে এটা প্রায় সবাই মনে করেন।
বই পড়ার শখ অন্য সব শখ থেকে ভালো। একটা সময় ছিল যখন বই পড়ার প্রতি ছেলেমেয়েদের মধ্যে তীব্র আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। বই হাতে পেলেই তা পড়ে দেখার এক ধরনের কৌতুহল ছিল লক্ষণীয়। তবে আমি এটা বলছি না যে সবার মধ্যেই এ প্রবণতা ছিল কিন্তু তা এখনকার চেয়ে অনেকটাই বেশী ছিল বলে ধারণা। কিন্তু আমার মনে হয় দিন যাওয়ার সাথে সাথে আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে বই পড়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ফলে জ্ঞান হয়ে পড়ছে সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে মুক্ত আকাশের সন্ধান মেলে না। মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে মুক্ত জ্ঞানের চর্চা থাকা আবশ্যক।
প্রযুক্তির কারণেই হোক আর যা-ই হোক বই পড়ার অভ্যাসটা কমেছে। আমাদের সেই দিন ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রথমেই যে বলেছি আজ বাসে, ট্রেনে বই পড়তে পড়তে ভ্রমণ করতে করতে যাওয়া মানুষের দেখা পাওয়া যায় না। তার কারণ এখন সবার চোখ থাকে মোবাইলের স্ক্রীণে। একসময় বাইরে কয়েকদিনের জন্য ভ্রমণে গেলে সাথে থাকতো আবশ্যকীয় বই। এখন আর তালিকায় বই থাকে না। একসময় জন্মদিনসহ নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেয়া হতো বই। আজ তার জায়গা দখল করেছে অন্য উপহার। বই উপহার দেয়ার মতো ঘটনা খুব কমই ঘটে। বই পড়া বিষয়টি তখনই স্বাভাবিক মনে হবে যখন ভেতর থেকে এক ধরনের তৃষ্ণা জাগ্রত হবে। তিনবেলা খাওয়ার জন্য আমাদের যে হাহাকার, একবেলা হঠাৎ না খেলে যে ক্ষুধাবোধ তেমনি একবেলা বই না পরলে যদি সেরকম কোন বোধ হয় তখন বইপড়াটা মজ্জাগত হবে। অর্থাৎ অতিরিক্ত কোন কাজ হিসেবে নয় বরং আর দশটা স্বাভাবিক কাজের মতই বই পড়া একটি স্বাভাবিক কাজ হবে। খেলাধূলা বা বিনোদন লাভের উপায় যেমন আমাদের আনন্দের উৎস তেমনভাবে বই যদি আমাদের আনন্দ উপকরণ হতে পারে তখন তা হবে মনের ক্ষুধা মেটানোর অন্যতম অনুষঙ্গ। তাছাড়া আমরা যত চেষ্টাই করি না কেন লাভ কিছু হবে না। পরিশেষে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই নিয়ে একটি কথা বলছি। তিনি বলেছেন, বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়। আমাদের জীবনের সাথে, আত্মার সাথে বই ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। তাহলে বিষয়টি দাড়ায় যে বইয়ের সাথে আতœার সম্পর্ক আর আত্মার সাথে আমাদের পরিতৃপ্তির সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। যারা বই পড়েন তারা মূলত এখান থেকে আনন্দ পান। আনন্দ লাভের সাথে জ্ঞান লাভ হয়। নিজেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। একটি সুশিক্ষিত ও বই পড়ুয়া জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই