মায়ের তুলনা মা
১২ মে ২০২৪ ১৩:৪৮
পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের, আনন্দের, নির্ভয়তার শব্দ; এক প্রশান্তির ছায়ার নাম মা। কোন কিছুর তুলনা মা হতে পারেনা। মা শব্দটি যেমন বিশাল এক অনুভূতির, তেমনি স্বর্গসুখ মায়ের মধ্যে। মা তোমার জন্য কী লিখব? তুমি বলে দাও। তুমি কী লেখার জন্য কিছু বাদ রেখেছ মা? তোমার তুলনা তো মা তুমিই, তোমার জন্য কী লিখতে হয়? এ তুমি সব লেখা। মা তুমি সব ভাষা। মা তুমি পৃথিবীর সবকিছু! ছোটবেলায় পড়েছিলাম-
মা কথাটি ছোট্ট অতি,
কিন্তু জেনো ভাই,
ত্রিভূবনে মায়ের মত আপন কেউ নাই।
সত্যি মা, তোমার মত আপন কেউ নাই। এই আপন এত্ত আপন যা পৃথিবীতে মাপার কোন যন্ত্র কোনদিন আবিষ্কৃত হবেনা। আর কোন সম্পর্কেও যে এত আপনতা আছে; তাও বলা যাবেনা। মা, মাই! সৃষ্টিকর্তার সেরা দান। মায়ের প্রতি ফোঁটা রক্ত বিন্দুতে জমে উঠে ধীরে ধীরে একটি শিশু। অবশেষে সেই শিশু যখন পৃথিবীর মুখ দেখে মা তার সহজাত পরিতৃপ্তির হাসি হাসে। অথচ সেই শিশুকে জন্ম দিতে মা কিছুক্ষন আগেও যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। কীসের জন্য; তার মাঝে এতদিনের লালিত দশ মাস দশ দিনের বাবুটিকে দেখার জন্য। মা তুমি ধন্য! সৃষ্টিকর্তা তোমার অন্তরটা কী দিয়ে তৈরি করেছে মা তুমি কী জান? মা তুমি নিজেও জাননা তুমি কী। মা তোমার শরীরের অপূর্ব এক গন্ধ পাই।ঘুমের মধ্যেও মায়ের গন্ধ পেয়ে মাকে চিনতে কষ্ট হয়না। তাই তো মায়ের বুকে লুকায় সন্তান। কেউ নিয়ে যাবে ভেবে। মা তার বান্ধবী আত্মীয়দের সাথে মজা করে ‘এই আমার বাবুটাকে কোলে নে’ রাখবা অনেকক্ষন! খাওয়াবিও, কিন্তু মায়ের বাবুটা খুব চালাক। মা চিনতে ভুল করেনা। ক্ষুদা লাগলেই মাকে ডাকে। এদিক-ওদিক মাকে ফিরে চায়। মা’কে দেখা মাত্রই শিশু ততক্ষনাৎ কেঁদে উঠে। মায়ের কোলে যাবে বলে আগ বাড়িয়ে থাকে। মায়ে বুকে পরম শান্তি। মা ও সন্তানের মাঝে এক কূল কিনারা হীন ভালবাসার সেতবন্ধন তৈরি হয়। যে বন্ধন চিরস্থায়ী। ভাঙ্গার কোন অবকাশ নেই। যেসব সম্পর্কে ভাঙ্গার অজুহাত আছে, কিন্তু মা সন্তানের বন্ধন হৃদয়ের তা নষ্ট করারও একটা সময় আসে বটে। পৃথিবীতে বিচিত্র ঘটনার শেষ নেই। পরিবার প্রথা ভেঙ্গে গেছে বহু আগে। ফলে সন্তান মাকে ভুলে, তবে মা যেখানে যে অবস্থায় থাকুক সন্তানকে ভুলতে পারেনা আমৃত্যু। মাকে সন্তান ভুলে থাকার মধ্যে থাকে অনেক অন্তর্নিহিত কারণ।
বাস্তবতা পুনশ্চ:
আমার মাকে দেখেছি দীর্ঘ পনের বছর ধরে কাঁদতে। তার আদরের ছেলেটির জন্যে, যে কিছুটা যেন হারিয়ে যাচ্ছিল তার জীবন সঙ্গীনির মনোরঞ্জনে। অবশেষে একদিন সত্যি হারিয়ে গেল মায়ের সেই ছেলেটি। ছেলেটিও কষ্ট পাচ্ছিল যেন মাকে ছাড়া। মা-ছেলের এই মায়ার দূরত্ব বিধাতাও চাচ্ছিলনা। তাই সৃষ্টিকর্তার ইশারায় একদিন এক মারাত্বক রোড এক্সিডেন্ট মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে পৃথিবী থেকে নিয়ে যায়। তারপর মা প্রতিদিন কাঁদতেন, এমনভাবে কাঁদতেন; যাঁর কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হতো। পড়ার টেবিল থেকে এসে মাকে জড়িয়ে ধরতাম। দেখতাম,অনুভব করতাম মায়ের সমস্ত শরীর শোকে স্তব্ধ। কী যে করুণ! মাকে থামানোর চেষ্টার অন্ত থাকতনা ভাই বোন সবার। একসময় মা শান্ত হতেন।ধীরে ধীরে তাঁর হারিয়ে যাওয়া রাজপুত্রের মত সন্তানের গল্প বলতেন। রাজপুত্র কীভাবে বড় হয়, কীভাবে পড়ে, কীভাবে চাকরী করতে যায় কীভাবে বিয়ে করে তারপর বাবা-মায়ের সাথে একটু ফাঁকি-একদিন বলেই বসে ‘মা আমাকে এবার থেকে কম আসতে হবে বাড়িতে’ ঘন ঘন আসতে পারবনা। মায়ের মন বুঝতে বাকি থাকেনা। ছেলে কেন এই কথা বলছে। মা আড়ালে চোখ মুছে। তারপরের ঘটনা আমাদের সবার জানা। সঠিক শিক্ষা আর উন্নত মানসিকতায় গড়া সন্তান অল্প কিছুদিন না যেতেই নাড়ীর টানে মায়ের কাছে আসতেই চিরজীবনের জন্য পরপারের যাত্রী করে নেন বিধাতা। হয়ত বিধাতা চাননি মায়ের সুসন্তানটি এভাবে মিথ্যার আর কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকুক, মা-ছেলে দুজনেই কষ্ট পাক। একমাত্র মা-বাবা বুঝতে পারে তাঁদের আগে সন্তান পৃথিবী থেকে গেলে কেমন লাগে। মা তোমার চলে যাবার মুহুর্তটা তাই আজও ভুলতে পারিনা। ভুলতে পারবওনা কোনদিন মা। যতদিন না মা আমি মরে যাব। মা তোমার যাবার কালের সেই স্মৃতি, পৃথিবীর মায়া ছাড়ার মুহুর্তেও চোখের পানি যা মুছে দিয়েছিলাম আমি, তখনও মা বুঝতে পারিনি মা তুমি চলে যাচ্ছ। মা তোমার চোখের পানি আজও আমার হাতে লেগে আছে; থাকবে অনন্তকাল। মা তুমি তোমার সংসারের জন্য সংগ্রামী ছিলে, তোমার সন্তান মানুষ করার জন্যে। যে সংসার আর কিছু সন্তান তোমাকে রোগাক্রান্ত করে বিছানায় যেতে বাধ্য করেছে। অবশেষে সেই অবস্থায় থেকে দুটি বছর মৃত্যর জন্য অপেক্ষা। মা আমি তোমার সংগ্রামী মেয়ে। এই সংগ্রাম করা আমি তোমার কাছ থেকে শিখেছি মা। তুমি দোয়া করো ওপার থেকে। মা তুমি হাসছ; হেসোনা মা!!
আপনি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন-এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ বলবেন মা, বাবা, ভাই-বোন আবার কেউবা তার স্বামী বা স্ত্রী, সন্তান ও শিক্ষক-অনেকের কথাই বলবেন। মানুষ দুনিয়াতে আসতে পারে বলেই তার প্রিয় ভালবাসার মানুষটিকে খুঁজে পায়, যার সঙ্গে কাটানো যায় সারাজীবন, যাকে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হয় অন্তর থেকে। আর পৃথিবী দেখার সুযোগ করে দেন আমাদের পরম পূজনীয় ‘মা’। তাই ভালবাসা, শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ সব দিক থেকে মায়ের অবস্থান উর্দ্ধে। মা আর সন্তানের মধ্যে রাগ-অভিমান থাকলেও রয়েছে অকৃত্রিম মনের টান। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার ‘মা দিবস’ আন্তর্জাতিক মা দিবস হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা দেয়া হয় ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেসে। আর তখন থেকেই এই দিনে বিশ্বব্যাপি পালিত হচ্ছে মা দিবস। মা দিবস বাঙালি সন্তানদের কাছে আজ উৎসবে পরিণত হযেছে।
গত শতকের গোড়ার দিকে আমেরিকার আ্যানা জারভিস নামে এক মহিয়সীনারীর কল্যাণে এই দিনটির সূচনা হয়। মাকে ভালবাসেনা ব্যাক্তি পৃথিবীতে বিরল। আ্যানা জ্যারভিসও তার মাকে ভালবাসতেন। তিনি লক্ষ্য করলেন তার দেশের অধিকাংশ মানুষই মাকে অবহেলা করছে। মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও ভালবাসার অভাব তিনি মর্মে মর্মে উপলব্দি করলেন। আর তাই তিনি এই দিবসটির আন্তজার্তিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য১৯১১ সাল থেকেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে ১৯১৪ সালে দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত হয়।
বিশ্বজুড়ে এই দিনটিতে মায়ের মর্যাদা নিয়ে লোকেরা ভাববে বা কিছু করবে। এটুকু মনে শান্তি যোগায়। তবুও দু:খ হয় ‘মা’এমনিতেই তাঁর মর্যাদা পাবে। তার জন্য দিবসের প্রয়োজন কেন? তিনশ পয়ষট্টি দিনই একজন মায়ের মর্যাদা অটুট রাখার চেষ্টাই হোক আমাদের মা দিবসের লক্ষ্য। এটাই হোক সকলের কামনা।
লেখক: সাংবাদিক