আইন সম্পর্কে অজ্ঞতাই কি আইন লঙ্ঘনের অন্যতম কারণ?
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৪৫
আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা আইন লঙ্ঘনের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা বিস্তার করে যে আইন সম্পর্কে শুধু আইনজীবী বা আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরা জানবে কিন্তু একজন মানুষের জন্য আইন জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণও রয়েছে বেশ। যেমন আইন জানলে প্রথমত আইন লঙ্ঘন রোধ করা যায়। দ্বিতীয়ত আইন অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান করে, সৎ এবং ন্যায়মূলক সামাজিক আচরণ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও আইনি সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে, নিজের অধিকার রক্ষা সহ নানান সুযোগ সুবিধা রয়েছে আইন সম্পর্কে জানার।
একটা জরিপে দেখা যায়, দেশের ৬০ শতাংশ সাধারণ মানুষ আইন লঙ্ঘন করছে শুধুমাত্র আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে। তেমন কয়েকটি ঘটনা ও ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে তুলে ধরলাম।
১. আমরা প্রায়ই দোকান, সুপারশপ ও ফার্মেসীতে শিশুদের মাতৃদুগ্ধ বিকল্প বিভিন্ন কোম্পানির শিশুখাদ্য সাজানো দেখতে পাই। যেটি সাজিয়ে রেখে ক্রেতাদের ক্রয় করতে আকৃষ্ট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশু খাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও উহা ব্যবহারের সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ তে বলা হয়েছে বিকল্প শিশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত যেকোনো ধরনের কৌটাজাত বা প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধ, কৃত্রিম শিশুখাদ্য ব্যবহারের সরঞ্জামাদির জন্য বিজ্ঞাপন তৈরি, প্রদর্শনী, বিতরণ, প্রচার বা প্রকাশ করলে শাস্তি হবে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। কিন্তু এই আইন যে প্রচলিত আছে সেটি বিক্রেতা জানে না যার ফলস্বরূপ দোকানে সাজানো মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য গুলো দেখতে পাওয়া যায়। এই আইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বিক্রেতারা বলে এই আইন সম্পর্কে আগে কখনো শুনি নাই।
২. বর্তমান সময়ে কিছু উঠতি বয়সী তরুন বাইকের সাইলেন্সার কেটে বিকট শব্দ যুক্ত সাইলেন্সার লাগিয়ে রাস্তাঘাটে ওই সাইলেন্সার যুক্ত বাইক দ্বারা শব্দদূষণ করে থাকে। কিন্তু ওই কিশোর পরিবেশ দূষণ হচ্ছে যে ওই ব্যাপারে অবগত নয় এবং এটি রোধের ব্যাপারে যে একটি আইন রয়েছে এটি ওই কিশোর জানে না যার কারণে আইনটি লঙ্ঘন করে পরিবেশ দূষণ করছে।
আইনে বলা হয়েছে, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী সকল প্রকার মোটরসাইকেল শব্দের অনুমোদিত মানমাত্রা ৮৫ ডেসিবেল৷ ওই আইনে উল্লেখ করা হয়েছে আইন ভঙ্গ করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা শব্দের উৎস যন্ত্রপাতি জব্দ করতে পারবেন। শব্দদূষণে দোষী হিসেবে প্রমাণিত হলে প্রথম অপরাধের জন্য একমাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড প্রদান করার বিধান রয়েছে।
৩. আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে প্লাস্টিক-পলিথিন সামগ্রী ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে কিন্তু এই প্লাস্টিক-পলিথিন মানবদেহ ও পরিবেশের কতটা ক্ষতিসাধন করে তা আমাদের কল্পনাবিহীন। তাই তো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন–১৯৯৫–এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসেই জেলসহ ১০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে পলিথিনের ব্যবহার করছে ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেই। এই প্রসঙ্গে যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে সে সম্পর্কে জানে না কেউ।
৪. রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত এই আইনের অনুমোদন দেয় সরকার। আইনে বলা হয়েছে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি ও বিতরণ করা যাবে না। কেউ এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও ওষুধের দোকানের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। তবে বিভিন্ন ফার্মাসিটিউক্যালস ঘুরে দেখা যায় রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই বিক্রি করছে অ্যন্টিবায়োটিক ঔষুধ। মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি রোধ করতে এই আইন তৈরি করা হয়েছে কিন্তু স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বাড়ছে তার পাশাপাশি লঙ্ঘিত হচ্ছে আইনটি।
এগুলো ছাড়াও আইন লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যার একমাত্র কারণ হচ্ছে আইন সম্পর্কে না জানা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিভাবে জানবে? আমাদের দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ের উপর অর্নাস ও মাস্টার্স করার সুযোগ রয়েছে। তবে সবার সে সুযোগ নাও থাকতে পারে।
২০১৯ সালে ১০ জুন জাতীয় সংসদ অধিবেশনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানায় ১৭৯৯ সাল থেকে ১০ জুন ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে বর্তমানে ১ হাজার ১৪৮টি আইন প্রচলিত রয়েছে। দেশের একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৯৭৩ সালের এপ্রিল থেকে চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ৫০ বছরে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ১ হাজার ৫২৮টি বিল বা আইন পাশ হয়েছে। আমাদের দেশে ১ হাজারের অধিক আইন রয়েছে যার সম্পর্কে জানা বা মনে রাখা একটা মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য বিষয় তবে একজন মানুষ তার অধিকার রক্ষায়, তার দ্বারা এমন কোন কাজ যার কারণে আইন লঙ্ঘন হবে সে কাজ থেকে বিরত থাকার স্বার্থে আইন জানা সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত।
আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জানতে হলে প্রথমে প্রয়োজন তার নিজের আগ্রহ। মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন আইন সম্পর্কে জানতে চায় কিন্তু বিপদে পড়ার আগে আইন সম্পর্কে জানা থাকলে ওই ব্যাক্তিকে ওই বিপদের সম্মুখীন নাও হতে হতো।
আমাদের দেশের আইনে প্রত্যেক নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্মান রক্ষার বিধান আছে যা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু সার্বজনীন এ বিষয়টি আমাদের সাধারণ শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত নেই। যার কারণে এ বিষয়গুলো কিছু আইনজীবী এবং কিছু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন ছাড়া অন্যরা খুব কমই জানেন। পরিণামে প্রায়ই হেনস্তা শিকার হতে হয়। আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানান দিতে হলে রাষ্ট্র সাধারণ শিক্ষা কারিকুলামে আইনের বিভিন্ন বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সরকার সাধারণ মানুষকে আইন সম্পর্কে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। কর্মশালার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ আইন সম্পর্কে সচেতন হবে এবং আইন লঙ্ঘন রোধে বিরত থাকবে।
আইন জানার আরেকটি উপায় হচ্ছে আইন প্রয়োগ। কোনো নতুন আইন তৈরি করা হলে সেটি যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সঠিকভাবে প্রয়োগ করে সেটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সহজে জানতে পারবে এবং পরবর্তীতে আইনটি যেন লঙ্ঘন না হয় সে ব্যাপারে সচেতন হতে পারবে।
বর্তমান সময়ে বই পড়ার চাইতে মানুষ মোবাইলে বই পড়া বেশি পছন্দ করে। গুগলে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও গুগল প্লে-স্টোরে আইন সম্পর্কিত বিভিন্ন আ্যপসে সকল ধরনের আইন সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে। আইন জানার ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম মাধ্যম হতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
আইন সম্পর্কে অজ্ঞতাই কি আইন লঙ্ঘনের অন্যতম কারণ? এমএ আরাফাত ভূঞা মুক্তমত