‘মা’- দিবসে নয় হৃদয়ে গাঁথি
১২ মে ২০২৪ ১৪:১৩
‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়সী’- অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও উঁচুতে। স্বর্গ দেখিনি দেখেছি আমার মাকে। আমাকে তোমরা একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেবো। সম্রাট নেপোলিয়নের এই উক্তি সবার জানা। মা আসলে কে? একজন মা তার সন্তানের জন্য একটি পৃথিবী। পৃথিবীর কোথাও আশ্রয় না মিললেও মা’র আঁচলতলে ঠিকই আশ্রয় মিলে যায় সন্তানের। সে সংখ্যায় যতজনই হোক। মা’কে আমার পরে না মনে/ শুধু কখন খেলতে গিয়ে/হঠাৎ অকারণে/একটা কী সুর গুনগুণিয়ে/কানে আমার বাজে/মায়ের কথা মিলায় যেন/আমার খেলার মাঝে- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা’কে নিয়ে লেখা এই কবিতা পড়লে মা’র কথা মাকে হারানোর কথা মনে পরে। আবার তিনিই বলেছেন, মা হচ্ছেন জগজ্জননী। তার চেয়ে শান্তির ঠিকানা আর কোথাও কিছু নেই।
মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বন্ধু। পৃথিবীর কোন সম্পদ, টাকা-পয়সা, গাড়ী, বাড়ি হারানোর সাথে মা’কে হারানোর তুলনা হয় না। এ শব্দের অতলে লুকানো থাকে গভীর স্নেহ, মমতা। মা নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মনে পড়া’, শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’, হুমায়ুন আজাদের ‘আমাদের মা’, আল মাহমুদের ‘নোলক’, কালিদাসের ‘মাতৃভক্তি’, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, শওকত ওসমানের জননীসহ কেবল মা’কে কেন্দ্র করেই কত সাহিত্য উঠে এসেছে। আরও বহু রচনা রচিত হবে নিশ্চিত। মোট কথা যতদিন এ বিশ্ব তার অস্তিত্ত বজায় রাখবে ততদিন মাকে নিয়ে অনুভূতির কথা, বেদনার কথা নানাভাবে উঠে আসবে। পৃথিবীর সব সম্পর্ক, সব ভালোবাসা একটি সম্পর্কের কাছে এসে মাথা নোয়ায়। তা হলো মা আর সন্তানের সম্পর্ক। কোন ব্যাখ্যা নেই, কোন নাম নেই, কোন লাভ ক্ষতির হিসেব নেই, পাওয়া বা না পাওয়ার অতৃপ্তি নেই আছে কেবল পরিপূর্ণতা। এ এক নির্মোহ পবিত্র বন্ধন। যা কেবল মা আর সন্তানের মধ্যে হতে পারে।
মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্ব মা দিবস পালন করা হয়। যদিও এটা ঘটা করে পালন করার মতো কোনো দিবস নয়। কারণ যে সম্পর্ক প্রতিনিয়তই শরীরের শিরা উপশিরায় বহমান তাকে একটি দিনে বাঁধতে চাওয়া বোকামি। একটি সম্পর্ক যা পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই একইভাবে বহমান তাকে আর কি দিয়েই পরিমাপ করা যায়! মা’কে নিয়ে আলাদা একটি দিবসের প্রচলন হলেও বস্তুতপক্ষে কোন নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে বা উপলক্ষ করে মা’র প্রতি ভালোবাসা হিসেব করা যায় না। এটি সর্বকালের,সর্বসময়ের। মাতৃ¯েœহ সকল গন্ডির উর্ধে। মা’র আঁচল ছায়ার প্রশান্তি পৃথিবীর সব শান্তি আর সুখের উপরে। ঠান্ডা এসির বাতাসও বুঝি মায়ের আঁচলের ছায়ার প্রশান্তি এনে দিতে পারবে না। কারণ এটি একদিনে প্রশান্তি অন্যদিকে নিরাপত্তার ছায়া। কোন সংজ্ঞায়,কোন মনীষির লেখায় মা’র তুলনা সম্পূর্ণ উপস্থাপন করা সম্ভব হবে না।
ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, কয়েক সহশ্রাব্দ বছর আগে বসন্ত উৎসবে দেবী মায়ের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা জানিয়ে পূজা দেওয়া হতো। গ্রিক পূরাণ অনুযায়ী বসন্ত উৎসর্গ করা হতো ক্রোনাসের স্ত্রী এবং দেব-দেবীদের মা বিয়াকে। তৎকালীন রোম রাজ্যে আড়ম্বর উৎসব ছিল মা দিবসে এবং সেটিও ছিল মা সাইবেলাকে উপলক্ষ করে। রোমের এই ধর্মীয় উৎসব যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও আড়াইশ’ বছর পূর্বে শুরু হয়েছিল। হিলারিয়া নামে পরিচিত ধর্মভিত্তিক এই উৎসবগুলো মার্চ মাসের ১৫ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত তিন দিন ধরে চলতো।মা দিবস চালু হওয়ার পেছনে মূলত কয়েকটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস পাওয়া যায়। ভিন্ন মতগুলো একত্রিত করে আজকের দিবসে এসেছে। তবু পৃথিবীর সব দেশ কিন্তু একই সাথে এই দিবস পালন করে না। কিছু দেশে আলাদা দিনও রয়েছে। কয়েকটি ইতিহাসের একটি হলো ১৬ শতকে ইংল্যান্ডে মা দিবস পালন করার খবর পাওয়া যায়। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সেই সময়ে জুলিয়া হাও নামের এক গীতিকার যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে আমেরিকার সব মাকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক মা দিবস পালন করতে চাচ্ছিলেন। তিনি আংশিক সফলও হয়েছিলেন। কারণ সারা বিশ্বে না হলেও তার শহরে ঘটা করেই পালিত হতো। ১৯১২ সালে আনা জার্ভিস স্থাপন করেন আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি এবং মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার ‘মা দিবস’ শব্দের বহুল প্রচলন করেন। আবার হাজার বছর আগেও প্রাচীন রোম ও গ্রীসে তাদের দেবীর বন্দনায় আজকের মা দিবসের কিছুটা মিল দেখা যায়।
মাকে নিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, আমি যা হয়েছি বা যা হতে চাই তার সবটুকুর জন্যই আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী। আমার মায়ের প্রার্থনাগুলো সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে ছিল।মামা সন্তানের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দেন সন্তানের বেঁচে থাকার এবং মঙ্গল কামনার জন্য এ চিরন্তন সত্যটি শুধু মানুষের মধ্যেই নয়, প্রকৃতির অন্য প্রাণিদের ক্ষেত্রেও এটি সত্যি। শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে মাকড়সার কথা বলা যায়। মাকড়সাকে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ মা বলা যায়। যখন মাকড়সার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় তখন মা মাকড়সা সেই ডিম নিজের দেহে বহন করে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত। যখন বাচ্চা হয় তখন মা মাকড়সা বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজের শরীর বিলিয়ে দেয় তাদের খাবারের জন্য। বাচ্চা মাকড়সারা খাদ্য হিসেবে মা মাকড়সার দেহই খেতে শুরু করে একটু একটু করে। সন্তানের জন্য মা নীরবে হজম করে সব কষ্ট-যন্ত্রণা। এভাবে এক সময় মায়ের পুরো দেহই চলে যায় সন্তানদের পেটে। পৃথিবীর সব মা-ই সন্তানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে। মা মূলত এক কষ্ট সহিঞ্চু বৃক্ষ। গায়কের কন্ঠে তাই ভেসে ওঠে সুর- ’মায়ের এক ধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম,/পাপোশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না/এমন দরদী ভবে কেউ হবে না আমার মা গো। আর কবি কাজী নজরুল লিখেছেন, হেরিলে মায়ের, মুখ দূরে যায় সব দুখ।
সন্তান কখনোই মা’র কাছে বোঝা হয় না কিন্তু মা অনেক সন্তানের কাছেই বোঝা হয়। সেই বোঝা সন্তান মাঝে মাঝে বইতে পারে না। এর ফলে অনেক মাকে পাওয়া যায় রেল ষ্টেশনের পাশে অথবা ফুটপাতে! শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা এটাই। একজন মায়ের অনকেগুলো সন্তান থাকলেও সবাইকে সমান ভালোবাসা দিয়ে বড় করে, তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু সেই অনেকগুলো সন্তানের কাছে একজন মা অনেক ক্ষেত্রে বোঝা হয়ে দাড়ায়। তখন দেখা যায় মা’র খাওয়া দাওয়া ভাগ হয়ে যায়, পোশাক দেয়ার দায়িত্ব ভাগ হয়ে যায়। এর সাথে জোয়ান হেরিসের একটি উক্তির মিল রয়েছে। তিনি বলেছেন, সন্তানেরা ধারালো চাকুর মতো। তারা না চাইলেও মায়েদের কষ্ট দেয়। আর মায়েরা তাদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত সন্তানদের সাথে লেগে থাকে। মায়েরা ভালো থাক আর নাই থাক তারা চান যেন তাদের সন্তান ভালো থাকে, সুখে থাকে। দিবসে বা অ-দিবসে পৃথিবীর সব মা ভালো থাক।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই