মে দিবস লইয়া কিছু কথা
১ মে ২০২৪ ১৪:৩০
মে দিবস! এই একটা দিনকে লইয়া কত আলোচনা হয়, বক্তৃতা হয়, সংবাদপত্রে বিশেষ বিশেষ নিবন্ধ লেখা হয়, সেই নিবন্ধে কতিপয় চেনাজানা বিশিষ্টজনের ভারি ভারি লেখা ছাপা হয়, এই দিনকে লইয়া গাওয়া ফকির আলমগীরের সেই বিখ্যাত গান বিভিন্ন মাধ্যমে শুনা যায়। আর মনে পড়ে যায় “দুনিয়ার মজদুর এক হও” এর এককালের বজ্র কঠিন শ্লোগানের কথা। পরীক্ষায় রচনা হিসাবে আসিতে পারে ভাবিয়া এই বিষয়ে মুখস্ত করিয়াছি কত কিছু! আঠারো শ’ ছিয়াশি সালের পয়লা মে। শিকাগো শহরের হে মার্কেট, শ্রমিকের রক্তে রক্তাক্ত রাজপথ। ইত্যাদি। ইহার পর হইতে এই দিনকে ঘিরিয়া শহুরে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে, রাজনীতিবিদ, বিশেষত বামদের কন্ঠে এই দিনের বজ্রকঠিন শপথ ও জ্বালাময়ী বক্তব্য, বিবৃতিসহ আরো কত কি শুনিতে শুনিতে ক্লান্ত–শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি। আজকাল ইহার তীব্রতা অনেকটাই স্তিমিত প্রায়।
আজকাল এই দিবসটি অন্য আরো হাজারও দিবসের মত করিয়া কোনওমতে পালিত হয়। তবে সংবাদপত্রে বোদ্ধাদের লেখার শান কমে নাই। শপথের ঘনত্ব এতটুকু হ্রাস পায় নাই। কেবল ইহাকে লইয়া যথাযথ কোন পরিকল্পনা নাই। বিশ্ব জুড়িয়া শ্রমিকের অবস্থার কাহাতক উন্নতি হইয়াছে জানা মুশকিল। তবে আর্থিক উন্নতি অতটা না হইলেও সামাজিক ও কর্মপরিবেশগত আনুষাঙ্গিক কিছু উন্নতি নিশ্চয় হইয়াছে। আমাদের দেশের অবস্থা কীরূপ ইহা বুঝিতে পিএইচডিধারী হইতে হইবে না। কেবল চোখ কান যথাস্থানে একবার ঘুরাইলেই যথেষ্ট হইবে।
এককালের বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবিরা আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অনেকেই গত। যাহারা বাঁচিয়া আছেন তাহাদের গলার আওয়াজ সঙ্গত কারণেই এখন নিচু। তাহাদের বজ্রমুষ্ঠিতেও শিথিলতা আসিয়াছে। আর এই এক বিষয় লইয়া এক জনমে নাম, যশ,পদ ও পার্থিব যাহা তাহারা জোগাড় করিয়াছেন তাহা তাহাদের অম্ল–মধুর স্মৃতিচারণের জন্য যথেষ্টই। তাহাদের উত্তরসূরি হিসাবে আজ যাহারা গোল টেবিল আর টক শো আলোকিত আর চমকিত করিতেছেন তাহারা তাহাদের মিশন ভিশন সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। আজ যাহারা শ্রমিকদের স্বার্থ লইয়া নেতৃত্ব দিতেছেন তাহাদের সহিত তৃণমূল শ্রমিকের আদৌ সম্পর্ক আছে কী–না বুঝা যাইতেছে না। রুজি–রোজগারের তাড়না সবারই আছে। তাই কে কাহার খবর রাখে!
আমাদের খালি চোখে শ্রমিকের দশা লইয়া কিছুটা দৃকপাত করা যাইতে পারে। মোটা দাগে কলকারখানা শ্রমিকের অবস্থা লইয়া আলোচনা করিলে দেখা যাইবে বিশ–ত্রিশ বছর আগেকার শ্রমিকের উস্কখুষ্ক, মলিন, রক্তহীন ফ্যাকাসে, কাঁধ নিচে মুখ এখন হয়ত অনেকটাই স্যালাইন নির্ভর সতেজ দেখাইবে কিন্তু সামগ্রিক বিচারে ইহাদের অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে কি? অবশ্যই হইয়াছে। তবে ইহাতে শ্রমিক আন্দোলনের অংশ আছে কিনা তাহা গবেষণার বিষয়। বিকাশমান শিল্পখাত নানা প্রতিকূলতার ভিতর দিয়া অগ্রসর হইতেছে। ইহাতে বৈশ্বিক ঢেউ ও দৈশিক প্রেক্ষাপট কাজ করিয়া থাকে। সরকারি প্রণোদনাও এই ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখিতে পারে। মালিকপক্ষের কৌশল, উদ্ভাবন ও মার্কেট উপযোগী প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতাও ইহার জন্য প্রয়োজন। আর শ্রমিকের তরফ হইতেও নিছক জ্বালাও পোড়াও আর ভাংচুরের এককালীন সংস্কৃতি এখন সুফল বহিয়া আনিবে না। শিল্প টিকিয়া থাকিলে শ্রমিক থাকিবে। তাহা না হইলে বেকারত্ব বাড়িবে। যাহা আরেক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করিবে। মালিকপক্ষের কথা শুনিলে মাথা গরম হইয়া যাইবে। শ্রমিক পক্ষের কথা শুনিলে ইহাকে চরম বলিয়া মনে হইবে।
আমাদের দেশে ভারি শিল্প সংখ্যায় খুবই কম। যাহা আছে তাহাও টিকিয়া থাকিবার জন্য কুস্তি করিতেছে। আর যাহা আছে তাহা মূলত মাঝারি শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। মাঝারি হউক আর ক্ষুদ্রই হউক শিল্প মানে শিল্পই। শিল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়নে কাজ হইতেছে। সরকারের তরফ হইতে শিল্পের জন্য বিশেষ বিশেষ অঞ্চল স্থাপন করা হইয়াছে। সড়ক–মহাসড়কের নেট ওয়ার্ক সম্প্রসারিত হইতেছে। পরিবহন শিল্পে প্রভূত উন্নতি যোগ হইয়াছে। বন্দর ব্যাবস্থাপনায় আধুনিকতা আনয়ন করা হইতেছে। পরিবেশগত উন্নয়নেও কোথাও কোথাও ভালো কাজ হইতেছে। যেমন: পোষাক ও ওষুধশিল্প। শিল্পোদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সময়ে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করা হইতেছে। শ্রমিকের সাথে মালিকের সম্পর্ক স্থাপনে মন্ত্রণালয়সমূহ কাজ করিতেছে। বিচ্ছিন্নভাবে সবই হইতেছে কিন্তু সমন্বয়টাই যথাযথভাবে হইতেছে না।
শ্রমিকদের মাঝেও পজিটিভ মানসিকতা জাগ্রত হইয়াছে। নিজ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা মানে যে নিজ পায়ে কুড়াল মারা ইহা তাহারা আগের চাইতে এখন অনেকটাই বুঝিয়াছে। মাঝখানে কিছু মধুমেহনকারীর তৎপরতা পরিবেশ ঘোলা করিয়া থাকে। ইহাদের বেশিরভাগই হোয়াইট কালার পিপল ও তাহাদের পোষ্য। সচেতনতা বৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি কর্ম পরিকল্পনা থাকিলে ইহাও স্তিমিত হইতে বাধ্য। ক্রমবিকাশমান এই সেক্টরকে আমরা যতটাই পারি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখি। বাকীটা মালিক– শ্রমিকের নেগোসিয়েশন টেবিলে নিষ্পত্তি হইবে। বুদ্ধিজীবীরা কী করিবেন ইহা তাহাদের বিষয়। তবে ইহারা আদৌ কোন ভ্যালু এড করেন কী–না তাহারাই যেন উহা ভাবিয়া দেখেন।
মে দিবস শ্রমিকের অধিকার আদায়ে মাইলফলক হিসাবে অনাগত বৎসরেও সমুজ্জ্বল থাকিবে। শিল্প থাকিবে। আর শিল্প টিকিয়া থাকিতে হইলে দক্ষ–অদক্ষ শ্রমিকের উপস্থিতি অত্যাবশকীয়। ইহা মালিকপক্ষ যেমন বুঝে তেমনি শ্রমিককেও বুঝিতে হইবে শিল্প টিকিয়া না থাকিলে তাহাদের নিশ্চিত পরিণতি বেকারত্ব। মে দিবসের প্রেরণাই মূল শক্তি বাকীটা আমাদের নিজস্ব কর্মতৎপরতা। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত হউক, তাহাদের কর্মপরিবেশ উন্নত হউক। উন্নয়নের চাকা সচল থাকুক। বাহির হইতে আমাদের মত হোয়াইট কালার পাবলিকের কাঠি নাড়ানাড়ি যত কম হইবে ততই মঙ্গল। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই