মে দিবসের প্রত্যাশা কতখানি পূরণ হয়েছে?
১ মে ২০২৪ ১৬:৩২
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস আজ। বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের মহান ‘মে দিবস’ আজ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০ টিরও অধিক দেশে পহেলা মে জাতীয় ছুটির দিন। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি আর দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।
শিল্প–কারখানাসমূহ তখন বিষবাষ্পের মতো গিলে খাচ্ছিল শ্রমিকের গোটাজীবন। অসহনীয় পরিবেশে শ্রমিকদের প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো। সপ্তাহজুড়ে কাজ করে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে যাচ্ছিল। শ্রমজীবী শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার। তখন দাবি উঠেছিল, শিল্প–কারখানায় শ্রমিকের গোটাজীবন কিনে নেওয়া যাবে না। দিনে ৮ ঘন্টা শ্রম দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের সময় ওই বছরের ১ লা মে শ্রমিকরা মিলে ধর্মঘট আহবান করে। প্রায় তিন লাখ শ্রমজীবী মানুষ ওই সমাবেশে অংশ নেয়।
আন্দোলনরত ক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের রুখতে গিয়ে একসময় পুলিশবাহিনী শ্রমিকদের মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে পুলিশের গুলিতে ১১ জন নিরস্ত্র শ্রমিক নিহত হন, আহত ও গ্রেফতার হন আরও অসংখ্য শ্রমিক।
পরবর্তীতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত শ্রমিকদের মধ্য থেকে ৬ জন শ্রমিককে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এতে বিক্ষোভ আরও প্রকট আকারে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে–কে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর অর্থাৎ, ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে।
মে দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে সারাবিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মালিক–শ্রমিক সম্পর্কের ওপর এ দিবসের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর প্রভাবে শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময় ১৬ ঘন্টা থেকে নেমে আসে ৮ ঘন্টায়। বিশ্বের সব দেশের শ্রমিকরা এর মাধ্যমে তাদের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা পেতে শুরু করে। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা এগিয়ে যায় সম্মুখ গতিতে। শ্রমজীবী–মেহনতি মানুষ মুক্তি পেতে শুরু করে তাদের শৃঙ্খলিত চরম দাসত্বের জীবন থেকে। বিশ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় সামাজিক পরিবর্তনের আরেকটি নতুন অধ্যায়।
মে দিবস হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর শ্রমজীবী সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনা করার দিন। শ্রেণি–বৈষম্যের বেঁড়াজালে যখন তাদের জীবন বন্দি ছিল তখন মে দিবসের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খুলে যায় তাদের শৃঙ্খল। এ ফলে আস্তে আস্তে লোপ পেতে লাগলো সমাজের শ্রেণি–বৈষম্য। পুঁজিবাদের দুর্বল দিকগুলোকে পুঁজি করা অবৈধ অর্থলোভীদের আগ্রাসী দংশন থেকে রেহাই পেল কোটি কোটি শ্রমিক। বৈষম্য ও শোষণমুক্ত একটি সমাজ গোটা বিশ্বকে উপহার দিল এই মে দিবস। মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকের যে উঁচু–নিচু সম্পর্ক ছিল তা এক সময় সমতলে চলে আসলো শুধুমাত্র মে দিবসের স্বীকৃতির ফলেই।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়়নশীল দেশ। এই দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই অধিক। কিন্তু এই শ্রমজীবী মানুষেরা এখনও তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। বন্ধ হয়়নি শ্রমিক শোষণ।
বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তারা সবচেয়ে বেশি ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার। হে মার্কেটের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করলেও বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের এখনো তার চেয়ে অনেক বেশি সময় কাজ করতে হয়। সে অনুযায়ী তাদের মজুরি ও বেতন–ভাতা নেই।
মে দিবসের পথ ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের অধিকার, বিশেষ করে মজুরি, কাজের পরিবেশ, সুযোগ–সুবিধা এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এলেও বাংলাদেশে শ্রমিকেরা বেতনবৈষম্যের শিকার। দুই–একটি খাত ছাড়া শ্রমিকদের কর্মপরিবেশও নাজুক। বিশেষ করে জাহাজভাঙা শিল্প, ইমারত নির্মাণশিল্পে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে। আবার অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বাড়তি সময় কাজ করিয়ে নিলেও ন্যায্য মজুরি দেয় না। এটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প হলো তৈরি পোশাকশিল্প। এদেশের অর্থনীতির বিরাট একটা অংশ আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে। অথচ এ পোষাকশিল্পের শ্রমিকদের বেতন–ভাতা ঠিকমতো দেওয়া হয়় না। এ শিল্পখাতে শ্রমিকদের ৮০ ভাগই নারী হলেও একধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনয়াপন করতে হয়। পোশাকশ্রমিকরা নির্দিষ্ট সময়ে তাদের মজুরি, বেতন–ভাতা পায় না। প্রায় সময়ই আমরা এসব শ্রমজীবী মানুষদের বেতন–ভাতা আদায়ে আন্দোলনে রাস্তায় নামতে দেখি। কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি পোশাক শ্রমিকরা তাদের বেতন–ভাতার দাবিতে আন্দোলন করেছে।
মে দিবস পালন তখনই সার্থক হবে, যখন দেশের শ্রমজীবী মানুষ ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মস্থলের নিশ্চয়তা পাবেন। মালিকদের উপলব্ধি করতে হবে, শ্রমিকদের ঠকিয়ে শিল্পের মুনাফা আদায় বা অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করা যাবে না। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক, এটাই মে দিবসের প্রত্যাশা। জয় হোক সাম্যের, জয় হোক শ্রমজীবী–মেহনতি মানুষের।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই