শ্রমিকের জন্যে আইন
১ মে ২০২৪ ১৮:৩৭
আজ পহেলা মে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। সারাদেশের ন্যায় বাংলাদেশেও প্রতিবছর এই দিবস পালিত হয়। প্রতিবছরের ন্যায় ‘শ্রমিক– মালিক গড়বো দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ’ এই প্রতিপাদ্য পালিত হবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। মূলত শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে পালন করা হয়় এই দিবসটিকে। এই দিবসটির পিছনে জড়িয়ে রয়েছে শ্রমিকদের নানা আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ন্যায্য মজুরি এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। আর এরপর থেকেই এই দিনটি পালিত হয়়ে আসছে শ্রমিক দিবস হিসেবে। সেদিন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথে সংগ্রাম করেছে শ্রমিকরা। তাদের অধিকার রক্ষায় তৈরি করা হয়েছে আইন।
বৃটিশ ও পাকিস্তান শাসনামল থেকে পূর্বোক্ত শ্রম আইন সহ প্রচলিত ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন শ্রম আইনের বিষয়বস্তুকে সমন্বিত করে ২০০৬ সালে একক নামে বাংলাদেশ শ্রম আইন–২০০৬ প্রণয়ন করা হয়়। এই আইনে বিষয়ভিত্তিক মোট ২১টি অধ্যায়, ৩৫৪টি ধারা ও ৫টি তফসিল রয়েছে।
শ্রমিকের চাকুরী সংক্রান্ত সকল বিষয় যেমন– নিয়োগও চাকুরীর শর্তাবলী, কর্মঘন্টা ও ছুটি, মজুরী, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, কল্যাণমূলক বিষয়াবলী, মহিলা শ্রমিকদের প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা, দুর্ঘটনা ও ক্ষতিপূরণ, শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রুপ বীমা, লভ্যাংশের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনসহ নানা বিষয় এই আইনে উল্লেখ রয়েছে। উক্ত আইনে যেমন মালিকের প্রতি শ্রমিকের আচরণ ও দায়িত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে ঠিক তেমনি শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতে মালিকের নানা দায়বদ্ধতার কথা উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও আইন লঙ্ঘনে শাস্তি বিধানও রাখা হয়েছে উক্ত আইনে। বাংলাদেশ শ্রম আইন–২০০৬ বিভিন্ন ধারায় শ্রমিকের অধিকার কথা উল্লেখ আছে। উক্ত আইনের অধীনে একজন শ্রমিক কোনও মালিকের কারখানায় শ্রমিক হিসেবে চাকরিতে নিযুক্ত হলে এ আইনের ৫ ধারায় নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র পাওয়ার অধিকারী।
চাকরিকালীন একজন শ্রমিক ১০৩ ধারা অনুসারে প্রতিষ্ঠান ভেদে একদিন, দেড়দিন, ২৪ ঘণ্টা সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করতে পারবেন। ওইরূপ ছুটির জন্য তার মজুরি থেকে কোনরূপ কর্তন করা যাবে না। উক্ত আইনের ২৬ ধারায় মালিক কর্তৃক একজন শ্রমিকের চাকরি কোন প্রকার কারণ না দেখিয়ে অবসান ঘটাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মালিক মাসিক মজুরির শ্রমিককে ১২০ দিনের লিখিত নোটিশ অথবা ১২০ দিনের মজুরি, মাসিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিক ছাড়া অন্য শ্রমিকের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের লিখিত নোটিশ বা ৬০ দিনের মজুরি পরিশোধ করে শ্রমিকের চাকরির অবসান ঘটাতে পারেন।
আইনের ২৮ ধারায় কোন শ্রমিক একনাগাড়ে ২৫ বছর চাকরি করার পর অথবা শ্রমিকের বয়স ৫৭ বছর পূর্ণ হলে স্বাভাবিক নিয়মে অবসর গ্রহণ করবেন। এ ক্ষেত্রে অবসর গ্রহণকারী শ্রমিক প্রতি বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি পাবেন। কোন শ্রমিক তিন বছরের অধিককাল কোন মালিকের অধীনে চাকরিরত থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে ওই শ্রমিকের মনোনীত ব্যক্তি বা তার পোষ্য পূর্ণ বছর বা ছয় মাসের অধিক সময়ের চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটি, যা অধিক তা পাবেন।
একজন মহিলা শ্রমিক এ আইনের ৪৬ ধারায় সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের অব্যবহিত পূর্ববর্তী আট সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পরবর্তী আট সপ্তাহ প্রসূতিকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকারী। এ আইনের ১১৫ ধারায় প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি পঞ্জিকা বছরে পূর্ণ মজুরিতে দশ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি পাওয়ার অধিকারী হবেন। ১১৬ ধারায় প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি এক বছরে পূর্ণ মজুরিতে ১৪ দিনের পীড়া বা অসুস্থজনিত ছুটি ভোগের অধিকারী।
১১৭ ধারায় এক বছর চাকরি পূর্ণ হলে প্রতিষ্ঠান ভেদে আঠার দিন কাজের জন্য একদিন, বাইশ দিন কাজের জন্য একদিন, এগার দিন কাজের জন্য একদিন হিসেবে মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি পাওয়ার আইনত অধিকারী। প্রত্যেক শ্রমিককে প্রত্যেক পঞ্জিকা বছর মজুরিসহ এগার দিনের উৎসব ছুটি মঞ্জুর করতে হবে। আইনে অধিকারের কথা উল্লেখ থাকলেও একজন শ্রমিক তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিনা এবং তার আইনি অধিকার সম্পর্কে জানে কিনা সে প্রসঙ্গেও প্রশ্ন থেকে যায়।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে শ্রমিকদের নিয়ে বলা হয়েছে। সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে– রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে– কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা। সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদ–২৯ এ বলা আছে– কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে অনুচ্ছেদ ৩৪ এ বলা আছে জোরপূর্বক কাউকে শ্রমদানে বাধ্য করা যাবে না। অনুচ্ছেদ ৩৫ এ বলা আছে– কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবে শ্রমিকরা নির্যাতিত, লাঞ্চিত হচ্ছে প্রতি পদে পদে।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে শ্রমিক সমাজ পালন করবে অগ্রণী ভূমিকা। আমাদের দেশে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো শ্রমিকরা। শ্রমিকরা ভালো থাকলে আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। শ্রমিকরা ভালো থাকলে ভালো থাকবো আমরা। তাদের ভালো রাখতে প্রয়োজন আইনের সঠিক বাস্তবায়ন। আইনের সঠিক বাস্তায়নের সাথে তাদের ভালো রাখতে পারে মালিকরা। মালিকরা শ্রমিকের প্রতি সদয় হলে এবং তাদের নায্য সম্মান প্রদান করলে শ্রমিকরা ভালো থাকবে। আমাদের দেশের শ্রমিকরা যেন ভালো থাকে, তারা যেন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় শ্রমিক দিবসে এটাই রইল প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ফেনী ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এসবিডিই