অন্যরকম লালন সাঁই
২ মে ২০২৪ ১৫:২১
সাম্প্রতিককালে আবারও আলোচনায় এসেছেন ভাববাদী দার্শনিক লালন সাঁই। আলোচনায় এসেছেন সেই পুরোনো আঙ্গিকেই ধর্ম জড়িয়ে লালন নিয়ে দ্বন্দ্ব। লালনের গানের কয়টি পদ শেয়ার করার কারণে একটি ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগ- অনুভূতিতে আঘাত। অভিযোগকারী মুসলমান এক ধার্মিক। লালনের ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারী জাতির কী হয় বিধান’ বাণীতে তাঁর অনুভূতি আঘাতপ্রাত হয়েছে। ফলে, আবারও আওয়াজ ওঠেছে লালন সাঁইকে নিয়ে। কথা হচ্ছে, লালন সাঁইকে বাঙালী মুসলমানরা নাফরমান, নিষিদ্ধ, বেদাতি এই প্রথমবারই বলছেন না। তারা লালনের জীবিতকাল থেকেই এরকম বাহাজ-হল্লা করে আসছেন৷ লালনকে কাফির, মুরতাদ ঘোষণা করে আসছেন। কিন্তু, তাতে লালনের দর্শন চর্চায় বিন্দুমাত্রও বিচ্ছুতি ঘটেনি। লালনকে নিয়ে সাম্প্রতিককালে শুধু মুসলমান সমাজে বিতর্ক, কুৎসা, বিরোধিতা দেখা যায়। কিন্তু, সেকালে বাঙালী হিন্দুরাও লালনকে কম জ্বালাতন করেন নি। হিন্দু ঠাকুর আর মুসলমান মোল্লা একজোট হয়ে তখন লালনকে বিপর্যস্ত করতে চেয়েছেন। তবু, লালনের গান, আদর্শকে দমিয়ে রাখা যায়নি। যেসব কাঠমোল্লারা আজকে লালনের বিরুদ্ধে সাধারণ ধার্মিকদের ক্ষেপিয়ে তোলতে চাইছেন তারা নিজেরাও জানেন না, সাধারণ অনেক মুসলামানও অকপটে লালনের ‘‘আমি ওপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়/পাড়ে লয়ে যাওয়া আমায়’’ গান শোনে চোখের জলে বুক ভাসান। অনেক মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরকে লালনের এ বাণী গজল আকারেও গাইতে দেখি অহরহ। কিন্তু, এগুলো কাঠমোল্লাদের চোখে পড়ে না৷ পড়বেও না৷ তাদের চোখে মারা আছে ধর্মকে ঘিরে তৈরি অন্ধত্বের তালা।
বলছিলাম যে, বাঙালী মুসলমানরা লালনকে দূরে ছোড়ে ফেলে দিতে চাইলেও লালনের স্থানচ্যুতি হবে না। লালন হিন্দু-মুসলিম বিষয়ে হয়তো ভাবতেনই না যিদি তিনি অন্য অঞ্চলে জন্ম নিতেন। লালন, মূলত ভাববাদী আধ্যাত্মিক দর্শনচিন্তার মানুষ ছিলেন। তার বেশিরভাগ গান, বাণী এমনকি চর্চায় তাঁর সেই দর্শনেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। হিন্দু-মুসলিম সংঘাত এ অঞ্চলের তখন চলমান একটি স্বীকৃত সমস্যা। লালন যেহেতু এমনি এক পরিবেশে জন্ম নিয়েছেন তাই তাকে পারিপার্শ্বিক এই ধর্মীয় ব্যাপারেও লিখতে হয়েছে, গান বাধতে হয়েছে৷ কিন্তু, কেউ যদি বলেন লালন সারাজীবন অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেছেন, সেই বাণী ছড়িয়ে গেছেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবতাবাদী হওয়াই ছিল লালনের সাধনার লক্ষ্য তাহলে বলবো— লালন সাঁই সম্পর্কে আপনার ভাবনায় ভুল আছে৷ লালন সাঁই শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অসাম্প্রদায়িক গান, বাণী লেখার জন্যই আসেননি। লালনের চর্চার নাম করে আজকাল বাউলদের মধ্যে নারীদেহ সম্ভোগের যে বুজরুকি সাধন কারবার এগুলোও লালন করতেন না! এসব পরবর্তীতে অন্য বাউলদের মাধ্যমে ছড়ানো কিছু ভ্রান্তি মাত্র। যারা বাউল হতে চেয়ে হতে পারেনি আসলে। তারা আদতে বাউলিয়ানার নামে কিছু বিকৃত চর্চা, সাধন প্রণালীকে মানুষের সামনে তোলে ধরেছে। যেহেতু লালন সাঁই এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ একজন বাউলও। তাই লোকে মেকি বাউলদের বিকৃত ওইসব সাধনাকেই লালনের সাধন বলে জানল। তাদের বিশ্বাস, লালনও এভাবে পশুর মতো নারীসনে যৌনাচার করতেন। কিছু বাউল যার নাম দিয়েছে সাধনা। অথচ, কিছু বিশ্বাসযোগ্য লালন বিশেষজ্ঞের বই পড়লে জানা যায়— লালন নিজের আশ্রমে কোনো নারী নিয়ে এরকম কিছু দেখলেই ক্ষেপে উঠতেন। শিষ্যকে বকাঝকা করে তাড়িয়ে দিতেন। লালনের আশ্রমে তাঁর জীবিতকালে গাঁজা সেবন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু, এখন সেই আশ্রমে নানা উৎসব-পার্বনে প্রকাশ্যেজ মাদকের রমরমা কারবার চলে। সাধারণের যারা এসব দেখেন তাদের মনে লালন সম্পর্কে বিদঘুটে ধারণার জন্ম নেয়। ফলে, তারা অচিরেই লালন বিরোধিতে পরিণত হচ্ছে।
আমি বলছি, লালন সাঁই ভাববাদী দার্শনিক ছিলেন। ধর্ম, হিন্দু, মুসলমান, সাম্প্রদায়িকতা এসব বিষয় তার পারিপার্শ্বিকে ঘটছিল। তাই তাকেও মাঝেমাঝে এসবে অংশ নিতে হয়েছে। কিন্তু, এটিই তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল বলা যায় না। লালন যতগুলো হিন্দু-মুসলিম ইস্যু নিয়ে রচনা করেছেন তার তুলনায় অনেক অনেক বেশি রচনা করেছেন দার্শনিক বিষয়াদি নিয়ে গান। যা আমাদের সাধারণের বোধগম্য নয়। কিন্তু, লালন সেই বিষয়গুলো ধরতে পেরেছিলেন যা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন এরিস্টটল, স্পিনোজা, দেকার্তে, রুশো, ফ্রয়েড, রাসেলরা। তিনি আমাদের গড় মানুষের মতো নিত্য স্থুল বিষয়াদির কথা বলতে আসেননি। হিন্দু-মুসলিমের বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িক দা-ঙ্গা, স-ং-ঘাত এগুলো স্থুল সামাজিক সমস্যা। এসব সমস্যার নেপথ্যে থাকে রাজনীতি, রাজা, প্রজ ইত্যাদি। কিন্তু, লালনের সাধনার বিষয়াদি ছিল সুক্ষ্ম বিষয় নিয়ে। এতো সুক্ষ্ম যে উগ্র ধার্মিকদের মতো স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন আদমির পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন, বুঝতে পারা দুঃসাধ্য। তাই তারা এটাকে খারিজ করে দিতে চায়, বাতিল চায়। যে গ্রহণ করতে জানে না, যার মধ্যে একটি বিষয় বুঝবার মতো জ্ঞান নেই, উপলব্ধি করবার মতো প্রজ্ঞা নেই, তারা সেই বিষয়টিকে বাতিল করে দিতে চায়। লালন সাঁই বাঙালী ধার্মিকদের কাছেও তেমনি। লালনকে বাঙালী বুঝতে চায় জাত-পাত বিচারে। কিন্তু, লালন এমন নন। তাঁকে ও তাঁর চিন্তাকে বুঝতে প্রয়োজন প্রজ্ঞার, জ্ঞানের। যেমনটা সক্রেটিস, স্পিনোজা, দেকার্তে, রুশো, ফ্রয়েডদের ক্ষেত্রে হয়। সৌভাগ্যবশত লালন আমাদের সেই ধন, যাকে দার্শনিক দিক থেকে স্পিনোজা, দেকার্তে, রুশোর চিন্তার সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু, দূর্ভাগ্যবশত বাঙালীরা লালনকে টেনে নামিয়েছে ধর্মবেত্তা, ধর্মগুরুর স্থানে। অথচ লালন, এ বিশ্বকে বুঝতে চেয়েছেন। জীবের আসা-যাওয়া, গতি-প্রকৃতি, কার্য-কারণের অনুসন্ধানী লালনকে কিছু বাউলও বানিয়ে ফেলেছে কাম বিশেষজ্ঞ গুরুর ন্যায়।
লালনকে অনেক শিক্ষিতরাও ভাবেন তিনি শুধুই একজন মানবতাবাদী বাউল৷ এর কারণ সম্ভবত নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাহিতিক ও সাংস্কৃতিক গুরু শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনকে শিক্ষিত বাঙালীর কাছে এভাবেই পরিচিতি দিয়েছেন—‘‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন বলতে চেয়েছেন- আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’’ রবি বাবুর এহেন লেখা পড়ে সমাজের শিক্ষিতরাও ধরে নিলেন, মূলত লালন একজন মানবতাবাদী বাউল। তিনি গানেগানে মানবতার কথা বলছেন। আমাদের তা শোনা উচিৎ।রবি বাবুর এই আহ্বানে চাপা পড়ে গেল লালন সাঁইর দার্শনিক রচনাগুলো। লালন যে গাইলেন- ‘‘আকাশপাতাল খুঁজিস যারে, এই দেহে সে রয়/খুঁজে দেখ দেখি মন, কীরূপ লীলাময়’’ এর দার্শনিক ভাব মানুষকে আর ভাবাল না। তারা পড়ে রইল লালনের মানবতাবাদ নিয়ে। জাত-ধর্ম, কামনদীর গান নিয়ে। যেগুলো লালনের সামগ্রিক সাধনার একটি দিক মাত্র। মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িক ভাবনা লালনের দার্শনিক জীবনের অনেকগুলো প্রকাশের একটি প্রকাশ মাত্র। তিনি জর্মান দেশে জন্ম নিলে হয়তো এসব নিয়ে কিছুই লিখতেন না। লিখতেন তৎকালীন নাৎসিদের নিয়ে। সেখানেও থাকতো সামষ্টিকের কল্যান। বঙ্গদেশে যেহেতু সামষ্টিক সমাজ মানেই ধরা হয় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক জীবনাচার; তাই এ অঞ্চলের মানুষ ধরে নিল তিনি সর্বধর্মের সমন্বয়ে কিছু বলতে চাইছেন। এটাই তাঁর লক্ষ্য। যদিও, আমার দৃষ্টিতে লালন মূলত দার্শনিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লালনের এই দর্শন সত্ত্বাটিকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন তাঁর গানের মাধ্যমে। ফলে এক রত্ন আরেক রত্ন স্পর্শে প্রভাবিত হয়েছিল। কিন্তু, তবু রবীন্দ্রনাথ লালনকে শুধুই বাউলের স্বীকৃতি দিয়েছেন, দার্শনিক বলেন নি। অপরদিকে, লালন নিজে কখনও নিজেকে বাউল, ফকির বলে দাবি করেছেন এমনটাও শোনা যায় না।
লালনের দর্শনে যে পদ্ধতির দেখা মেলে সেটা হলো যৌক্তিক প্রশ্নানুসন্ধান, প্রয়োগবাদ, সচেতন বিশ্লেষণ এবং আত্মিক বিনিয়োগবাদ। লালন তার জ্ঞান সাধনার প্রাথমিক স্তরে যৌক্তিক প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সত্য জানতে উদ্যোগী হয়েছেন। তার সামনে এসেছে সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথা। তিনি এসবকে যৌক্তিক প্রশ্নের মাধ্যমে খণ্ডন করেছেন দার্শনিক অনুপ্রেরণা থেকেই৷ কিন্তু, তা গায়ে লেগেছে ওইসব বিশ্বাসী, রীতিনীতি, প্রথা পালনকারীদের। লালন কার্ল মার্ক্স না পড়লেও মার্ক্সীয় চিন্তায় প্রভাবিত ছিলেন। তিনিও মার্ক্সের মতো বিশ্বাস করতেন কোনো বস্তু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন আমরা প্রাচীন যুগের দার্শনিক প্লেটো, সক্রেটিস, এরিস্টটলের মধ্যেও পাই। আবার এই লব্ধ জ্ঞানও লালনের মতে পরিবর্তিত৷ আজকাল আধুনিক দর্শনেও আমরা এটি পড়ি যে, মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল জ্ঞানই পরিবর্তনশীল অর্থাৎ চূড়ান্ত সত্য নয়। লালনও আধুনিক এ দর্শন চর্চা করতেন। তিনি এটিও বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের দৈহিক মন এবং আত্মার মধ্যে ফারাক বিদ্যমান। দৈহিক মন যে নারীদেহ সম্ভোগে আগ্রহী আত্মায় সেই নারীদেহে একইকাজের বিষয়ে পাপবোধ হয়। মানুষের মন-মস্তিষ্কের এই দ্বিচারিণী স্বভাব লালনকে ভাবিয়েছিল। লালন উপলব্ধি করেছিলেন মাঝেমাঝে দেহ স্পর্শে দেহ জেগে উঠলেও মন জেগে ওঠে না!
লালনকে বাঙালী বাউল সাধকরাই বর্তমানকালে অবাধ যৌনাচারী এক বাউল ভাঁড়ে পরিণত করেছে। কারণ, এদের বেশিরভাগই পেটের দানার বন্দোবস্ত করতে লালনকে ব্যবহার করতে এসেছে। লালন যে দার্শনিক ছিলেন, তিনি যে যৌক্তিক প্রশ্নানুসন্ধান করতেন, বস্তু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের চর্চা করতেন এসব এই মেকি বাউল-সাধকরা জানে না। তারা শুধু গাল-গল্প, ছবি-সিনেমায় লালনের নামে যৌনাচার, দেহসাধন ইত্যাদি বিকৃত কিছু বিষয় দেখেছে এবং মনে করেছে এটাই ছিল লালনের সাধনা। আর যারা শিক্ষিত তারা জেনেছেন লালন একজন মানবতাবাদী বাউল। কিন্তু, লালন যে একজন দার্শনিক ছিলেন, তাঁর দর্শন চিন্তার স্বরূপ কি ছিল এসব নিয়ে আমাদের কেউই তেমন ওয়াকিবহাল না। তাই বলি, যারা আজকাল লালনের পক্ষে দাঁড়ান তারাই বা লালনকে কতোটুকু জানেন? লালন তো ধর্মগ্রন্থ না, বেদবেদান্তের শ্লোক-মন্ত্র না, যে আস্তিক-নাস্তিক বাতিল বললেই সে আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকবে। লালন একটা দর্শন, চিন্তার পদ্ধতি৷ লালন আপনাকে স্বর্গ-বেহেশতের মাহাত্ম্য বোঝাতে বা সর্বধর্মের সমন্বয় করতে আসেননি। লালনের দর্শন মানে যুক্তির সঙ্গে মিলছে না এমন বিষয় নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা, প্রশ্ন করা। তা ধর্ম হলেও, অধর্ম হলেও। লালনের দর্শনে যুক্তি, প্রশ্ন, প্রয়োগ এগুলোরই ছিল প্রাধান্য। তিনি মনে করতেন প্রশ্ন করা দোষের কিছু নয়; বরং প্রকৃত উত্তর পাওয়ার উত্তম পন্থা হতে পারে যৌক্তিক প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাওয়া। নারী, দেহসাধনা, কাম নদী, হেনতেন এইগুলা লালনের নামে মানুষ নিজেদের স্বার্থে সংযোজন করেছে। এই বিষয়গুলোর কারণেই আজকে লালনকে নিয়ে বিরোধিতা হচ্ছে। লালনের বস্তু পর্যবেক্ষণ করে জ্ঞানার্জন নিয়ে অতো কথা শুনি না যতো কথা শুনি লালন নারীসঙ্গ করতেন না করতেন না এ নিয়ে৷ লালনের প্রকৃত দর্শন আমাদের আলোচনায় অবহেলিত, অনুপস্থিত।
লেখক: কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই