মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার
৩ মে ২০২৪ ১৯:১৩
বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের বিশিষ্ট একটা অবস্থান আছে। ছন্দের ছলে উপমা-উৎপ্রেক্ষার অলংকরণে হাস্য-রসাত্মক ও বাস্তবতা-ঘনিষ্ঠ বিষয়ের অবতারণা করে ছড়ায়-কবিতায় ঢেলে সাজানোতে তার জুড়ি মেলা ভার। তার এক বিখ্যাত কবিতা “বিষম চিন্তা” ছেলেবেলায় পড়েনি এমন ষাটোর্ধ্ব পাঠক খুব কমই পাওয়া যাবে। ছন্দের তালে তিনি বলেন, “মাথায় কত প্রশ্ন আসে/ দিচ্ছে না কেউ জবাব তার-/ সবাই বলে মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার”। সবার ধমক খেয়ে কবি মোটেই বিচলিত না হয়ে বলছেন, “অমন ধারায় ধমক দিলে/ কেমন করে শিখব সব? বলবে সবাই, “মুখ্যু ছেলে” বলবে আমায় “গো-গর্দভ!”
আমাদেরও হয়েছে সেই দশা। প্রতিদিন ঘটে যাচ্ছে কত ঘটনা। রং-বেরঙের কত কাহিনীতে মুখরিত হচ্ছে চারিদিক। সুইট টকারদের মধুর বচনে উছলে উঠছে দেহ মন, প্রতিশ্রæতির নহরে হৃদয় সিক্ত হচ্ছে অনুক্ষণ। সার্কাসের মত কত চিত্র, কত ক্যারিশমা বিনে পয়সায় দেখে বুঁদ হয়ে থাকছে এ মন। ছলনা-চাতুরী-প্রতারণার স্মার্টনেস দেখে রীতিমত ভীমড়ি খেয়ে পড়তে হচ্ছে। পৈশাচিকতা-প্রতি হিংসা-বর্বরতার দগদগে আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হতে দেখছি কত কত প্রাণ। ভালোবাসার নামে ধোকাবাজী, নীতি-নৈতিকতার নামে বাটপারি আর মূল্যবোধের নামে মূল্যপাতের কত মহড়া দেখছি আজকাল। দেখে-শুনে মাথায় কত শত প্রশ্ন জাগে। কোন উত্তর পাওয়া যায় না। বরং প্রশ্ন করলেই সোডার বোতল খোলার মত ফোঁস করে ওঠে অনেকে। একটু অনুসন্ধানী হলে গলা চিপে ধরে। খোলা মনে জানতে চাইলে গুষ্টির ঠিকুজি ঘাটাঘাটি করে। অথচ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই, সন্তোষজনক কোন ব্যাখ্যা নেই, শান্তণা সূচক কোন ঘোষণা নেই। আছে ভয়-ভীতির তর্জন-গর্জন, উপেক্ষার গঞ্জনা, পরিহাসের লাঞ্চনা। যারা প্রশ্ন করে তারা পায় বেয়াদবের আখ্যা, তাদের জায়গা হয় কালো তালিকায়, ভাগ্যে জুটে জুতার মালা আর অতি জিজ্ঞাসু হলে প্রাণে জাগে ইন্নালিল্লাহ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সমাজ থেকে প্রশ্ন করার লোক কমে যাচ্ছে, কিছু লোক অভ্যাসগত মিউ মিউ করছে, বাকীরা এদের দেখে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, ঠাট্টা-মশকরা করে মজা নিচ্ছে। তাই কোথাও কোন প্রশ্ন নেই, আছে স্ক্রিপ্টেড প্রশ্নের নামে কীর্তণ-সম্ভাষণ। যেন যাদবের পাটিগণিতের মত এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রশ্ন কাম তেলের অব্যার্থ হারবাল মালিশ।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। রেল লাইন বেঁকে যাচ্ছে। রাস্তার পিচ গলে যাচ্ছে। রেলপাত থেকে ট্রেন ছোট্ট শিশুর মত যখন তখন পড়ে যাচ্ছে। রেলগেটে প্রতিনিয়ত ট্রেন-ট্রাক, ট্রেন-অটো, ট্রেন-বাস দূর্ঘটনা ঘটছে। কেন এমন হচ্ছে? উত্তর নাই। রেলের টিকেট কেন নিমিষেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে, বিমানের টিকেট কেন পাওয়া যায় না অথচ সীট কেন ফাঁকা থাকে? সড়কে কেন ফিটনেস বিহীন বাস সড়কে সদর্পে চলাচল করে? কেন কারো কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠার পরেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এতসব কেন-র কোন উত্তর নেই। মামলার জটে কেন বিচারের বাণী নিরবে-নিভৃতে কাঁদে, কেন সাংবাদিকেরা বাছাবাছি করে নিউজ করে, কেন উদ্দেশ্য নিয়ে কারো পিছু ছুটে আবার আচমকা চুপ মেরে যায়? উত্তর পাওয়া যায় না। কেন বিশেষ বিবেচনায় মুখ চিনে চিনে হঠাৎ হঠাৎ ব্যাংকের জন্ম হয়, কেন এর বিস্তৃতি হয়, কেনই বা মুখ থুবড়ে পড়ে? আর কেনই বা মার্জারের আনুকূল্য পায়। ব্যাংকের টাকা কারা, কিসের বলে সাবাড় করে দেয়, ভল্টের টাকা ব্যাংকের লোকেরাইবা কেন নিজের মনে করে সরিয়ে নিয়ে যায়? প্রকল্পের নামে কারা প্রস্তাব উত্থাপন করে, কারা তা অনুমোদন করে, কেন করে, তারপর তার কি হয়? সেই টাকাই বা পরিযায়ী পাখীর মত নিশ্চিন্তে কিভাবে দেশান্তরি হয়ে যায়? জবাব নেই। অথচ প্রশ্ন করার খায়েসকে ধৃষ্টতা জ্ঞান করে হেনস্তা করার আয়োজনের কমতি নেই।
সড়কের নির্মাণ খরচ কেন এত বেশি, অবকাঠামো নির্মাণে কেন এত সময় ক্ষেপণ? এক পিস বালিশ উঠাতে কেন এত টংকার ঝংকার, কেনাকাটায় কেন এত ভুতুড়ে যোগসাজশ? উত্তর মিলে না, মিলবেও না জানি। সরকারি দপ্তর গুলোর কেনাকাটায় কেন তেলেসমাতি কায়কারবার দেখা যায়, কেন রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়? কেন সোজা পথে সরকারি সেবা পাওয়া যায় না, কেন তা পাওয়া যায় সিণ্ডিকেটের বদান্যতায়? মিথ্যার কেন এত বেসাতি, ডাহা মিথ্যার কেন এত প্রতাপ, কেন গোয়েবলসীয় প্রচার- প্রপাগান্ডার জোয়ারে সত্যবাবু ডীপ কোমায় চলে যায়? কেন এত এত অনিয়ম দেখেও বুদ্ধিজীবীরা শীতনিদ্রায় যায়, কেন আবার হারবাল মালিশের গুণে সরব হয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়? কোন উত্তর নেই। এখানে উত্তর চাওয়াও ধৃষ্টতার শামিল, উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা চরম আহাম্মকি আর উত্তরের জন্য গো ধরে বসে থাকা আত্মহণনের শামিল।
সব শিয়ালের এক ‘রা’ এর মত সবাই কেন এক সাথে হুক্কা হুয়ার সাইরেন বাজায়? তবে কি রাজনীতির সংজ্ঞা পাল্টে গেছে, নাকি মানুষগুলোই সুপার ম্যান হয়ে গেছে? অধিকর্তারা কি হারবাল মালিশে নিজেদের জীবন-যৌবন নি:শেষ করে দিচ্ছে? দল-গোষ্ঠী-সম্প্রদায় কেন তেলের ডিব্বা নিয়ে ঘোরাঘুরি করে? ভার্সিটি-কলেজ-স্কুলের টিচাররা কি পিছিয়ে আছে নাকি দৌড়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে ল্যাজেগোবরে অবস্থা করে ফেলছে? প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নেই আছে এক্সট্রা কারিকুলারের বেজায় আয়োজন। শিক্ষক ছাত্রীকে কেন বাই ভার্চু অফ অথরিটি তার ট্রেড মার্ক রেজিস্টার্ড প্রোপার্টি ভাবে? এসবের কোন উত্তর নেই। পরিবার কেন আজ ভূমিকা রাখার মত জায়গায় নেই? সমাজ শুধুই কেন অনুকূল বাতাসে ছাতা মেলে, তার তলে যতসব পচাগলা ক্যাডারকে ছায়া দেয়? কেন আজ সৃজনশীল কোন কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা নেই? শিল্পাঙ্গণে কেন দুর্গন্ধযুক্তদের ঔদ্ধত্য? চারিদিকে অশ্লীলতার এত জয়গান কেন? মোবাইল বা ডিজিটাল ডিভাইস হাতে অর্ধশিক্ষত মূলত অশিক্ষিত ইউটিউবার, রীল মেকার, টিকটকারদের কেন এত দাপট? তাদের কন্টেন্ট গুলো কেন অযতেœ পরিত্যক্ত পাবলিক টয়লেটের মত এত দুর্গন্ধ ছড়ায়? এর উত্তর নেই। পাওয়ার আশাও নেই।
তাই, আজ সমাজ থেকে প্রশ্ন করার খায়েস কমে গেছে। প্রভুর ভজন-কীর্তণে উচ্চকিত আজ সবাই? যোগ্যদেরকে হটিয়ে-পিটিয়ে-ঝেটিয়ে অযোগ্যরা দখলে নিয়ে নিয়েছে যার যার পছন্দ মত কেদারা। তাই, কোথাও কোন ছন্দপতন নেই, বেসুরো কোন গান নেই। সর্বত্র কোরাসের আওয়াজ। নীতি আজ নির্বাসনে, তাই নীতিবান আজ চরম পরিহাসের পাত্র, সুকুমার রায়ের ভাষায় গো-গর্দভ।
কোথাও কোন বিদ্যা-চর্চার পরিবেশ নেই। স্কুলে খেলাধুলার ফাঁকে ফাঁকে নানামুখী শিক্ষা। কলেজ -ভার্সিটিতে ছাত্র-শিক্ষকের বেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিং-ভাগাভাগি-কাড়াকাড়ি। প্রগতিশীলতার নামে বেহায়াপনার ওপেন ডিসপ্লে আজ দারুণভাবে সমাদৃত। ট্রান্সজেন্ডার আর সমকামিতার নামে সামাজিক ভ্যালু অবলোপন করে নতুন ভ্যালু এড করার কুচকাওয়াজ চলছে। কেউ যেন আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে। কেউ যেন কিছু বাদ দিয়ে কিছু যোগ করে কিছু গুণ করে আর কিছু ভাগ করে একটা যথেচ্ছাচারের মিশ্রণ বানাতে চাচ্ছে। কেন? এরও কোন উত্তর নেই।
নারী প্রগতির নামে কিছু নারীবাদীর দাপটে আজ কতিপয় বাঘা-বাঘা সিংহ-পুরুষের রতি-মতিভ্রম হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার নামে কারা যেন নতুন ব্র্যাণ্ডের সঞ্জীবনী সারিবাদি সালসা গিলাতে চাচ্ছে। একদল যেন বিভেদের-হিংসার-কুটনামীর-ইতরামির পরিচ্ছেদ সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করে সর্বরোগ সক্রিয় রাখায় অতিশয় তৎপর। কিন্তু কেন? কারা তারা? কোন উত্তর নেই।
তাই, সুকুমার রায়ের সেই বিখ্যাত কবিতার মত হাজারো প্রশ্ন নিয়ে মাথা কুটে মরলেও একটিরও উত্তর মেলে না। যদিওবা মেলে তা মেইড বাই গোয়েবলস কোম্পানী। নতুন এই সিরাপ সেবনের আগে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আত্মস্থ করতে হয়। যাতে পুরোনো বস্তাপচা সব আবর্জনা নিমিষেই বের হয়ে যায়। অনেকটা পুরোনো সফটওয়ার আনইন্সটল করে নতুন সফটওয়ার ইন্সটল করার মত। প্রশ্নের উত্তর দরকার? লাভ কি? উত্তর সবার জানা। সেই চেনা সুর, সেই বহুল শ্রæত গান, সেই নায়ক, সেই নায়িকা, সেই ভিলেন সেই রক্ষক-ভক্ষক-রাক্ষস।
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ বসে নেই। উত্তর রেডি করা আছে। হোয়েদার ইউ টেক ইট অর রিজেক্ট ইট। ইট ডাজন্ট মেক এনি সেন্স। নবতর জ্ঞানের পথে আমরা সবাই আজ অভিযাত্রী। সেই পথে কোন প্রশ্নের ঝামেলা নেই। আছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ছবক। প্রশ্নের ঘুণপোকা যাদের মাথায় কুড়কুড় করে বেড়ায় অহরহ তারা পশ্চাৎগামী, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। বন্ধুর পথে এগিয়ে যাওয়ার মত তাদের সামর্থ নেই।
সুকুমার বাবু বেঁচে থাকলে হয়ত তার এই “বিষম চিন্তা”কবিতার মর্ডান ভার্সন লিখতেন। হয়ত কিছু আক্ষেপ করতেন, উপসংহারে কিছু পরামর্শও রাখতেন। আজ কোন বাতিঘর নেই। যারা নামধারী বাতিঘর তারা সময়ের সচল মুদ্রা।
সময়ের পথে কালের যাত্রায় রথের চক্রে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। সেখানে কোন ছলচাতুরী চলে না। সময় বড় নিষ্ঠুর। সঠিক সময়ে সঠিক পথে বাঁক নেবে অবশ্যই। শুধু দরকার আমাদের সৎ প্রয়াস আর সঠিক অভীষ্ট। সে পথে আমাদের যাত্রা শুরু হোক। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এজেডএস