Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেন ব্যর্থ হতে পারে ‘ব্যাংক মার্জার’


১৪ মে ২০২৪ ১৬:২৯

মো. আকতারুল ইসলাম

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সিংহভাগজুড়ে রয়েছে ব্যাংক। এই খাতটি ব্যক্তিমালিকানায় ছাড়া শুরু হয় ১৯৮২ সালে। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্ত মেনে এ পর্যন্ত মোট ৬১টি দেশি-বিদেশি ব্যাংক এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রায়ই শোনা যায়, এমন ছোট একটি অর্থনীতিতে এত ব্যাংকের দরকার নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এটি একটি ‘প্যারাডক্সিক্যাল’ কথা। মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ বেয়ে ব্যাংক শিল্প প্রায় চার দশক ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। ব্যবসায়িক দিক থেকে ব্যাংকগুলো ভালোই করছিল। তবে ব্যাংক শিল্পের গতিময় অগ্রযাত্রা এখন মন্থর হওয়ার পথে। কারণ, আর্থিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এরই মধ্যে ব্যাংক শিল্পের বৃদ্ধিও তার ক্রান্তিবিন্দুতে পৌঁছে গেছে, যার পরবর্তী পর্যায় হলো পতন। তাই পতন ঠেকিয়ে ব্যাংক শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ।

একীভূতকরণ বা ‘মার্জার’ হলো দুই বা ততোধিক কোম্পানির এক হয়ে যাওয়া। এর ফলে নতুন কোম্পানি গড়ে উঠতে পারে। আবার আকারে ছোট কোনো কোম্পানি বড় কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হলে ওই বড় কোম্পানিতে ছোট কোম্পানির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সৃষ্ট নতুন কোম্পানির শেয়ার একীভূত কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তারা সবাই নতুন কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার।

বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংক শিল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের অংশ হিসেবে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের ব্যাপারে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অবশ্যই সময়োপযোগী এবং প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, সেই প্রক্রিয়া যথাযথ পদ্ধতি মেনে হচ্ছে কি না।

বিজ্ঞাপন

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হলে প্রথম যে বিষয়টি প্রয়োজন হয় সেটি হলো— দুই কোম্পানির ঐকমত্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক একীভূতকরণের ঘোষণার পর গত এক মাসের ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকই এই একীভূতকরণ প্রথার সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ন্যাশনাল ব্যাংকের কথা। ইউসিবি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় যেতে আগ্রহী নয় দেশের প্রথম দিকের বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক।

একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ক্ষেত্রেও। এই ব্যাংকটিকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বাকৃবি) সঙ্গে একীভূত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাকৃবিই অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংক। সে তুলনায় রাকাব ব্যাংক হিসেবে শক্তিশালী। এখানে শক্তিশালী ব্যাংকটিকেই দুর্বল ব্যাংকের একীভূত করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে রাকাব এবং এর অধীন দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে আশঙ্কা রাকাবের সংশ্লিষ্টদের। ন্যাশনাল ব্যাংক ও রাকাব নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোর অনাস্থাই প্রমাণ করে।

একটি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য ব্যাংকিং খাতের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা সবসময়ই পুঁজির স্বল্পতায় ভোগেন। উদ্যোক্তাদের পুঁজি বা অর্থায়ন সমস্যা সমাধানে ব্যাংকিং খাত সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

বিজ্ঞাপন

উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জোগান নিশ্চিত করার জন্য সাধারণত স্টক মার্কেটের ওপর নির্ভর করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের স্টক মার্কেট এখনো সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি। ফলে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের পুঁজি চাহিদা মেটানোর জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অবলম্বন হচ্ছে ব্যাংক। কিন্তু এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। ফলে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে উদ্যোক্তাগণ প্রত্যাশিত মাত্রায় সাপোর্ট পাচ্ছেন না।

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য কোনো শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হলে তারা আবারও স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এতে ব্যাংকিং সেক্টরে বিরাজমান সমস্যাগুলো কিছুটা হলেও সমাধান হবে বলে ধারণা করা হয়। তবে দুটি ব্যাংক একীভূত করলেই যে তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে বা সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এটা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় না। হয়তো এমনও দেখা যেতে পারে, দুটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত হয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। অথবা এমনও হতে পারে, একটি সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে দেওয়ার ফলে সবল ব্যাংকটিও একপর্যায়ে দুর্বল হয়ে পড়ল। তখন আবার একীভূতকরণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।

এ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একীভূতকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা কী হবে এবং তারা একীভূত কার্যক্রম কীভাবে তদারকি করবেন? এ জন্য বিভিন্ন আইনি কাঠামো তৈরির ব্যাপার আছে। আইনি কাঠামো ও নীতিমালা সঠিকভাবে প্রণীত না হলে একীভূতকরণ কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে।

একীভূতকরণের কিছু নিয়মকানুনের ব্যত্যয় বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে নিজেই ঘটিয়েছে। বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে ড. বিরুপাক্ষ পাল বলছেন, দুটি প্রতিষ্ঠানকে মেলানোর এই কাজে অন্তত একটি পক্ষের আগ্রহ থাকতেই হবে। বর্তমান ব্যাংকপাড়ায় যা ঘটছে, তাতে কোনো পক্ষেরই আগ্রহ নেই বলে প্রতীয়মান হয়। উভয় পক্ষই এ ধরনের ‘বিয়ে’ ঠেকাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু ‘দেবদাস’-এর পার্বতীর মতো মুখে কিছু বলতে পারছে না। এগুলোকে ‘মার্জার’ বলে না, এগুলো ‘ফোর্সড কনসোলিডেশন’ বা জোরপূর্বক সমন্বিতকরণ।

একীভূতকরণ হোক আর অ্যামালগামেশন বা অধিগ্রহণ হোক, যদি তা সঠিক পেশাদারদের অংশগ্রহণে পেশাদারির র সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়, তবেই সুফল আসবে। এ ক্ষেত্রে সঠিক নেগোসিয়েশন, আর্থিক ডিউডিলিজেন্স, লিগ্যাল ডিউডিলিজেন্স, মানবসম্পদ সংক্রান্ত ডিউডিলিজেন্স, ওয়ারেন্টি ও রিপ্রেজেন্টেশন, সঠিক ও চূড়ান্ত ডিল মেকিং এবং এরপর পোস্ট মার্জার ইন্টিগ্রেশনে (পিএমআই) এ পর্যায়গুলো নিখুঁতভাবে প্রতিপালন করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে একভূতকরণ ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

উদ্যোক্তাদের উৎসাহের অভাব

সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে টিকে থাকার আশা নিয়েই যাত্রা শুরু করে। কোনো উদ্যোক্তাই টিকে না থাকার কথা ভেবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন না। তাই বলে শতভাগ উদ্যোগ সফল হবে, তা অবাস্তব। উন্নত দেশেও একই অবস্থা। কোনো কোম্পানি যখন খুব খারাপ অবস্থায় চলে যায়, পাওনাদারদের দায় মেটাতে অক্ষম হয়ে যায়, তখন ওই কোম্পানি অবসায়নের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ব্যাংক কোম্পানির ক্ষেত্রেও বিলুপ্তির এই পথ খোলা আছে। তবে ব্যাংক কোম্পানি যেহেতু জনসাধারণের অর্থ বা ‘পাবলিক মানি’ নিয়ে কাজ করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে নিয়ন্ত্রিত আর্থিক সেবা প্রদান করে, তাই অবসায়নের পথে না গিয়ে বিকল্প হিসেবে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ কৌশলই উত্তম। কিন্তু যে উৎকণ্ঠা থেকেই যায়— একীভূত হওয়ার ফলে দুর্বল ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে ক্ষতির পরিমাণ কত বা অবসায়নের থেকে কত কম হবে, তার সুস্পষ্ট ধারণা না থাকা। ফলে এই বিকল্পটি মেনে নিতে উদ্যোক্তারা অনুৎসাহিত হতে পারে।

আমানতকারীদের আস্থার অভাব

যেহেতু একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং অধিক মুনাফা অর্জনের একটি ব্যবসায়িক কৌশল, তাই এ ক্ষেত্রে আমানতকারীদের আমানত অক্ষত থাকার সম্ভাবনা বেশি। পক্ষান্তরে কোনো দুর্বল ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ ও দায় ভালো ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে একীভূত হয়ে যাবে। আমানতকারীদের তখন ভালো ব্যাংকের আমানতকারী থাকতে বাধা নেই।

কিন্তু একটা ভয় থেকেই যায়— আমানতকারী যদি এই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা না পায় তাহলে তারা তড়িঘড়ি করে তাদের আমানত তুলে নিতে পারে। এতে হিতে বিপরীত অবস্থা দেখা দেবে। আমানত ঘাটতির ফলে ব্যাংকে অচলাবস্থা তৈরি হবে। এরই মধ্যে কিছুটা সংকেত লক্ষ্য করা গেছে বেসিক ব্যাংকের আমানতে। এপ্রিল মাসের তিন সপ্তাহে ব্যাংকটি থেকে আমানতকারীরা দুই হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত তুলে নিয়েছেন। ফলে ব্যাংকটির মোট আমানতের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে, যা মার্জার ব্যবস্থায় অগ্রিম চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, একীভূত হওয়া ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের তিন বছরের মধ্যে ছাঁটাই করা যাবে না। তারপরও যেসব দুর্বল ব্যাংকের নাম একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় এসেছে সেখানকার কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার খবরও আসছে।

সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাওয়া বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। যদিও সিটি ব্যাংক বলছে, আগামী অন্তত চার বছর কারও চাকরি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু উৎকণ্ঠা থেকেই যায়— চার বছর পর এসব কর্মীদের কী হবে! এসব কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিশচয়তা নিয়ে স্থায়ী কোনো নীতিমালা না থাকায় একীভূতকরণ ব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ব্যাংক মার্জার মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর