কালজয়ী চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
২ মে ২০২৪ ১৬:৩৬
“যখন আপনি বড় ভুলের মুখোমুখি হবেন তখন আপনাকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে এবং তারা তখন আপনার মনকে বিরক্ত করতে অক্ষম হবে।”
-লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
বহুমুখী ইউনিভার্সাল প্রতিভাধর সুবিদিত ভাস্কর, স্থপতি, সঙ্গীতজ্ঞ, সমরযন্ত্রশিল্পী, বিংশ শতাব্দীর বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্য জনক ও ইতালীয় রেনেসাঁসের কালজয়ী চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র ৫০৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জন্ম ফ্লোরেন্সের অদূরবতী ভিঞ্চি নগরের এক গ্রামে ১৪৫২ সালের ১৪/১৫ই এপ্রিল। তার বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে মোনালিসা, দ্য লাস্ট সাপার অন্যতম। তার শৈল্পিক মেধার বিকাশ ঘটে খুব অল্প বয়সেই। আনুমানিক ১৪৬৯ সালে রেনেসাঁসের অপর বিশিষ্ট শিল্পী ও ভাস্কর আন্দ্রেয়া ভেরোচ্চিয়োর কাছে ছবি আঁকায় ভিঞ্চির শিক্ষানবিশ জীবনের সূচনা। এই শিক্ষাগুরুর অধীনেই তিনি ১৪৭৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষত চিত্রাঙ্কনে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ১৪৭২ সালে তিনি চিত্রশিল্পীদের গিল্ডে ভর্তি হন এবং এই সময় থেকেই তার চিত্রকর জীবনের সূচনা হয়।
১৪৭৮ সাল থেকে ১৫১৬-১৭ ও ১৫১৯ সাল অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রসারিত এবং বিভিন্ন পর্বে বিভক্ত, এক দীর্ঘ ও অক্লান্ত কর্মসাধনার জীবন তার। গির্জা ও রাজপ্রাসাদের দেয়ালে চিত্রাঙ্কন এবং রাজকীয় ব্যক্তিবর্গের ভাস্কর্য নির্মাণের পাশাপাশি বেসামরিক এবং সামরিক প্রকৌশলী হিসাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের প্রয়োগ, অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা, জীববিদ্যা, গণিত ও পদার্থবিদ্যার মতো বিচিত্র সব বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি গভীর অনুসন্ধিৎসা প্রদর্শন করেন এবং মৌলিক উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দেন।
আনুমানিক ১৪৮২ সালে তিনি মিলান গমন করেন এবং সেখানে অবস্থানকালে তার বিখ্যাত দেয়াল চিত্র দ্য লাস্ট সাপার অঙ্কন করেন। আনুমানিক ১৫০০ সালে তিনি ফ্লোরেন্স ফিরে আসেন এবং সামরিক বিভাগে প্রকৌশলী পদে নিয়োগ লাভ করেন। এই সময়েই তিনি তার বিশ্বখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা অঙ্কন করেন। জীবনের শেষকাল তিনি ফ্রান্সে কাটান।
অনেক ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত লিওনার্দোকে “ইউনিভার্সাল প্রতিভা” বা “রেনেসাঁ মানব” আখ্যা দিয়েছেন।
জীবনী
কৈশোর (১৪৫২-১৪৬৬)
লিওনার্দোর জন্ম হয়েছিল ১৪৫২ সালের ১৪/১৫ এপ্রিল রাত্রি ত্রিপ্রহরে। তুসকান এর পাহাড়ি এলাকা ভিঞ্চি তে, আর্নো নদীর ভাটি অঞ্চলে। তিনি ছিলেন ফ্লোরেন্সের এক নোটারি পিয়েরে দ্য ভিঞ্চির এবং এক গ্রাম্য মহিলা ক্যাটরিনার সন্তান। তার মা সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত দাসী ছিলেন। আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে লিওনার্দোর নামে কোন বংশ পদবী ছিল না। “দ্য ভিঞ্চি” দিয়ে বোঝায় তিনি এসেছেন ভিঞ্চি নগরী থেকে। তার পুরো নাম লেওনার্দো দি সের পিয়েরো দা ভিঞ্চি (ইতালীয় Leonardo di ser Piero da Vinci) এর অর্থ হল পিয়েরোর পুত্র লিওনার্দো এবং সে জন্মেছে ভিঞ্চিতে।
লিওনার্দোর জীবনের প্রথম অংশ বিষয়ে খুবই অল্প জানা গিয়েছে। তার জীবনের প্রথম ৫ বছর কেটেছে আনসিয়ানো-র একটি ছোট্ট গ্রামে। তারপর তিনি চলে যান ফ্রান্সিসকো তে তার পিতা, দাদা-দাদী ও চাচার সাথে থাকতে। তার পিতা অ্যালবিরা নামে এক ষোড়শী তরুণীকে বিয়ে করেছিল। সে লিওনার্দোকে অনেক স্নেহ করত। কিন্তু অল্প বয়সেই সে মৃত্যবরণ করে। এর পরে কৈশোর জীবন বিষয়ে লিওনার্দো দুটি ঘটনার কথা লিপিবব্ধ করে গিয়েছেন। প্রথমটি হল — একবার একটি চিল হঠাৎ করে আকাশ থেকে নেমে তার দোলনার উপর দিয়ে যাবার সময় তার মুখে এর লেজের পালক বুলিয়ে যায়। লোকজন এই ঘটনাকে তার ভবিষ্যৎ জীবনের সফলতার লক্ষণ হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনা হল — তিনি ছোটবেলায় একবার এক পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি একটা গুহা আবিষ্কার করেছিলেন। গুহাটা ছিল অন্ধকার, আর তার মনে হচ্ছিল এর ভিতরে নিশ্চয় কোনো অতিকায় দৈত্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু তার অদম্য কৌতূহলের কারণে তিনি এই গুহায় কী আছে, তা খুঁজেও দেখেছিলেন।
ষোড়শ শতাব্দীর জীবনী লেখক ভাসারি রেঁনেসার চিত্রশিল্পীদের জীবনী লিখেছিলেন। লিওনার্দোকে নিয়ে তিনি তার বর্ণনায় বলেছেন-লিওনার্দো-র বাবা কে স্থানীয় একজন লোক বলেছিল তিনি যেন তার ছেলেকে একটি ছবি আঁকতে বলেন। লিওনার্দো এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে একটি ছবি এঁকেছিল। এতে ছিল একটি সাপের মুখ থেকে আগুন নির্গত হচ্ছে। ছবিটি এত সুন্দর হয়েছিল যে পিয়েরো তা স্থানীয় চিত্র ব্যবসায়ীদের কাছে তা বেশ ভাল দামে বিক্রি করেছিলেন। আর যে লোকটি তাকে এ ছবিটি আঁকিয়ে নিতে বলেছিল, তিনি তাকে একটি হৃদয়ের ছবি আঁকা ফলক উপহার দিয়েছিলেন।
শিক্ষা
ভিঞ্চি কোন রকম আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া গ্রহণ করেননি। তার লেখাপড়ার সবকিছুই ঘরোয়াভাবে। তার ছিল প্রকৃতির প্রতি ভীষণ টান। এজন্য তিনি বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে কাটাতে পছন্দ করতেন। ১৪৬৬ সালে লিওনার্দোর বয়স যখন ১৪ তখন তাকে ডেল ভেরোচ্চির কাছে শিক্ষানবিশ হিসেবে পাঠানো হয়, এরপর দ্রুতই তার প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। বলা হয়ে থাকে ভিঞ্চির “দা ব্যাপ্টিজম অফ ক্রাইস্ট” এতটাই সুনিপুণ হয় যে তা দেখার পর ভেরোচ্চি জীবনের জন্য আঁকা ছেড়ে দেবার পণ করেন।
ভ্যারিচ্চিও-র কাজে যোগদান (১৪৬৬-১৪৭৬)
১৪৬৬ সালে লিওনার্দোর বয়স যখন ১৪, তখন তিনি ভ্যারিচ্চিও (Verrocchio)-র কাছে শিক্ষানবীশ হিসেবে যোগ দেন। ভ্যারিচ্চিও-র পুরো নাম “আন্দ্রে দাই সায়ন”, তিনি ছিলেন সে সময়ের একজন সফল চিত্রকর। ভ্যারিচ্চিও-র কর্মস্থলে তৎকালীন গুণী মানুষদের সমাগম হত। আরও নামকরা যেসব শিল্পী ভ্যারিচ্চিও-র তত্ত্বাবধানে কাজ করত বা তার ওয়ার্কশপে যাতায়াত করত, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন গিরল্যান্ডিও (Ghirlandaio), পেরুগন (Perugino), লরেঞ্জো দাই ক্রিডি (Lorenzo di Credi)।
এখানে কাজ করে লিওনার্দো হাতে কলমে প্রচুর কারিগরি জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তার সুযোগ হয়েছিল কারুকার্য, রসায়ন, ধাতুবিদ্যা, ধাতু দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানানো, প্রাস্টার কাস্টিং, চামড়া দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানানো, গতিবিদ্যা এবং কাঠের কাজ ইত্যাদি শেখার। তিনি আরও শিখেছিলেন দৃষ্টিনন্দন নকশাকরা, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি এবং মডেলিং। ভ্যারিচ্চিও-র ওয়ার্কশপে বেশিরভাগ কাজ করত তার অধস্তন কর্মচারীরা। ভাসারীর বর্ণনানুসারে লিওনার্দো ভ্যারিচ্চিওকে তার “ব্যাপ্টিজম অব ক্রাইস্ট” ছবিটিতে সাহায্য করেছিলেন। ছবিটিতে দেখানো হয়েছে একটি দেবদূত যীশুর লাঠি ধরে আছে। ছবিটি ভ্যারিচ্চিওকে এতটাই অভিভূত করেছিল যে তিনি নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কখনো তুলিই ধরবেন না, ছবিও আঁকবেন না। তবে খুব সম্ভবত ভাসারি ঘটনাটি অতিরঞ্জিত করেছিলেন। সূক্ষ্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ ছবিটির যে সব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তা হল- এটি বিশেষ পদ্ধতিতে তৈল রং দিয়ে আঁকা। ভ্যারিচ্চিও বেশ কয়েকটি কাজে লিওনার্দো মডেল হিসেবে ছিলেন। যেমন- “ডেভিড” চরিত্রে “দি বার্জেলো” ( Bargello) নামক ব্রোঞ্জ মূর্তিতে, “আর্চঅ্যাঞ্জেল মাইকেল” হিসেবে “টোবিস এন্ড অ্যাঞ্জেল“(Tobias and the Angel) এ।
১৪৭২ সালে ২০ বছর বয়সে লিওনার্দো “গিল্ড অব সেন্ট লুক”-এর পরিচালক হবার য্যোগ্যতা অর্জন করেন। এটি চিকিৎসক এবং চিত্রকরদের একটি সংঘ। কিন্তু তার বাবা তাকে নিজেদের ওয়ার্কশপের কাজে লাগিয়ে দেন। ভ্যারিচ্চিওর সাথে চুক্তি অনুসারে তিনি তার সাথেও কাজ চালিয়ে যান। লিওনার্দোর নিজের হাতে তারিখ দেওয়া সবচেয়ে পুরানো ছবি হল আর্নোভ্যালি, তারিখটি হল ৫ই আগস্ট ১৪৭৩।
পেশাগত জীবন (১৪৭৬-১৫১৩)
আদালতের নথি থেকে দেখা যায় একবার লিওনার্দো সহ আরও ৩ জন যুবককে সমকামীতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং তারা বেকসুর খালাসও পেয়েছিল। এরপর ১৪৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি কি করেছিলেন, কোথায় ছিলেন তার কিছুই জানা যায়নি। ধারণা করা হয় পরবর্তিতে ১৪৭৮ থেকে ১৪৮১ পর্যন্ত লিওনার্দো তার নিজের ওয়ার্কশপে কাজ করেছেন। তিনি ১৪৭৮ সালে চ্যাপেল অব সেন্ট বার্নার্ড ও “অ্যাডোরেশন অব দি ম্যাগি” এবং ১৪৮১ সালে “মঙ্ক অব সান ডোনাটো এ স্কাপিটো” আঁকার দায়িত্ব পান।
ভাসারির মতে লিওনার্দো সে সময়ের সেরা সংগীতজ্ঞ ছিলেন। ১৪৮২ সালে তিনি ঘোড়ার মাথার আকৃতির একটি বীণা তৈরি করেছিলেন। লরেঞ্জো দ্য মেডিসি (Lorenzo de’ Medici) লিওনার্দো-র হাতে এই বীনা উপহার স্বরূপ মিলানের ডিউক লুদোভিকো এল মোরো (Ludovico il Moro) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন শান্তিচুক্তি নিশ্চিত করার জন্য। এ সময় লিওনার্দো ডিউকের কাছে একটি চিঠি লিখেন, যাতে ছিল তার উদ্ভাবিত বিভিন্ন চমকপ্রদ যন্ত্রের বর্ণনা। তিনি এ চিঠিতে নিজের চিত্রশিল্পী পরিচয়ের কথাও লিখেছিলেন।
লিওনার্দো ১৪৮২ থেকে ১৪৯৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মিলানে কাজ করেছেন। এখানে তিনি ভার্জিন অব দ্যা রকস্ এবং দ্যা লাস্ট সাপার ছবি দুটি আঁকার দায়িত্ব পান। ১৪৯৩ থেকে ১৪৯৫ এর মধ্যে তার অধিনস্তদের মাঝে ক্যাটরিনা নামে এক মহিলার নাম পাওয়া যায়। ১৪৯৫ সালে এ মহিলাটি মারা যান। সে সময় তার শেষকৃত্যের খরচ দেখে ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন লিওনার্দোর মা।
চিত্রকলা
সালভাতোর মুন্ডি and the last supper Painting-The-Last-Supper-by-Leonardo-Da-Vinci-Oil-Painting.webp The da Vinci code টেমপ্লেট:Legend l.ts.p.d.vinci ইতিহাস গড়া যিশুখ্রিষ্টের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি এক হাত তুলে রয়েছেন (আশীর্বাদ দেওয়ার ভঙ্গি) এবং অন্য হাতে একটি স্ফটিকের গোলক। ‘সালভাতোর মুন্ডি’—শব্দের অর্থ ‘বিশ্বের পরিত্রাতা’।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ১৫০৫ সালের কিছু পরে ছবিটি এঁকেছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ভিঞ্চি। অনেক দিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার পর ২০০৫ সালে ছবিটি প্রকাশ্যে এলে ব্যাপক শোরগোল পড়ে যায়। ২০১৩ সালে ছবিটি ১২ কোটি ৭৫ লাখ ডলারে কিনে নেন রুশ সংগ্রাহক এবং ফুটবল ক্লাব এএস মোনাকোর মালিক দিমিত্রি রাইবলোভেলভ।
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির কিছু শিল্পকর্ম
দ্যা লাস্ট সাপার
১৪৯৫-১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বিচিত্র ধর্মী নিরীক্ষার নেশায় ফ্রেসকোর বদলে প্লাস্টারের তেলে গোলা রং লাগিয়ে টেম্পেরায় মিলানের সান্তা মারিয়া দেল্লা গ্রেৎসী গীর্জার ভোজনশালার দেয়ালে এই চিত্রটি আঁকেন। উচ্চ রেনেসাঁ যুগে প্রথম ফিগার কম্পোজিশনের এই চিত্রটির উপজীব্য বাইবেল থেকে নেয়া। চিত্রটিতে যীশু তাঁর ১২ জন শিষ্য নিয়ে এক সান্ধ্য ভোজে বসেছেন। তাঁরা সাদামাটা এক বড় কক্ষে লম্বা টেবিলে উপবিষ্ট। যার মধ্যস্থানে শান্ত, সৌম্য, অবিচল ও নিশঙ্ক মূর্তি যীশু। সকলের সামনে খাবার সাজানো। উপরে ছাদের অংশ বিশেষ এবং দুপাশের দেওয়ালে সকল কিছুতে বৈজ্ঞানিক পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহারে ক্রমান্বয়ে দূরে অপসৃয়মান। যিশুর পিছনে একটি খোলা দরজা ও দু’টি জানালা রয়েছে। যেগুলোর মধ্য দিয়ে বহু দূরের পাহাড়-পর্বত দৃশ্যমান।
মানব ত্রাতা ঈশ্বরের পুত্র যিশু অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন। তাই ক্রুশবিদ্ধ হবার পূর্বেই তিনি তাঁর নিয়তি জানতে পারেন। যীশু গম্ভীর ও হাত প্রাসারিত করে যখন বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে একজন মাত্র কয়েকটি মুদ্রার জন্য আমাকে শত্রæর হাতে সমর্পণ করবে।” সেই আকস্মিক ঘোষনার পর মুহূর্তের দৃশ্যই ‘লাস্ট সাপার’। ১২ জন শিষ্যের মধ্যে ৩ জন করে ৪ টি ভাগে ভাগ করে পরস্পরের সাথে ‘সেটি কি আমি!’ অভিব্যাক্তিকে প্রতিপাদ্য করে শিল্পী অত্যন্ত দক্ষতাঁর সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাছাড়া দিনের শেষে বিলীয়মান আলো প্রতিভাত হয়ে যিশুর চারদিকে এক জ্যোতির্ময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সেই সাথে বিশ্বাসঘাত, ঘৃণ্য পাপী জুডাসের কালো ছায়ায় আবৃত মুখমন্ডল ও হাতে টাকার থলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে সমগ্র চিত্রপটে শিল্পী যতগুলো চরিত্র ব্যবহার করেছেন তাদের মুখের অভিব্যাক্তি কোথাও ভাবমূর্তির ধারাবাহিকতা নষ্ট করেনি।
২. ভার্জিন অব দ্যা রকস্
১৪৮৫ সালের দিকে লিওনার্দো প্রথমবার মিলানে অবস্থানকালে ৭৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৪৩ ইঞ্চি প্রস্থ বিশিষ্ট এই বিখ্যাত চিত্রটি অঙ্কন করেন। এর দুটি সংস্করণ। বর্তমানে একটি সংস্করণ প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এ চিত্রের আঙ্গিক মূলত তাঁর পূর্ববতী রেনেসাঁ শিল্পী ফ্রা ফিলিপ্পো লিপ্পির অনুসারে অঙ্কিত। এর কম্পোজিশনটি প্রচীনপন্থী পিরামিডাকৃতির। বহির্রেখার প্রয়োগ এখানে প্রায় তিরোহিত। চিত্রটিতে মাতা মেরি আর শিশু যিশু বসে আছেন- নিকটে ছোট্ট জন এবং একজন স্বর্গীয় দূত। চতুর্দিকে গুহা আর কালো কালো পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ঝর্ণার উজ্জ্বল নীল ও প্রাণ রসে ভরপুর গাছপালার উজ্জ্বল সবুজ রং দেখা যায়।
শিলাবেষ্টিত এক রহস্যময় পরিবেশে কুমারী মাতা একটি পাথরের বেদিতে বসে আছেন। তাঁর পায়ের কাছে শিশু সেন্ট জন। মেরির ডান হাত গভীর স্নেহে ও আশির্বাদে জনের পিঠে আরোপিত হয়েছে। অপর হাতটি আশির্বাদের ভঙ্গিতে শিশু যিশুর প্রতি প্রসারিত। এমন স্নিগ্ধ ও পবিত্র মাতৃমূর্তি ইউরোপীয় চিত্রে বড় একটা দেখা যায় না। একটু দূরে মাটিতে বসে আছেন এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য ও পবিত্রতা মন্ডিত দেবদূত এবং সম্মুখে উপদেশ দানের ভঙ্গিতে শিশু যিশু। পিছনের দিকে গভীর বর্ণের ভেঙে যাওয়া টুকরো টুকরো পাথর। আলো এসে এই পাথরের টুকরোগুলোর মধ্যে পড়ে এক মায়াময় রহস্য জালের সঞ্চার করেছে।
৩. মোনালিসা
১৫০৩-১৫০৬ সালে শিল্পী মিলান থেকে ফ্লোরেন্সে প্রত্যাবর্তনের পর তেল রঙে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এই প্রতিকৃতিটি আঁকেন। বিশ্বের এ শ্রেষ্ঠ ছবিটির মধ্যে মোনালিসার পাতলা ও কোমল অধরে রয়েছে ক্ষীণ রহস্যপূর্ণ হাসি। জীবন্ত এ নারী শরীরের সমস্ত পরিপূর্ণতা ও ওজন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই সাথে চিত্রটির উপস্থাপন এমনভাবে করা হয়েছে যে মোনালিসার দৃষ্টি সরাসরি দর্শকের দিকে নিবদ্ধ। তাঁর হাত দুটি অংকনেও শিল্পী বাস্তবতাঁর সাথে আরোপিত রূপ সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন। এছাড়াও চিত্রের পশ্চাৎপটে রকস্ পর্বত, ভূমি, জলস্রোত, পরিপ্রেক্ষিতের গভীর দূরত্ব নিয়ে সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে।
৪. লেডি উইথ অ্যান আরমাইন
লিওনার্দোর আঁকা এই চিত্রটিতে কোলে বেঁজির মত আরমাইনসহ একজন নারী মূর্তির অবয়ব চিত্রিত। ছবির বাম দিক থেকে তিন-চতুর্থাংশ কোণে দাঁড়ানো নারীর মুখটি তাঁর বাম দিকে রাখা। সেই সাথে তাঁর দৃষ্টি সরাসরি সম্মুখে না নিবদ্ধ রেখে বরং তা ফ্রেমের বাইরে তৃতীয় কোন বিষয়ের উপর নিবদ্ধিত। চুলগুলো মাথার দু’পাশে জড়ানে এবং কালো ব্যান্ড দিয়ে আবদ্ধ করা।
৪. দ্যা ভার্জিন এন্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট অ্যানি এন্ড জন
কাঠ কয়লায় আঁকা এই চিত্রটির দৈর্ঘ্য ১৩৮ সে.মি./১০১ সে.মি.। এতে ভার্জিন মেরির কোলে থাকা শিশু যিশু তাঁর কাকাতো ভাই সেন্ট জনকে ধরে আছে এবং পাশেই সেন্ট অ্যানি মেরির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছেন। সেন্ট অ্যানের পাশে জন হাঁটু গেড়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
৫. সেন্ট জেরোমি ইন দ্যা ইয়ার্নউইন্ডার
এই চিত্রটি সেন্ট জেরোমিকে ভক্তিমূলক এক জীবন যাপনে দেখানো হয়েছে। জেরোমি ডান হাতে একটি পাথর ধরে আছেন। তাঁর গলার এবং কাঁধের পেশীগুলো স্পষ্ট, যা শিল্পীর শারীরবৃত্তীয় অংকনের ব্যবহারকে ইঙ্গিত করে। সামনে সর্পিল লেজ বিছিয়ে হিংস্রতাহীন একটি সিংহ শুয়ে আছে। বাম দিকে পটভূমিতে দূরে পাহাড় ও ঘাস আবৃত ভূমি দৃশ্যমান।
৬.The Virgin and Child with Saint Anne
এই ছবিটিতে শিশু যিশু একটি মেষশাবক নিয়ে ক্রীড়ারত। পিছনের দিকে ম্যাডোনা ও সেন্ট অ্যানি বাৎসল্য রসে আপ্লুত হয়ে এই মধুর দৃশ্য উপভোগ করছেন। ১৫০৩ সালের দিকে আঁকা এটি পেইন্টিংটি ভিঞ্চির একটি অসমাপ্ত পেইন্টিং।
৭. এ্যামব্রায়ো ইন দ্যা উম্ব
সাদা ও ব্রাউন পেপারে কালি কলমে এ চিত্রটি অঙ্কিত হয়েছে। শিল্পী এখানে রেখার ব্যবহারে অত্যন্ত দক্ষতা দেখিয়েছেন। মাতৃগর্ভে ভ্রুনের যে অবস্থান তিনি তা অত্যন্ত নিপুণতাঁর সাথে চিত্রিত করেছেন। শিশুটির অবস্থান দেখে মনে হয় তা একটি ছেলের। ভাবতে অবাক লাগে যে, শরীরতত্ত্ব নিয়ে নির্ধারিতভাবে আলোচনার বহু পূর্বেই মানব শিশুর জন্মের রহস্য অনুধাবন করার জন্য তিনি এই চিত্রটি অঙ্কন করেছিলেন।
প্রকৌশল এবং উদ্ভাবন
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার জীবদ্দশায় প্রকৌশলী হিসেবেও অনেক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। লুভোডিকো মুরো নামক এক ব্যক্তিকে তিনি এক চিঠি দিয়ে দাবি করেছিলেন যে তিনি একটি শহরের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার জন্য সয়ংক্রিয় কিছু যন্ত্র আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। তারপর যখন তিনি ভেনিসে স্থানান্তরিত হলেন, তখন সেখানে তিনি এক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে চাকরি পান। যেখানে তিনি তার উদ্ভাবনী শক্তির পূর্ন বিকাশ সাধন করেন। শহরকে বহিরাগত আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য একটি স্থানান্তর যোগ্য ব্যারিকেট তৈরিতে সক্ষম হন যার ফলে তিনি অনেক খাতি অর্জন করেন। লিওনার্দো তার পত্রিকায় বিভিন্ন বাস্তব এবং অবাস্তব যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছিলেন। যার মধ্যে রয়েছে নানা রকম বাদ্যযন্ত্র , একটি যান্ত্রিক সৈন্য, হাইড্রোলিক পাম্প, ডানার মর্টার শেল এবং একটি বাষ্প কামান।
তিনি তার জীবনের একটি বড় সময় উড্ডন সক্ষম যন্ত্র তৈরিতে ব্যয় করেন। তিনি তার জীবদ্দশায় উড়তে সক্ষম এরকম যন্ত্র ডিজাইনে ব্যস্ত ছিলেন। তারই প্রদত্ত ডিজাইনে বর্তমানে আধুনিক বিমান নির্মাণ সক্ষম হয়েছে।
শেষ জীবন, ১৫১৩ থেকে ১৫১৯
সেপ্টেম্বর ১৫১৩ থেকে ১৫১৬ পর্যন্ত অধিকাংশ সময় তিনি রোমে দশম পোপ এর অধীনে কাটিয়েছিলেন। ১৫১৫ সালের ১৫ অক্টোবর যখন রাজা ফ্রান্সিস ১ম মিলান দখল করলেন তখন লিওনার্দো তার অধীনে কাজ শুরু করেন। তিনি তখন রাজার বাসভবনের পাশেই “ক্লস লুইস” নামক ভবনে বসবাস করতে শুরু করলেন যেখানে তিনি তার জীবনের পরবর্তী ৩ বছর অতিবাহিত করেন।
লিওনার্দো ১৫১৯ সালের ২রা মে ফ্রান্সের “ক্লস লুইস” ভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন এক ক্ষণজন্মা কালজয়ী পুরুষের জন্ম হয়েছিল, যিনি ৫০৫ বছর আগেই রেখে গেছেন অগণিত আধুনিক চিন্তা। তাঁকে মানুষ আজও স্মরণ করে শ্রদ্ধার সঙ্গে। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
কালজয়ী চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান