সাহসী ও আপসহীন লেখক হুমায়ুন আজাদ আমাদের প্রেরণা
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪৭
বাংলা সাহিত্যকে ঐশ্বর্য্যমণ্ডিত করার পেছনে যে ক’জন সাহিত্যজনের অবদান অনন্য—তাদেরই একজন হুমায়ুন আজাদ। বাংলা সাহিত্য অঙ্গণে অনন্য মননশীল, বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় সাহিত্যিক তিনি। গুণী এই সাহিত্যিককে বলা হয়ে থাকে প্রথা ভাঙ্গার রূপকার, বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রথাবিরোধী লেখক। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, রাজনীতি ভাষ্যকার ও কিশোর সাহিত্যিক।
১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল হুমায়ুন আজাদ মুন্সীগঞ্জের রাঢ়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাবা-মায়ের বড় সন্তান ছিলেন। ১২ আগস্ট বহুমাত্রিক মননশীল এই লেখকের প্রয়াণ দিবস। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট জার্মানিতে অবস্থানকালে আকস্মিকভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে হুমায়ুন আজাদ বাংলা সাহিত্যে যোগ করেন এক ভিন্নমাত্রা। তিনি ৭০টির বেশি বই লিখেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সৃষ্টি করেছেন নবতর ধারা।
ছাত্রজীবন থেকেই হুমায়ুন আজাদ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি ১৯৬২ সালে রাড়িখাল স্যার জে সি বোস ইন্সটিটিউশন থেকে পাকিস্তানের মধ্যে ১৮তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। উভয়ক্ষেত্রে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথমস্থান লাভ করেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় হুমায়ুন আজাদ প্রথম উপন্যাস লেখা শুরু করেন। শৈশবের পড়ার ঘরের সামনে ছিল একটি কদম গাছ। বর্ষায় ফুল ফুটে গাছটি রূপসী হয়ে ওঠতো। এটিকে নিয়েই তিনি প্রথম উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন। ছোটবেলায় শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ ও দত্তা উপন্যাস পড়ে আপ্লুত হয়েছিলেন তিনি।
হুমায়ুন আজাদের প্রথম প্রকাশিত বই ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩) কবিতার বই হলেও এর পরে ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় বেশি গুরুত্ব দেন তিনি। কাব্যগ্রন্থ ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ (১৯৮০), ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫), ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল’ (১৯৮৭), ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’র (১৯৯০) মাধ্যমে কবিতাপ্রেমীদের নজর কাড়েন।
তার প্রথম উপন্যাস ‘ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল’ আলোড়ন তোলে ও বিপুল সমাদৃত হয়। উপন্যাসের মাধ্যমেও তিনি তার চেতনার প্রকাশ ঘটাতে থাকেন। ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’ (১৯৯৫), ‘মানুষ হিসাবে আমার অপরাধসমূহ’ (’৯৬), ‘রাজনীতিবিদগণ’ (’৯৮), ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ (’৯৯), নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধ’ (২০০০), ‘ফালি ফালি করে কাঁটা চাঁদ’ (’০১), ‘শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা’ (’০২), ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ (’০৪) ও ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (’০৪) একে একে প্রকাশিত হতে থাকে এবং বিপুল প্রশংসিত হতে থাকে।
২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে রাতে অমর একুশে বইমেলা থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথে ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তি দ্বারা চাপাতি ও বোমা হামলার শিকার হন বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রথাবিরোধী লেখক ও অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ।
প্রথমে হুমায়ুন আজাদকে ক্লিনিক্যালি ডেথ ঘোষণা করেন সিএমএইচ-এর ডাক্তাররা। পরে ৭২ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হুমায়ুন আজাদের জ্ঞান ফিরে আসে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে পাঠায়। এরপর কিছুটা সুস্থ হলেও এ যাত্রায় আর টিকে থাকতে পারেননি।
১১ আগস্ট রাতে জার্মান কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের দেওয়া একটি পার্টি থেকে ভালোভাবেই নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেন। সে রাতেই কোনো একসময় হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। ১২ আগস্ট ভোরে ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। হুমায়ুন আজাদ কুসংস্কারহীন এক আধুনিক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু তাকে চলে যেতে হলো অকালে।
মূলত তার ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসের জন্য তার ওপর এ হামলা হয়। ২০০৪ সালে ‘আগামী প্রকাশনী’ থেকে তার এ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনী।
এ প্রসঙ্গে ওসমান গনী আদালতকে বলেন, ‘২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত নয়টার দিকে বাসায় যাই। পরে টেলিফোনে প্রথমে সংবাদ পাই, হুমায়ুন আজাদ স্যারকে মেরে ফেলা হয়েছে। পরে শুনি, স্যার মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। এ সংবাদ শোনার পর আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে যাই। তখন হুমায়ুন আজাদ স্যারকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পাই।’
২০০৪ সালের বইমেলায় ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি ব্যাপক বিক্রি হয় বলে জানান ওসমান গনী। তিনি আদালকে বলেন, ‘বইটি ইত্তেফাক পত্রিকায়ও বের হয়। তখন মৌলবাদীরা মিছিল করে বইটি নিষিদ্ধের দাবি জানায়। মৌলবাদীরা হুমায়ুন আজাদকে মুরতাদ ঘোষণা করে। তাকে হত্যার হুমকি দেয়। আমাকেও তারা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চিঠি পাঠায়।’
‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বই প্রসঙ্গে লেখক আকিদুল ইসলামের কাছে এক প্রশ্নের জবাবে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন-
‘মাত্র ১১২ পৃষ্ঠার একটি বইয়ের কী অসাধারণ শক্তি যে, এর লেখককে হত্যা করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যাদের সম্পর্কে এ বইটি লেখা, যাদের নোংরা চরিত্র এ বইয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তারা ১১২ পৃষ্ঠা বই লিখে জবাব দিতে না পারলেও ১০১২ পৃষ্ঠার বই লিখে এর জবাব দিতো। কিন্তু সে সামর্থ্য তাদের নেই।’ (শেকলে বাঁধা কফিন, আগামী ২০০৮, পৃ. ৪৯)।
হুমায়ুন আজাদ আরও বলেছেন- ‘আমি এ বইতে অকপটে মৌলবাদীদের নির্মমতা, তাদের অত্যন্ত কুৎসিত জীবনের কাহিনী উপস্থাপন করেছি। এভাবে আর কোথাও হয়নি। এভাবে বাংলাসাহিত্যে কেন, বিশ্বসাহিত্যেও মৌলবাদকে তুলে ধরা হয়নি। মৌলবাদকে তত্ত্ব হিসেবে নয়, বাস্তব, অশ্লীল একটি শক্তি হিসেবে যেভাবে দেখা দরকার, আমি আমার বইতে সেভাবেই দেখেছি। এটি তাদেরকে অত্যন্ত পীড়িত করেছে।’ (ঐ, পৃ. ৩৯)।
বাংলা সাহিত্যে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন সেই লেখক, লেখার জন্য যাকে রক্ত দিতে হয়েছে। হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ত্রিকালদর্শী লেখক। ত্রিকালদর্শী এ জন্যই যে, “সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে”-এর মতো সময়োপযোগী যুগান্তকারী কবিতা তিনি সৃষ্টি করে গেছেন। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে আলোচনা আছে, সমালোচনা আছে। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে দীপ্যমান। হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ‘ঠোঁটকাটা’ ও ‘রগচটা’ প্রকৃতির মানুষ। ধর্মান্ধতা, অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, কুসংস্কার, ভন্ডামীসহ যাবতীয় অন্ধকারের বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন।
হুমায়ুন আজাদ বলে গিয়েছিলেন—“সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।” বর্তমান সময়ে সর্বত্রই সেটার প্রতিফলনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে দেশের বুদ্ধিজীবীদের কন্ঠে যখন বিড়ালের রণসংগীত বাজে তখন হুমায়ুন আজাদকে বেশ মনে পড়ে। জাতির এই সংকটকালীন মুহূর্তে তার অভাব নিদারুণভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। গুণী এই লেখকের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান ইমন মুক্তমত সাহসী ও আপসহীন লেখক হুমায়ুন আজাদ আমাদের প্রেরণা