ভোটারদের কাছেই থাকতে চান মনোনয়ন প্রত্যাহার না করা প্রার্থীরা
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৫৯
বিভিন্ন গণমাধ্যমের হিসাবে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অন্তত ৬৭ জন পদধারী নেতা মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। এখন পদে নেই, কিন্তু এলাকার ভোটে ও মাঠে ভালো অবস্থা আছে এমন বহু নেতা নির্বাচন করছেন। তাদের কথা এখনও হিসাবে আসেনি। নিশ্চয়ই কোনো উদ্যোগী গণমাধ্যম শিগগির ঠিকঠাক হিসাবটা প্রকাশ করবে। কিন্তু প্রথম দফা মনোনয়ন প্রত্যাহারের পর দেখা গেল, যারা মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই প্রত্যাহার করেননি। আমি পদ-পদবীধারী নেতাদের কথাই বলছি।
যাদের পদ নেই তারা তো এখন ফ্রি-স্টাইলে ব্যস্ত ভোটের মাঠে। এরই মধ্যে দলের কেন্দ্রও জানিয়ে দিয়েছে, যারা দলীয় পদে নেই তারা নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির কিছু করার নেই। এরইমধ্যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়েছেন, পটুয়াখালী সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনির রহমান এবং কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর তাজ। বহিষ্কারের আদেশে বলা হয়েছে, এই দুই নেতাকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হলো। নিশ্চয়ই দু’এক দিনের মধ্যে আরও কিছু নেতার বহিষ্কারের তথ্য আমরা পাব।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কতজনকে বহিষ্কার করবে বিএনপি? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে না তো? সামনে আরও তিন দফা উপজেলা নির্বাচন আছে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় দফায় উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেওয়া শুরু হয়েছে। সেখানেও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বহু প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছে। এর পর আসবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। সেখানেও নিশ্চয়ই আগ্রহী বিএনপি নেতা-কর্মীরা বসে থাকবেন না। কেন্দ্রীয় নেতারা পারবেন তো বহিষ্কার করতে সবাইকে? আসলে পারবেন না। বাস্তবতা হচ্ছে, পারা যায় না। শুধু হুঙ্কার দেওয়া হবে।
সম্প্রতি বিএনপির কেন্দ্রীয় সংসদের এক অনলাইন বৈঠকের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, দীর্ঘদিন প্রবাসী তারেক রহমান। সেখানে প্রস্তাব এসেছিল, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচন করবে তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হোক। নেতাদের বেশিরভাগই সেই প্রস্তাবে সাড়া দেননি। এই মুহূর্তে দলের কাণ্ডারি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর-ড. মঈন খানদের কাছের নেতা হিসেবে পরিচিত স্থানীয় পর্যায়ের এমন নেতারাও উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়ন বহাল রেখেছেন বলে গণমাধ্যম তথ্য প্রকাশ করছে।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আসলে জোয়ারের মতো। ঢাকায় বসে এর গুরুত্ব বোঝা যায় না। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ নেতা যতটা না একটি রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠার জন্যে রাজনীতি করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি স্থানীয় সমস্যা সমাধানের জন্যে মাঠে থাকেন। যারা দেখেননি তারা এই বিষয়টি বুঝবেন না। এলাকায় যিনি গণমানুষের কাজ করেন, প্রতিদিন সকাল থেকে তার কাছে নানা ধরণের মানুষ আসতে থাকেন। কেউ তার মতাদর্শের অনুসারী, আবার কেউ নন। কিন্তু নেতাকে তাদের সবার কথা শুনতে হয়। একটা সমাধান দিতে হয় অথবা সমাধানের পথ বলতে হয়।
সত্যিকার অর্থে স্থানীয় লোকগুলোর কাছে এসব নেতাদের একটা বিশাল কমিটমেন্ট থাকে। প্রত্যেক নেতার কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী থাকে। আর দল যদি বিরোধী দলে থাকে তাহলে সেই কমিটমেন্টের চাপ হয় আরও বড়। তাই তিনি যদি মাঠে না থাকেন, কোনো কথা বলতে না পারেন, তাহলে তিনি অস্তিত্ব সংকটে পড়েন। তাই নিজের এবং দলের অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্যে যিনি যে পর্যায়ে আছেন সেই পর্যায়ে নির্বাচন করতে চান। এলাকার মানুষের এই টিকে থাকার সংগ্রামের রাজনীতি লন্ডনে বসে বোঝা যাবে না।
ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের এলাকার একজন মানুষকে চিনি। যিনি ব্যক্তিগত জীবনাচরণে, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থেকে কাজ করে গণমানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে বিএনপিপন্থি রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু যখন স্থানীয় একটি নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসলো, তখন তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলেন। তার দল বাধা দিল। কিন্তু তিনি মানুষের কমিটমেন্ট ছাড়লেন না। নির্বাচনে অংশ নিলেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী হলেন। এখন তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। কিন্তু স্থানীয় সরকারে বার বার নির্বাচিত হচ্ছেন এবং কাজ করছেন।
এবারও দলের পদপদবীধারীরা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বহিষ্কার হচ্ছেন। কিন্তু পদ না থাকলে হচ্ছেন না। এই বিষয়টি আজ তাদের নেতারা প্রকাশ করছেন। কিন্তু বহু স্থানীয় মেধাবী নেতা বুঝতে পেরেছিলেন আরও আগেই। তাদের অনেকেই প্রার্থী হবেন বলেই দলের পদে যাননি। আমি এরকম অন্তত তিনজনকে চিনি। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘মানুষের কাজ না করতে পারলে রাজনীতি করে লাভ কী? সরকারবিরোধী রাজনীতি করার কারণে কথা বলার যায়গা কম। আমাদের দেশের রাজনীতি ক্ষমতাকেন্দ্রীক। হাতে ক্ষমতা না থাকলে কিচ্ছু হয় না, আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে কাজ থাকবে। কাজ থাকলে ভোট থাকবে। আর ভোট থাকলে দল ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করবে।’
পদবিহীন ওই দুই বিএনপি নেতার বক্তব্যের প্রথম অংশের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে একমত ছিলাম না। বিন্তু ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতির যে সমীকরণ তারা দিলেন তাতে কিছুটা একমত না হয়েও এখন উপায় নেই। কারণ আমাদের ভোটের রাজনীতির যে কঠোর বাস্তবতা তা মানতে হবে। ভোট আসলেই লাগবে। ভোটের রাজনৈতিক বাস্তবতা মূল্যায়ন না করার যে নেতিবাচক প্রভাব, তা কত ভয়াবহ হতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ দেখতে হলে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের দিকে তাকাতে হবে। তাদের জয় পরাজয়ের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। তাই আজকের বাস্তবতা ভোটারের কাছে যাওয়ার। ভোটারের পাশে থাকার। ভোটারকে হ্যাঁ বলার।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সংসদে নির্বাচনে থেকে যাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার প্রসঙ্গে বলছিলাম। প্রায় একই ধরনের কারণে সম্প্রতি বিএনপি কঠোর হয়েছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনের ওপর। কারণ তিনি নির্বাচিত হওয়ার পরেও তাকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে না করেছিল দল। তারপরও তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করায় তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আমার মনে হয় তার কাছে তার ভোটারের কমিটমেন্ট অনেক বড়। সেই কমিটমেন্টকে তিনি অসম্মান করতে চাননি। কারণ আবারও ভোটারদের কাছেই তাকে যেতে হবে। তাই সেই পথটি তিনি বন্ধ করতে চাননি। যেমনটা চান না আজকের উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাহার না করা প্রার্থীরা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/আইই