শোষণে নিষ্পেষিত শ্রমজীবীর সেকাল-একাল
১ মে ২০২৪ ১৫:২৮
মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠেই টুথ– ব্রাস, টুথ– পেস্ট দাঁত পরিস্কার করে। তোয়ালে হাতে নিয়ে হাত–মুখ ভালো ভাবে পরিস্কার করে। অনেকেই হাতে বিস্কুট আর চা কাপে চুমু দিতে দিতে দৈনিক প্রতিদিনের খবরের কাগজের শিরোনাম পড়ে। খবর পড়ে দেশের অবস্থা বিশ্লেষণ করতে পারে। সেই খবরের কাগজে আমাদের দেশে প্রতিদিনেই সড়ক দুর্ঘটনা ও দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। তারপরও কেউ চলে যায় ফসলের মাঠে কৃষি ফসল উৎপাদন করতে, কেউ চলে যায় ব্যবসা বাণিজ্যে, কেউ চলে যায় কলে–কারখানায় ইত্যাদি নানা ধরনের কাজে।
ফলে সেই সব জায়গায় আমরা যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যবহার করি সেগুলো কি আমরা নিজেরাই উৎপাদন করি? উত্তর হচ্ছে না। আমরা নিজেরাই উৎপাদন করি না। তবে প্রশ্ন আসে উৎপাদন কি? উৎপাদন হচ্ছে প্রকৃতি হতে প্রদত্ত সম্পদ সংগ্রহ করে এদেরকে রূপগত উপযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের ব্যবহার উপযোগী পণ্যে পরিনত করাকেই উৎপাদন বলে।
পণ্য আবার কী? সমাজে কোনও ব্যক্তি উৎপাদন করে এবং আমাদের দরকারি জিনিস বাজারে বিক্রি করে যা আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি তাকে পণ্য বলা হয়। আর পণ্য উৎপাদন করতে যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তাকে উৎপাদন যন্ত্র বলা হয়। আবারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে উৎপাদন কারা করেন? উৎপাদন করেন দুই শ্রেণির মানুষ একজন হলো মালিক আর অন্যজন হলো শ্রমিক। তবে মালিকের মধ্যে দুই শ্রেণি লক্ষ্য করা যায়। কখনো রাষ্ট্র নিজেই হতে পারে অথবা রাষ্ট্রের কোনও এক ব্যক্তি হতে পারে।
তবে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় গুটিকয়েক সমাজতান্ত্রিক দেশ ছাড়া বাকী দেশগুলো উৎপাদন যন্ত্রগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়ে থাকে। ফলে উৎপাদন যন্ত্র যখন নিজের আয়ত্তে থাকে তখন মালিক ব্যক্তিগত লাভের আশায় পণ্য তৈরী করে। আর সেই পণ্যগুলো যারা তৈরী করে তারা হলো যাদের নিজের কোনও জমি– জমা নেই, কোনও টাকা – কড়ি নেই আবার নেই কোনও উৎপাদন যন্ত্র। যা আছে তা হলো শুধু নিজের শরীর শক্তি। ফলে সেই শক্তি অথবা শ্রম দিয়ে যারা জীবন বাঁচায় তাকেই, মজুর বা শ্রমজীবী মানুষ বলে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যারা পুঁজি খাটিয়ে উৎপাদন যন্ত্র আর শ্রমিকদের মাধ্যমে পণ্য তৈরী করে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে লাভ বা মুনাফা করা।
অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত তার লাভ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত পণ্য উৎপাদন করে বাজারে বাজারে বিক্রি করবে। আবার যখনি লাভ বন্ধ হয়ে যাবে তখনি পণ্য উৎপাদন বন্ধ করে দিবে এতে সমাজের কোনও লোকের অসুবিধা হোক কিংবা না খেয়ে মারা যাক তাতে ওই মালিকের কিছু যায় আসে না। কারণ তার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে পুঁজি খাটিয়ে মুনাফা করা। এতে করে শ্রমিকরা কাঠামোগত সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। মালিক বা পুঁজিবাদীরা নিজের ইচ্ছে মত শ্রমিকদের অধিক শ্রমে স্বল্প মজুরি দিয়ে থাকে।
যার ফলাফল হিসাবে আমরা দেখতে পাই পুঁজিবাদের মাধ্যমে শুধু শ্রমিকদের আয় কমিয়ে দিয়ে তাদের গরীব করে তা নয়, অনেক সময় আয়ের পথ বন্ধ করে দিয়ে ভিক্ষুকে পরিণত করে। আমেরিকার শিকাগো শহর তখন শিল্পায়নের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। যার ফলে মার্কিন, জার্মান এবং ইউরোপের শ্রমিকেরা যন্ত্রমানবের মতো শিকাগোতে সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতেন। দিন–রাত কলুর বলদের মতো শ্রম দিয়ে হাতে পেত মাত্র দেড় ডলারের মত। যা দিয়ে তাদের সংসার চলতো না। কিন্তু কষ্ট হলেও তারা মালিকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারতো না। কারণ শ্রমিকদের তখন একতা গড়ে উঠে নি।
এর পর ১৮৮৪ সালের অক্টোবরে আমেরিকার ‘ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস এন্ড লেবার ইউনিয়নস’ এর এক বৈঠকে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। এর মধ্যে আবার আমেরিকার বিভিন্ন লেবার ইউনিয়নের সম্মতিক্রমে ১৮৮৬ সালের মে মাসের ১ তারিখে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। দাবি ছিল একটাই, দৈনিক ৮ ঘন্টার বেশি কাজ আর নয়। অপর দিকে মালিকপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া ১৪–১৬ ঘণ্টা কাজের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে শ্রমিকদের লাল পতাকার মিছিল। ১৯৮৬ সালের মে মাসের ১–৩ তারিখ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলমান ছিল।
শত নিরস্ত্র শ্রমিকদের উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এতে কয়েকজন শ্রমিক নিহত হয়েছিল। এটাই পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণির রক্তাক্ষরের সংগ্রামের ইতিহাস। যা পরবর্তীতে ‘হে মার্কেট ম্যাসাকার’ নামে পরিচিত পায়। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর ওয়ার্কার্স এন্ড সোসালিস্টস ১৮৮৯ সালের মে মাসের ১ তারিখকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ বলে ঘোষণা দেয়।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো স্বাধীনতার ৫৩ বছরের বাংলাদেশের শ্রমিকরা কেমন আছেন? নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকের সমমজুরি পায়? কলে কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা আছে? শিশু শ্রম বন্ধ করতে রাষ্ট্র কি পেরেছেন? অনেকগুলো প্রশ্ন হয়ে গেল কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী উত্তর একটাই দিতে হচ্ছে যে শ্রমিকরা ভালো নেই।
কারণ তারা দিনের পর দিন অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দশ বছর আগে রানা প্লাজার ভবন ধসে শত শত মানুষ আহত এবং নিহত হয়েছে। সেই মৃত্যুঞ্জয়ী পথযাত্রীরা আজও ভবঘুরে। কারও এক পা নেই, কারও এক হাত নেই। স্মৃতিগুলো ভাসে আর চোখের জল পড়ে। রাষ্ট্র এখনও পারল ওই রানা প্লাজা মালিকদের আইনের আওতায় আনতে। শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারল না। এর চেয়ে জাতির জন্য বড় লজ্জাজনক কথা আর কী হতে পারে।
বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে লাগামহীন তাতে শ্রমিকেরা যা আয় করে তা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। যারা শ্রমিক দিবসে ঢাক ঢোল পিটিয়ে শোভাযাত্রা করেন। তাদের ওই আনন্দের অন্তরালে চাপা পড়ে হাজারও শ্রমিকের কান্না। করোনাকালে আমরা দেখেছি রাষ্ট্র শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। দিনের পর দিন শ্রমিক ছাঁটাই করে বেকারত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ এখনও চাকরির জন্য হন্য হয়ে খুঁজে। আর সরকারি চাকরি যেন সোনার হরিণ। কারণ ঘুষ ছাড়া চাকরি পাওয়া মানে আকাশ কুসুম কল্পনা করা। ১৯৮৯ সালের আগে মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল সুইজি বলেছিলেন, অধিক ভোগ ও উৎপাদন প্রবণতার কারণে গ্রিনহাউস ইফেক্ট বা কার্বন নিঃসরণ ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। পুঁজিবাদ যত বেশি বিকশিত হবে, এই ধারা তত বাড়তে থাকবে।
ক্রমেই পৃথিবী ধ্বংসের দিকে যেতে থাকবে। সত্যি তো তাই জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর জন্য অশনিসংকেত। যার একমাত্র দায়ী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো। পুঁজিবাদ এক দিকে প্রকৃতি ধ্বংস করছে আর অন্য দিকে শ্রমিক শ্রেণির মানুষকে শোষণ করছে। এ ভাবে কী পৃথিবী চলতে পারে? পৃথিবীকে বাঁচাতে মুক্তির পথ খুঁজতেই হবে। আমাদের দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত মিলে ৬ কোটি ৮০ লাখ শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে না।
দারিদ্র্য যেন নিত্য সঙ্গী হিসাবে লেগেই আছে আর করোনাকালেও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েই চলছে। শ্রমিকদেরকে শোষণ করে পুঁজিবাদীরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। এতে করে ধনী গরিবের বৈষম্য বেড়েই চলছে। মে দিবস শিক্ষা দেয় অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে। শ্রমিক দিবস শিক্ষা দেয় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির লাল পতাকার ঝাণ্ডার রাজপথে উড়াতে।
মে দিবস দিচ্ছে ডাক মজুরি দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙো। মে দিবস শিখে গেছে, লড়াই করা ছাড়া অধিকার আদায় করতে হয়। তাই মে দিবস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রের উচিত। পোশাক শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত নূন্যতম মজুরি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিক ছাটাই এবং হয়রানি–নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। শ্রমজীবী কার্ড প্রবর্তন করে শ্রমিকদের আর্মি রেটে রেশন ও বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে হবে।
বাজার দর ও মাথাপিছু আয় বিবেচনা করে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি পর্যাপ্ত পরিমাণ দিতে হবে। শ্রম আইনের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারাগুলো বাতিল করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নিহত শ্রমিকের আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণের আইন প্রণয়ন করতে হবে। শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক: কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই