বুদ্ধিবৃত্তির আলাপ
৪ মে ২০২৪ ২০:২১
বুদ্ধিবৃত্তির আলাপ করতে চাইলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলে আসে ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি বাংলায় এসেছে ইংরেজি ‘Intellectual’ শব্দ থেকে। বুদ্ধিজীবী শব্দটি বাংলায় কবে, কখন বা কার সূত্র ধরে এসেছে তার সঠিক তথ্য বা ইতিহাস অবশ্য আমার জানা নেই। তবে এই তথ্যের খোঁজ হয়ত কোথাও না কোথাও পাওয়া যেতে পারে। এই আলাপে আপাতত সেই দিকে আগাচ্ছি না। এখন কথা হচ্ছে, যে শব্দ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সেই বুদ্ধিজীবী শব্দটি আসলে কি এবং এরা কারা?
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের জবানে, “এক প্রস্তাব অনুসারে সকলেই বুদ্ধিজীবী নয়, মাত্র কেউ কেউ বুদ্ধিজীবী। আরেক প্রস্তাব মোতাবেক মানুষ মাত্রই বুদ্ধিজীবী। কেননা একমাত্র বুদ্ধির যাহার অবিসংবাদিত প্রকাশ ভাষা বলেই মানুষ প্রাণীজগতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। তবে কাজের কথা এই, বুদ্ধিজীবীর কাজ সকলেই করেন না।” সুতরাং আমরা যদি মূলত বুদ্ধিজীবীদের কাজ কী এবং কাজের হিসাব ও পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করি তাহলে তার উত্তর হয়ত আরও পরিষ্কার হতে পারে। এই বিষয়ে সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, “বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী বলতে লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রভৃতি উচ্চ ব্যবসায়ী লোকদের বোঝান হয়। তাদের পংক্তিতে শিল্পী, আইন ব্যবসায়ী, চিকিৎসা ব্যবসায়ী প্রভৃতিকেও ধরা হয়ে থাকে।”
কাজ ও ‘জীবী’ শব্দের হিসেবে আমাদেরকে সলিমুল্লাহ খানের প্রথম প্রস্তাবটিই নিতে হয়। যেহেতু ‘জীবী’ শব্দটির সাথে পরোক্ষভাবে একটা ব্যবসায়ীক গন্ধ পাওয়া যায়। তবে দ্বিতীয় প্রস্তাবের যুক্তি থাকলেও যুক্তি খন্ডনে বলা যেতে পারে, সকল মানুষেই বুদ্ধিমান তবে বুদ্ধিজীবী নয়। কেননা বুদ্ধিজীবীতার যে একটা কাজ ও দায়িত্ব থাকে সেটা সকল মানুষ করেন না, কেউ কেউ করেন। এই কেউ কেউই হচ্ছে বুদ্ধিজীবী। আবার আগেই বলেছিলাম যে, ‘জীবী’ শব্দের সাথে যেন একটা ব্যবসায়ীক বা পেশাগত হিসাব-নিকাশ রয়েছে। তাই শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি এরূপের সাথে জড়িত লোকেরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। তাই রাষ্ট্রে এই শব্দটির আলাদা একটা কদর অবশ্য আছে। তবে বুদ্ধিজীবীরা আলাদা কোনো শ্রেণির নয়, এরাও মানুষ। বলা যেতে পারে, প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীই মানুষ তবে প্রত্যেক মানুষ বুদ্ধিজীবী নয়। আবার বিশেষজ্ঞদের মতে, “প্রত্যেক শ্রেণিরই নিজস্ব বুদ্ধিজীবী থাকে।” সেটা থাকতে পারে, কিন্তু মনুষ্য শ্রেণির মত এতটা প্রকট হবে না নিশ্চয়ই। তবে আমার এই আলাপের বিচার অবশ্য মনুষ্য কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
১.
বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেন। অবশ্য তাদের অনেকেই আবার স্বার্থের প্রয়োজনে ও সুবিধার্থেই থাকেন। ক্ষমতার পরিবর্তনে তারা আবার খোলস পরিবর্তনও করে ফেলেন। শাসকের কাছাকাছি থাকা বুদ্ধিজীবীদের কার্যক্রম দেখলে এমন ধারণা হবে তারা যেন শাসক দলের চাকুরীজীবীর ভূমিকা পালন করছেন। শাসক দলের কথা ও কর্মকাণ্ডগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে উনারা প্রচার করবেন। সেখানে ঠিক-বেঠিক, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার অবশ্য তারা করবেন না। প্রয়োজনেই হোক কিংবা সুবিধার সন্ধানে ওনারা তখন বিবেকের চোখ বন্ধ করে রাখবেন। অনেকটাই শাষক দলের দলান্ধ কর্মীগণের ভূমিকা। শাসকের প্রিয়ভাজন হওয়ার দৌড়ে থাকেন।
বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গে আহমদ ছফা বলেছিলেন, “বর্তমান মুহূর্তে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরাই হচ্ছেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রেণি। এরা চিরদিন হুকুম তামিল করতেই অভ্যস্ত। প্রবৃত্তিগত কারণে তারা ফ্যাসিস্ট সরকারকেই কামনা করে। কেননা একমাত্র ফ্যাসিস্ট সরকারই কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী সম্মাণ শিরোপা দিয়ে পুষে থাকে। অল্পসংখ্যক বাছাই করা লোককে দিয়ে নিজেদের প্রচার প্রোপাগান্ডা করিয়ে দেশের জনসমাজের স্বাধীন চিন্তা এবং প্রাণস্পন্দন রুদ্ধ করেই ফ্যাসিবাদ সমাজে শক্ত হয়ে বসে। চিন্তাশূন্যতা এবং কল্পনাশূন্য আস্ফালনই হল ফ্যাসিবাদের চারিত্র্য লক্ষণ।”
আহমদ ছফা বলেছিলেন সেই কবে, যা আজও প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও এসে সেখান থেকে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। যা হয়েছে নিয়মতান্ত্রিক। এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এদেশে অনেক আছে। সাদাকে সাদা আর কালো কে কালো বলার মত বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা নেহাতই অল্প। স্বতন্ত্র অথবা গণমানুষের জন্য কথা বলেন এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা নেহাতই অল্প। যদিও যারা আছেন তারাও খুব নিঃসঙ্গ বা বিচ্ছিন্ন যাকে বলে। বুদ্ধিবৃত্তির বাজারের এই অবস্থা যেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বয়ানের মত, “আজকাল আমাদের দেশে দেখবেন ভালো মানুষেরা বিচ্ছিন্ন। ভালো মানুষের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। তারা একা, পরস্পরকে খুঁজে পায় না। কিন্তু যারা খারাপ, তারা খুব সংঘবদ্ধ। এক শয়তান হুক্কা হুয়া দিলে মুহুর্তে হাজার শয়তান ক্যায়া হুয়া! ক্যায়া হুয়া! করতে করতে এগিয়ে আসে!” আবু সায়ীদ সাহেবের এই বিচার বুদ্ধিবৃত্তির বাজারেও অনেকটা প্রাসঙ্গিক। দলীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এরকম একটা একাট্টা আছে।
২.
দেশের স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আমার ভয় হয়, আবার হাসিও পায়। আহমদ ছফা তার সময়ে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ এর মধ্যে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সমালোচনা করেছেন, এখনকার সময়ে সেভাবে সমালোচনা করলে হয়ত থাকে বুদ্ধিজীবীদের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত নানান রোষানলের শিখার হতে হত। আহমদ ছফা তখনকার সময়েও রোষানলে পড়েছেন, তবে সেটা পত্রিকায় প্রকাশের সময়ে বুদ্ধিজীবীদের নাম নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করে লেখার জন্য সহজেই উল্লেখিত ব্যক্তিদের নিমিত্তে সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাকে। কিন্তু এখনকার সময়ে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার কোনো প্রয়োজন নেই, দেখা যাবে এমনিতেই কত জন নিজের গাত্রদাহ হচ্ছে ভেবে তেড়ে আসেন। কেননা তারা নিজেরাই তো নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী দাবী করেন এবং আসনে বসিয়ে রাখেন। অথচ তাদের আক্রমণাত্মক ভঙ্গি দেখলে মনে হবে অনেকটাই রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়।
হালের বুদ্ধিজীবীদের দেখলে হাসি পায় এজন্য যে, গ্রামে কিছু অলস প্রকৃতির বেকার মানুষ থাকে। কোনো কাম-কাজ নাই। চায়ের দোকানের আড্ডায় নিজেকে মাতিয়ে রাখা, বুদ্ধির নামে মানুষকে এটা সেটা কু-বুদ্ধি দেওয়া, মানুষের ‘পাকা ধানে মই’ দেওয়ার মত ইত্যাদি ইত্যাদি কর্মকাণ্ড করে নিজেকে বুদ্ধিমান হিসেবে জাহির করে। এরাই আবার দেখা যায় গ্রামের যেসব মাতব্বর প্রকৃতির মানুষ আছে তাদের পিছনে পিছনে থাকবে, তোষামোদী করে চলবে, সুবিধা নিয়ে চলবে, মানুষের ক্ষতি করার ধান্দা খোঁজবে এবং নিজের ভুড়ি ভোজের কাছ সাধন করে। যারা তাদের বিষয়ে অবগত তারা অবশ্য তাদেরকে দুষ্টু প্রকৃতির লোক বলেই জানেন। তারপর গ্রামের কিছু বোকা মানুষেরাও নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করে। তারা অনেক সময় মানুষের ভালো করতে গিয়ে খারাপটা করে বসে। ঠিক তেমনি এখনকার স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীদের হাল দেখলে গ্রামের দুষ্টু বুদ্ধিমান ও বোকা প্রকৃতির লোকদের কথা মনে পড়ে যায়।
তবে আর যাই বলেন বুদ্ধিবৃত্তির বাজারে মনে করি বুদ্ধিজীবীদের অনেক সমালোচনা সহ্য করার মত ক্ষমতা থাকা উচিত এবং কৌশলগতভাবে সমালোচনার যৌক্তিক উত্তর বা আলোচনা করা উচিত। আবার কিছু কিছু আলোচনা সমালোচনা হবে যেগুলো কানে না নেওয়াই শ্রেয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে হয় সেখানে মৌনব্রত পালন করা, আর নয়ত কৌশলগত ভাবে এড়িয়ে যাওয়া উচিত (যদি ভালো মনে হয়)।
৩.
পোর্টল্যান্ডের কবি ও অধ্যাপক লং ফেলোর মতে, “বুদ্ধিজীবীরাই দেশের সম্পদ, তারাই দেশের সম্পদ তুলে ধরেন।” আমরা যদি ধারণার গভীরে আঁচ করি তাহলে বলব লং ফেলো সত্যিই বলেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে বর্তমানে আমাদের দেশে কয়জন বুদ্ধিজীবী আছেন যারা গণমানুষের জন্য কথা বলেন? দেশের জন্য কথা বলেন? হয়তো গুটিকয়েক আছেন। কিন্তু যারা আছেন তারা বিচ্ছিন্ন। আবার বর্তমান তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দিকে খেয়াল করলে মনে পড়ে হুমায়ুন আজাদের একটি কথা, “যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।” হুমায়ুন আজাদের এই কথাটি মানতে কেমন লাগলেও এরকমই চলছে প্রায় বর্তমান বুদ্ধিজীবী সমাজ। কিছু কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন। নয়তো আমাদের একেবারেই বুদ্ধিবৃত্তিক পচন ধরতো। কিন্তু কিছু পতন তো আবার অবশ্যই আছে। এই যে বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক হালচাল এটা কি শুধু বর্তমানেই এমন? একটু খেয়াল করলে তার উত্তর পাবেন।
আহমদ ছফার একটি কথা আছে, “বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, তা শুনলে বাঙলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাঙলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।” সুতরাং বলা চলে বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই এমন। অনেকেই আবার নিজস্ব সুবিধার্থে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চান। কেননা অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি খাঁটি কথা আছে, “হাতের দাসত্বের চেয়ে মাথার দাসত্বের বাজার দর বেশি।” কিন্তু তাই বলে বুদ্ধিজীবীদের অবজ্ঞা করা যাবে না। কেননা আগেই উল্লেখ করেছি তারা কোনোভাবে না কোনোভাবেই হোক দেশের সম্পদ এবং দেশকে চিত্রিত করেন। দেশে তাদের একটা কদর অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। রবার্ট বাটন বলেন, “আমরা ইচ্ছে করলে প্রতি বছর মেজর এবং অফিসার তৈরি করতে পারি কিন্তু বুদ্ধিজীবী তৈরি করতে পারিনা।” বুদ্ধিজীবীরা যেমন’ই হোক না কেন, আসলে বুদ্ধিজীবী ছাড়া একটা জাতি প্রায় অচল। তাই তাদের কদর অবশ্যই থাকা উচিত।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস