Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার; এক সাহসী নারীর আত্মাহুতির গল্প

অলোক আচার্য
৫ মে ২০২৪ ১৫:১১

ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার একটি সাহসী নাম। স্বাধীনতা এমন একটি শব্দ যা মানুষের জন্মগত অধিকার। মুক্ত হাওয়া, মুক্ত পরিবেশ এবং বাধাহীন শৈশবে বেড়ে ওঠার সাথে আত্মপরিচয়ে বাঁচতে শেখার নাম স্বাধীনতা। বাংলার ইতিহাসে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর থেকে বাংলার স্বাধীনতা ব্রিটিশের হাতে চলে যায়। আজ আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ব্রিটিশ এবং পরবর্তীতে পাকিস্থানীদের হাত থেকে স্বাধীন হতে বহু জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। যুগে যুগে এসেছে বীর নারী-পুরুষ। যারা স্বাধীনাতর স্বপ্ন দেখেেেছন এবং দেখিয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা এমন একজন নারীর নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও পারব, প্রাণ নিতেও মোটেও মায়া হবে না। কিন্তু নিরীহ জীব হত্যা করতে সত্যি মায়া হয়, পারব না- এই উক্তিটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্মরণীয় নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দারের। পৃথিবীতে যুগে যুগে দেশের জন্য বুকের রক্ত বিলিয়ে দিয়েছেন। আমাদের দেশ পাকিস্থানীদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার আগে অর্থ্যাৎ দেশভাগের আগে ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। তখন ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য বহু আন্দেলানকারী ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে আন্দোলন করেছেন। কিশোর, যুবা, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এই আন্দোলন করেছেন। ক্ষুদিরাম বসু নিজের হাতে বোমা বানিয়ে ট্রেনে হামলা চালিয়েছিলেন সাহেবদের দর্প চূর্ণ করতে। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই বোমায় নিহত হয় নিরীহ ভারতবাসী। সে অপরাধে তার ফাঁসি হয়। এরকম বহু স্বাধীনতাকামী স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষদের স্বাধীনতাকামীদের নামই বেশি শোনা যায়, আলোচিত হয়। নারী স্বাধীনতাকামীদের কথা খুব একটা আলোচনায় আসে না। হয়তো সে সংখ্যা হাতে গোণা বলেই। প্রীতিলতার নাম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে একসাথে গাঁথা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে অনেক বিপ্লবী পুরুষের নাম শোনা গেলেও নারী বিপ্লবীর নাম কমই শোনা যায়। এদের গুটিকয়েকজনের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নামটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে এবং থাকবে। একজন নারী সেই সময়ের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাতৃভূমি মুক্ত করতে, চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে যে আতœাহূতি দিয়েছিল তা আজও মানুষের মনে অম্লান। তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তিনি ছিলেন প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ যা যুগ যুগ ধরে নারীদের অনুপ্রেরণা দেয়, সাহস যোগায়। প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে এবং মৃত্যু ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর।

বিজ্ঞাপন

প্রীতিলতা চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯২৯ সালে ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর দুই বছর পর প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডিস্টিংশনসহ গ্র্যাজুয়েশন করেন। ইডেন কলেজের ছাত্রী থাকাকালে প্রীতিলতা লীলা নাগের নেতৃত্বাধীন দীপালি সংঘের অন্তর্ভুক্ত শ্রীসংঘের সদস্য এবং কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী থাকাকালে কল্যাণী দাসের নেতৃত্বাধীন ছাত্রীসংঘের সদস্য হন। গ্র্যাজুয়েশন করার পর তিনি চট্টগ্রামের নন্দনকানন অপর্ণাচরণ নামক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩০ সালে বাংলাজুড়ে অনেক বিপ্লবী দল সংগ্রামরত ছিল। সেসব দলের সদস্যরা বিশ্বাস করতেন, শুধু সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন দলিলপত্র পাঠ থেকে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হন। প্রীতিলতার এক ভাই মাস্টারদাকে তার বিপ্লবী চেতনা সম্পর্কে অবহিত করেন। প্রীতিলতা সূর্য সেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলের প্রথম মহিলা সদস্য হন। তিনি টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস এবং রিজার্ভ পুলিশ লাইন দখল অভিযানে যুক্ত ছিলেন। জালালাবাদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

বিজ্ঞাপন

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নায়ক মাষ্টারদা সূর্যসেন এর নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। আজকের নারী সমাজে পুরুষতান্ত্রিক যে মনোভাব, যে অত্যাচার তার বিরুদ্ধে প্রীতিলতার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শিক্ষা নেওয়া যায়। দেশের জন্য দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন প্রীতিলতা। যে বছর তিনি শহীদ হন সেবছর পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের সময় তিনি ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করতেন। সেই ক্লাবেন একটি সাইনবোর্ডের লেখা থেকে ভারতীদের প্রতি ব্রিটিশদের ঘৃণা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এই ক্লাবের একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল- ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। এই একটি বাক্য থেকেই বোঝা যায় সাদা চামড়ার সাহেবরা ভারতীয়দের নিন্ম শ্রেণির কোন প্রাণি থেকে ভিন্ন কিছু মনে করতো না। এবং এই উপমহাদেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদাহানীকর। এছাড়াও প্রতি পদে পদে ভারতীয়দের অবমূল্যায়ন করা হতো। এসব অবমূল্যায়ন ক্রমেই মনে গভীরভাবে দাগ কাটতে শুরু করেছিল সমগ্র ভারতবাসীদের মনে। মূলত এই ধরনের চিন্তা ভাবনা স্বাধীনতার স্বাদ আরও বেশি করে মনে গেঁথে বসছিল।

ভিষণ লাজুক স্বভাবের প্রীতিলতার ডাকনাম ছিল রাণী। তার মা তাকে এই নামে ডাকতো। লাজুক স্বভাবের এই মেয়েটিই যে একদিন প্রচন্ড সাহসিকতার সাথে দেশের জন্য জীবন বাজী রাখবে তা ক’জনে ভেবেছিল। প্রখর মেধার অধিকারী হওয়ায় তার পিতা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদারর মেয়েকে ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। ঢাকার ইডেন কলেজে পড়ার সময় বিল্পবী লীলা নাগের সংস্পর্শে আসে। এই লীলা নাগ ওই সময় দীপালি সংঘের সংস্পর্শে আসেন। দীপালি সংঘ ছিল ঢকার বিপ্লবী দল শ্রীসংঘের নারী শাখা। তার বিপ্লবী চেতনা মূলত এখান থেকে প্রভাবিত হয়েছে। একটি বিপ্লবী চেতনা জন্ম থেকেই থাকে। প্রয়োজন কেবল সময় ও সঠিক পথের। বিকশিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে বহু নাম জড়িয়ে রয়েছে। বহু বিল্পবীর রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে ভারত ও পাকিস্থান ও তার অনেক পরে বাংলাদেশ হয়েছে। মাষ্টারদার যোগ্য শিষ্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেরদার ছিলেন। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন চট্রগ্রামের বিপ্লবীদের প্রধান কেন্দ্র ধলঘাটের ঘাঁটিতে মাষ্টারদার সাথে প্রথম দেখা করেন প্রীতিলতা। তার আগে তার বান্ধবী কল্পণা দাশের কাছে মাষ্টারদার সাথে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। এই বান্ধবীই তাকে মাষ্টারদার সান্নিধ্যে আসান ব্যবস্থা করেন। স্কুল জীবন থেকেই প্রীতিলতা তার মনে স্বাধীনতার ইচ্ছা পোষণ করতো। সেটা তাই পড়া বইয়ের তালিকা থেকেই বোঝা যায়। প্রীতিলতা যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী তখন লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি বাঘা যতীন, ক্ষুদীরাম, দেশের কথা আর কানাইলাল পড়তেন। মনে হয় মনে মনে তিনি নিজেকে স্বাধীনতার একজন যোদ্ধা হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন। এই সব বই তাকে প্রীতিলতাকে বিল্পবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। ভেতরে ভেতরে দেশকে শত্রুমুক্ত করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বিশেষ করে বিট্রিশ শাসনের থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর চিন্তা করতে থাকেন। প্রীতিলতার মায়ের ডাকা রাণী নামটি স্বার্থক। কারণ তিনি আজও মানুষের মনে রাণীর মতই বেঁচে আছেন।

প্রীতিলতার মৃত্যুর পর লন্ডণে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কাছে পাঠানো এক রিপোর্টে লেখেন ‘pritilata had been closely associated with if not actually the mistress of the terrorist Biswas who was hanged for murder of inspector Tarini Mukherjee and some reports indicate that she was the wife of Nrmal Sen who was killed while attempting to evade arrest of Dhalghat where captain Cameron fell’

ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের পর পটাশিয়াম সাইনাইড খেয়ে তিনি আত্মাহুতী দেন। কারণ তার কাছে জীবনের থেকে দেশ অনেক বেশি মূল্যবান ছিল। তার কাছ থেকে যেন কোন তথ্য ফাঁস না হয়ে যায় সে কারণেই তিনি তার কাছে থাকা বিষ খেয়ে আতœহত্যা করেন। তার অবশ্য গুলিও লেগেছিল। কিন্তু তার গুলি মৃত্যুর কারণ ছিল না বলে জানানো হয়। একদিন পর তার মৃতদেহ তল্লাশির পর তার কাছ থেকে বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা,রিভলবারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটা হুইসেল পাওয়া যায়। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বিপ্লবী চেতনার যে বিশ্বাস জন্ম দিয়েছেন তা যুগ যুগ ধরে স্বাধীনতাকামী মানুষকে প্রেরণা দিয়েছে। তা আজও প্রবাহমান। বিপ্লবের মৃত্যু হয় না।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অলোক আচার্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার; এক সাহসী নারীর আত্মাহুতির গল্প মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর