এত বহিষ্কারকে বিএনপির নির্বাচনী কৌশল বলাই ভালো
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:১৪
অবশেষে বহিষ্কারই হলেন প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়া বিএনপির ৭৩ জন নেতা। এর আগে কয়েক দফা কেন্দ্রীয় বৈঠক, ফোন, চিঠি চালাচালি, হুমকি কোন কিছুতে কাজ হয়নি। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন তারা। এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়েই তারা মাঠে থাকছেন। তারা এও জানিয়েছেন যে, এই বহিষ্কারাদেশ গঠনতান্ত্রিক হয়নি। তাই এ নিয়ে তারা ভাবছেন না। এখন তাদের লক্ষ্য ভোটারের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং জয়ী হওয়া। এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তারা বলছেন, নির্বাচনে জয়ী হলে দলই তাদের খুঁজে বের করে আবার দায়িত্ব দেবে।
প্রার্থীদের এই দৃঢ়তা দেখে বিশ্ব বিখ্যাত সেই উক্তিটির কথা মনে পড়ছে “ইতিহাস সব সময় বিজয়ীদের পক্ষে”। কিশোরগগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নজমুল আলম গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘আমি তো জাতীয় পর্যায়ের নেতা না, তৃণমূলের নেতা। আমাকে তৃণমুলে থাকতে হবে৷ আমি যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকি, তাহলেই আমি নেতা৷ সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকলে তো আর দলের সঙ্গে বেঈমানি করা হয় না।’’
আরও যারা এখনও নির্বাচেনের মাঠে আছেন তাদের সবার কণ্ঠেই একই রকম সুর। তারা কেউই দলীয় রাজনীতি বিচ্ছিন্ন হতে চান না। আর চান না বলেই তারা মনে করেন, রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানের জন্যেই নির্বাচনে অংশ নেয়া দরকার। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়াটা ছিল তাদের দলের ঐতিহাসিক ভুল। যে ভুলের খেশারত আজও দিচ্ছে গোটা দল। সবচেয়ে বেশি দিচ্ছেন তৃণমূলের নেতা কর্মীরা। তাই নির্বাচনে অংশ নিয়ে এক অর্থে তারা দলকেই রক্ষা করছেন। একটা সময় দল এই ভুল বুঝতে পারবে।
বেশিরভাগ বহিস্কৃত নেতার কথা শুনে মনে হচ্ছে, এই যে বহিষ্কারাদেশে, এতে তাদের রাজনৈতিক কোন ক্ষতিই হয়নি, বরং কিছু লাভ হয়েছে। তারা এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করছেন এর জন্যে কারো কাছ থেকে দলীয় প্রতীক কিনে আনতে হয়নি। নিজের পছন্দের একটি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারছেন। বিনা বাধায় যে কোন ভোটারের কাছে যেতে পারছেন। দলীয় বাধার কারণে অনকে সময় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের চিহ্নিত ভোটারদের কাছে তারা যেতেই পারতেন না। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগের প্রতীক নেই, সেহতেু যে কোন ভোটারের কাছে তারা যেতে পারবেন বিনা দ্বীধায়।
এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করতে গিয়ে সব চেয়ে খুশি হয়েছেন যাদের দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখন তাকে আর এর জন্যে দীর্ঘদিনের কোন দলীয় সহযোদ্ধার সঙ্গে ইঁদুর-বেড়াল খেলতে হচ্ছে না। তিনি যেহেতেু রাজনীতি করেন সেহেতু তার প্রচলিত অনুসারীরাই তার সঙ্গে থাকছেন। তার দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী যদি নির্বাচনে অংশ নিয়েও থাকেন তাকেঁও লড়তে হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে। সুতরাং তার অনুসারী তার সঙ্গেই আছেন। পদবীধারীরা হয়তো নির্বাচনের মাঠে প্রকাশ্য হতে পারবেন না। কিন্তু তাদের মনোভাব ব্যক্ত করায় তো কেউ বাধা দিতে পারবে না। অর্থাৎ যার যার সমর্থক তার তার সঙ্গেই আছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা বিএনপির সহ সভাপতি ওমরাও খান উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী। তার মতে, এলাকায় নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তাদের ভোটাররা অনেক সচেতন। কেউ কারচুপি করার চেষ্টা করলে তাদের ভোটাররাই রুখে দেবে। এর আগে এই এলাকার সবগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভালো হয়েছে৷ ওমরাও খানের কথায় মনে হয় তিনি সারা দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চিত্র বলছেন। আসলেই তো সাধারণ ভোটার সচেতন হলে সুষ্টু নির্বাচন হতে আর তো কিছুর দরকার নেই। আমার মনে হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে সবার আগে ভোটারদের ওপর ভর করার সময় এসেছে।
বহিষ্কৃত বিএনপি প্রার্থীদের কথা পড়তে পড়তে আমার একটা কথা খুব মনে হচ্ছে, এই যে এত বহিষ্কার এটা কোন দলীয় কৌশল নয় তো? কারণ শো কজ না করেই একজন সাধারণ কর্মীকেও তো বহিষ্কার করা যায় না। আর এরা তো শক্তপোক্ত পরিক্ষীত নেতা। তাদেরকেই কেন এরকম অগোছালো বহিষ্কার? বিএনপির মত বড় দলের নীতি নির্ধারণী মহল থেকে এমন কাঁচা কাজ, ইচ্ছে করে ছাড়া করা সম্ভব নয়। বিষয়টি কী এমন, যে বাইরে প্রচার করা হলো ‘সরকারের কোন নির্বাচনে তাদের আস্থা নেই’ আবার যখন সময় হলো, তখন বহিষ্কৃতদের একটা সহজ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, দলের ফিরিয়ে নেয়ার পথ খোলা রাখা হলো?
নির্বাচনে অংশ নেয়াদের বহিষ্কার করা যে কৌশল, সেই ধারণার পক্ষে আরেকটি শক্ত যুক্তি দেয়া যায়। সেটা হচ্ছে, আরও তিন দফা উপজেলা নির্বাচন আছে। পৌরসভা নির্বাচন আাছে। আাসছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। সবখানেই ভুরি ভুরি দলীয় প্রার্থী প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন তাদের সত্যি সত্যি যদি বহিষ্কার করে তাহলে দল চালাবে কারা? আবার সহযোগী জামায়াতের ২২জন প্রার্থী যেখানে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছে সেখানে বহিষ্কার বহিষ্কার-বহিষ্কার না খেলে উপায় কী? এরকম উভয় সঙ্কটে পড়লে তো খানিকটা কৌশল তো করতেই হয়।
একটা গল্প বলে আজকের লেখাটা শেষ করি। গল্পটা একজন স্থানীয় রাজনীতিকের। তিনি ছোট দলের বড় নেতা। তিনি প্রার্থী হন জাতীয় নির্বাচনে। কিন্তু জয়ী হন না। তার দলের প্রার্থী স্থানীয় নির্বাচনে দাঁড়ালে কিছু ভোট পান কিন্তু জয়ী হন না। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কাউকে সমর্থন করলে ফলাফলরে এর একটা প্রভাব পড়ে। যে কারণে তিনি প্রতিবারই কাউকে না কাউকে সমর্থন দেন এবং তার হয়ে প্রচার করেন। তার সেই প্রচার স্টাইলটাই আজকের গল্প।
একবার তিনি এমন এক প্রার্থীর প্রচার করছেন, যার লোখাপড়া একটু কম। তিনি শ্রমিকদের চায়ের আসরে বসেছেন। উদ্দেশ্য নির্বাচনী প্রচার। শুরু করলেন প্রার্থীর দুর্বলতা দিয়েই। বললেন, এবারও নিশ্চয়ই তোমরা এই অশিক্ষিতটাকেই ভোট দিচ্ছ? সবাই উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন, কেন এরকম মনে হচ্ছে আপনার? তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ, যত শিক্ষিত লোকজন এবার নির্বাচনে আসছে এদের কারো কাছে তোমরা ভিড়তে পারবে না। সকালে ঘুম থেকে টেনে তুলে কথা বলতে পারবে না। সবাই কাচুমাচু হয়ে বললো, ভাই ঠিকই ধরছেন।
সেই ভদ্রলোক যখন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসলেন, তখন বলতেন, তোমরা নিশ্চয়ই এবারও শিক্ষিত প্রার্থীদের এড়িয়ে যাবে। তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ যত কাজ আসে, বুদ্ধি খরচ করে শিক্ষতরা এমন সুক্ষ্ম চুরি করবে৷ যে তোমরা বুঝতেই পারবে না। কিন্তু অশিক্ষিতটা চুরি করলে, মোটা দাগে করবে সেটা তোমরা ধরতে পারবে। ব্যবসায়ীরা বুঝতেই পারলেন না যে নির্বাচনী প্রচার হয়ে গেলো। বরং তার প্রশংসা করেই বললেন, ভাই যে কীভাবে পালসটা টের পেয়ে যান।
বিএনপির এই বহিস্কার আমার আসলেই সেরকম নির্বাচনী কৌশল মনে হচ্ছে। কারণ এইযে বহিস্কৃত প্রার্থীদের নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। তাদের ছবি ছাপা হচ্ছে পত্রিকায়। কথা প্রচার হচ্ছে ব্রডকাস্ট মিডিয়ায়। সে অনুযায়ী অন্য প্রার্থীরা কিন্তু কাভারেজ পাচ্ছে না। নেতিবাচকভাবে ইতিবাচক প্রচার আর কী। গোটা বিষয়টা কৌশল হিসাবে কিন্তু খারাপ না। কথায় আছে না ‘প্রেমে আর যুদ্ধে সব কৌশল বৈধ’। ঠিক আছে হোক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি অংশগ্রহণমুলক নির্বাচন হলেই হলো।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
এত বহিষ্কারকে বিএনপির নির্বাচনী কৌশল বলাই ভালো পলাশ আহসান মুক্তমত