ডিএসআইসি সম্মেলন: উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশ রোল মডেল
১০ মে ২০২৪ ১৮:৪৬
গত ৫-৬ মে ‘পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নের পথ অনুসন্ধান’ শীর্ষক দুদিনব্যাপী রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে এক সম্মেলন আয়োজন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও বণিক বার্তা। এই সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিনসহ অনেক অতিথি উপস্থিত ছিলেন। প্রধান অতিথি স্পিকার তার উদ্ভোধনী ভাষনে বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক রাজনীতিসহ নানা সমস্যার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সূচকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য রোল মডেল।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক দেউলিয়া হওয়া, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, দরিদ্রতাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশকে এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি নীতিকাঠামো ঠিক করেছিলেন সোনার বাংলা গড়ার। এখনকার বিশ্বে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তনয়ার নেতৃত্বে এসব সমস্যা মোকাবেলা করছি এখন।’
বিশেষ অতিথির অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসেকা আয়েশা খান বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা বিনির্মাণ, যেখানে জনগণ স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে দেশের আর্থসামাজিক খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘বৈশ্বিক ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে প্রবৃদ্ধি উন্নয়নে বাংলাদেশের শক্তিশালী ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। জনশক্তি, পর্যাপ্ত রফতানি, রেমিট্যান্সের স্বাভাবিক প্রবাহ এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা প্রায় এক দশক ধরে সামগ্রিক অর্থনীতির গতিপ্রবাহকে ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশ আগেই নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, শিগগির স্বল্পোন্নত দেশে রূপান্তর ঘটবে।’ এছাড়া দেশে যে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছে তা তার আলোচনায় উঠে এসেছে।
সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণ এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামাজিক-আঞ্চলিক সংঘাতসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এ সম্মেলন বিভিন্ন দেশের শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের জন্য এক্ষেত্রে একটি কমন প্লাটফর্ম তৈরি করবে।’
সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ কয়েকজন সাবেক গভর্নর উপস্থিত ছিলেন। গভর্নর বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে, কৃষি খাতের উৎপাদন বেড়েছে, শিল্প খাতের উৎপাদন এখন ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও আছে সঠিক পথে ও অর্থনীতিতে এখন একমাত্র সমস্যা মূল্যস্ফীতি। তবে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে না পারাটাও একটি ইস্যু। সরকারের বিনিয়োগ তেমন একটা কমেনি। সামাজিক খাতের বিনিয়োগ বিশেষ করে সুরক্ষা নীতিগুলোর পরিধি বেড়েছে। সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দিতেই এটি করা হয়েছে। এ মুহূর্তে দেশের রাজস্ব ঘাটতি অত বেশি নয়। জিডিপির তুলনায় আমাদের রাজস্ব ঘাটতি এখনো দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্নদের একটি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করেছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে কোনো ধরনের ঋণ দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে রেফারেন্স রেট অনুসারে ব্যাংকের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে। শিগগিরই এটি আরো বেশি বাজারভিত্তিক করা হবে। বর্তমান সুদহার নির্ধারণের পদ্ধতিটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা। পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সুদহার নির্ধারণে ব্যাংকের স্বাধীনতা থাকবে। চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো এটি নির্ধারণ করতে পারবে।
বিনিময় হারের বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘এক্ষেত্রে কিছুটা প্রতিকূলতা আছে। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে আমরা ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছি। পরবর্তী সময়ে এটিও বাজারভিত্তিক করে দেয়া হবে। মুদ্রানীতি প্রণয়ন কমিটিতে আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তারা থাকলেও এখন আমরা বাইরের বিশেষজ্ঞদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছি।’ তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের স্বার্থে আমাদের আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হয়েছে। নিরুৎসাহিত করা হয়েছে কম গুরুত্বপূর্ণ ও বিলাসপণ্য আমদানিতে। পাঁচ মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। এ সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। চার মাস ধরে সরকারের চলতি হিসাব ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে পুরো বছরের চিত্রটি এমন ছিল না। দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট এখনো নেতিবাচক।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ ক্ষয়-এ দুটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে বলে জানান গভর্নর। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি। এক্ষেত্রে শুধু চাহিদা কমাচ্ছি না, বরং জোগান বাড়ানোর লক্ষ্যেও কাজ করছি। কৃষি ও এসএমইতে ঋণের জোগান বাড়ানো হয়েছে। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রেও বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’ তবে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে, আদায়কৃত রাজস্বের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর এক-তৃতীয়াংশ। বাকি দুই-তৃতীয়াংশই পরোক্ষ কর। এর অর্থ হলোধনীদের তুলনায় গরিবদের বেশি কর দিতে হচ্ছে।ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ার বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘বিশেষ বন্ড থেকে ১ লাখ কোটি টাকা তৈরি হয়েছে বলে একজন আলোচক উল্লেখ করেছেন। কিন্তু টাকা তৈরির বিষয়টি এতটা দ্রুততার সঙ্গে হয় না। বন্ডের মাধ্যমে অর্থের সরবরাহ বাড়ার জন্য কয়েক বছর সময় লাগে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ,আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে, ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত যাতে ঋণ পায় সেটি বাংলাদেশ ব্যাংককে দেখতে হবে। মূল্যস্ফীতি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সবকিছুতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে প্রবৃদ্ধি যাতে কমে না যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিষয়ে বলা যায় দেশের আর্থিক হিসাব তো ঋণাত্মক। এর মানে হচ্ছে দেশে বাইরে থেকে অর্থের প্রবাহ আসছে না। আসবে কীভাবে? যদিও না আপনি বিনিয়োগকে আরো আকর্ষণীয় করেন। পুঁজিবাজারের যে অবস্থা তাতেও এফডিআই আসছে না। বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা কমিয়ে আনার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। অর্থনীতিতে ঝুঁকি তো থাকবেই। কিন্তু অনিশ্চয়তা যাতে তৈরি না হয়।মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয় সাধন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন সাবেক গভর্নর ফজলে কবির। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোভিডের সময় যেসব প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল, সেক্ষেত্রে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির কার্যকর সমন্বয় করা হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এরপর গুরুত্ব দিতে হবে প্রবৃদ্ধিকে। মূল্যস্ফীতির হারকে সাড়ে ৯ থেকে ৭ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এটি দরিদ্রদের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। এজন্য আরো বেশকিছু সময় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বহাল রাখতে হবে। তবে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এজন্য আরো বেশকিছু ফ্যাক্টর রয়েছে। সেগুলোকেও কাজে লাগাতে হবে।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব বলেন, ‘শক্তিশালী বেসরকারি খাত ও ব্যবসায়িক গ্রুপ ব্যতীত কোনো দেশই উন্নত হতে পারবে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রবৃদ্ধির জন্য তাদেরকে আমাদের প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে। সেটি হচ্ছে যদি এসব ব্যক্তি নীতিনির্ধারক হয়ে যান তাহলে সবকিছুই নিচের দিকে যাবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি গ্রুপ সবকিছুকেই প্রভাবিত করছে, এমনকি রাজনীতিবিদদেরও। ফলে নীতিনির্ধারকরা যদি নীতি প্রণয়নের বিষয়টি নিজেদের হাতে না নিতে পারেন তাহলে আমি মনে করি আমাদের পক্ষে বিদ্যমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে টাকার মূল্যমান বজায় রাখা, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও ব্যাংক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজের মধ্যে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি ভালোভাবে করতে পারছে কিনা? প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে এটি প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে সবসময়ই কি এটি প্রয়োজনীয়? প্রবৃদ্ধি যদি বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করে তাহলেও কি এটি প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে পারে।’অর্থ বিভাগের সাবেক সচিব ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) প্যানেল আলোচনায় বলেন, ‘সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্রে বরাদ্দগত কিছু বড় ইস্যু রয়েছে। আমাদের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে রাজস্ব আয়ের উদ্বৃত্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মানে হচ্ছে আমাদের রাজস্ব উদ্বৃত্ত না থাকলে উন্নয়ন ব্যয়ের শতভাগই ঋণের মাধ্যমে করতে হবে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থাকা সত্ত্ওে সার ও বিদ্যুতের ভর্তুকির বিপরীতে ২০ হাজার কোটি টাকার ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। এতে সরকারের তহবিল থেকে নগদ অর্থ না গেলেও আর্থিক ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে এর মাধ্যমে বাজারে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থের সরবরাহ বাড়বে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় থাকা সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়লেও ভাতার পরিমাণ বাড়েনি। অন্যদিকে সরকারের পরিচালন ব্যয়ে সামাজিক অবকাঠামোর অবদান কমছে। ভৌত অবকাঠামোতে আমাদের বিনিয়োগের প্রবণতা বেশি। আমি বলছি না যে এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার প্রয়োজন নেই। তবে আমাদেরকে অবকাঠামোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিনে বক্তারা বলেন উন্নয়নের সঙ্গে নৈতিকতার সংযোগ থাকতে হবে, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার চর্চা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর উন্নয়ন অধ্যয়নের কারিকুলাম হতে হবে সামগ্রিক। এ ক্ষেত্রে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগগুলোর উচিত হবে সমন্বিত একটা পাঠ্যসূচি তৈরি করা। অন্যদিকে সরকারকে উন্নয়ন ও গবেষণায় আরো বেশি অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। আমি নিশ্চয়তা দিতে চাই, মানসম্মত ও প্রাসঙ্গিক গবেষণায় অর্থ কোনো সমস্যা নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত দুই দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের চিহ্ন রেখেছে। শিল্প ও সেবা খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে “বাস্কেট কেস’’ থেকে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। যদিও বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে বাংলাদেশকে খাপ খাওয়ানোর জন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বৈচিত্র্য আনতে হবে।’তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এরই মধ্যে প্রধান সামাজিক সূচকগুলোয় উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। যেমন দারিদ্র্য হ্রাস, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, পানি ও স্বাস্থ্যে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। যদিও মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়াই আমাদের শেষ লক্ষ্য নয়।’তিনি বলেন, ‘নীতিগবেষণা, সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও পলিসি ডায়ালগের মাধ্যমে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ বাংলাদেশ সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নে অবদান রেখেছে। এ বিভাগ পলিসিভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের সহযোগিতা এবং সময় উপযোগী গবেষণার মাধ্যমে অবদান রাখে। আমরা তাদের বিশেষায়িত জ্ঞানকে যথাযথ ব্যবহার করতে চাই।’
সমাপনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন অধ্যয়নের পাঠ্যসূচি হতে হবে সামগ্রিক। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ একসঙ্গে বসে প্রয়োজনভিত্তিক কারিকুলাম উন্নয়ন করলে এ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। এখানে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের পাশাপাশি উন্নয়নের প্রভাবও দেখতে হবে।’ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘উন্নয়নকে একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে প্রবৃদ্ধি ও পরিবর্তনকে সামনে আনতে হয়। প্রবৃদ্ধিকে আমরা অর্থনীতিতে ফেললেও পরিবর্তনকে কোথায় ফেলব? এ পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও প্রযুক্তির মতো বিষয়। এতগুলো বিষয় একত্রে উন্নয়ন অধ্যয়নে এসে মিলিত হয়েছে।’তিনি আরো বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন করলাম, কিন্তু ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় আমাদের সড়ক গলে যাচ্ছে। কতটুকু সড়কে কতটুকু বিটুমিন ব্যবহার করব, তাতে ফাঁকি দেব, আর উন্নয়ন উন্নয়ন বলে চিৎকার করব, তা হবে না। উন্নয়নের সঙ্গে নৈতিকতার জায়গাকে সংযুক্ত করতে হবে। উন্নয়নকে তখনই টেকসই করতে পারব, যখন আমরা শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার চর্চা করতে পারব। এ সমন্বয় করতে পারলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তনয়া যা দৃশ্যমান করেছেন, আমরা তা টেকসই করতে পারব।’ হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘আমরা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত নানা বৈশ্বিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছি। এ অবস্থায় নীতি প্রণয়ন ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য উন্নত জীবন প্রদান খুবই কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’তিনি আরো বলেন, ‘সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে উন্নয়ন অধ্যয়নের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশককে আমরা আবিষ্কার করেছি। সেগুলো হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন কৌশলগুলোর ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করে নতুন উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন; সমাজবিজ্ঞানের উত্তর আধুনিক যুগের আদর্শিক সমালোচনার উন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের যুগে নতুন ধারণা, আদর্শ ও তত্ত্বের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ। এটি উন্নয়ন খাতে বৈশ্বিকভাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ ডিগ্রি প্রদানকারী বিভাগও। আমরা এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের জন্য গবেষণাপত্র আহ্বান করেছিলাম। সারা পৃথিবী থেকে ১৭০টি একাডেমিক পেপার আমাদের কাছে জমা পড়ে। তার মধ্যে মাত্র ৩১টিকে আমাদের সুযোগ দিতে হয়েছে।’ তিনিআরো বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন খাতের পেশাজীবীদের জন্য প্রফেশনাল মাস্টার্স অন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ চালু করেছি। অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, অনেক স্কুল অব থট”-এর সমন্বয়ে উন্নয়ন অধ্যয়নের কারিকুলাম সাজানো হয়েছে। ভিশন ২০৪১ অর্জনে আমাদের গবেষণা ও উন্নয়নে আরো বেশি উন্নয়ন করতে হবে। এর জন্য আমাদের এ খাতে আরো বেশি বিনিয়োগ দরকার।’
অনুষ্ঠান শেষে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীদের পোস্টার প্রদর্শনী ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সবশেষে হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পোস্টার প্রদর্শনীতে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রপায়েদা শহীদ আনিলা ও তার দল। প্রথম রানারআপ হয় সৈয়দা মালিহা তাসনিম ও তার দল। দ্বিতীয় রানারআপ হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী তারান্নুম তাসনিম তন্দ্রা ও তার দল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারফুল ইসলামের সঞ্চালনায় সমাপনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এটিএম তারিকুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক ড. তৈয়েবুর রহমান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ ও অধ্যাপক ড. কাজী মারফুল ইসলাম।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ও এলকপ মনোনীত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষন টিমের সদস্য
সারাবাংলা/এজেডএস