নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করলেই রাজনীতির পথ বন্ধ
১৪ মে ২০২৪ ১৮:৪৩
প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচনে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক জামায়াত নেতা মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন। তিনি দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে হারিয়েছেন সাবেক বিএনপি নেতা নেতা হাবিব উল্লাহকে। জয়নাল আবেদীন দলীয় রাজনীতিতে খানিকটা নিস্ক্রিয় থাকলেও হাবিব উল্লাহ বহিষ্কারের আগ পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের ভোট প্রবণ ওই উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন কেউ প্রার্থী হননি। প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে যেখানে বিএনপি-জামায়াতের ভোট বেশি এবং তাদের দলের প্রার্থী ছিল সেখানে ভোট পড়ার হারও ছিল বেশি। তার মানে বিএনপির ভোটাররা ভোট দিতে চান কিন্তু প্রার্থী পান না।
প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির ৮৩জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। এদের মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন ২৮জন। তাদের মধ্যে ৭জন নির্বাচিত হয়েছেন। তুমূল লড়াই করেছেন প্রত্যেকেই। কিন্তু কেউ নির্বাচন বর্জন করেননি। এমনকী নির্বাচন কমিশনে বড় কোন অনিয়মের অভিযোগও করেননি। ১৩৯ উপজেলায় গড়ে ভোট পড়েছে ৪০ভাগ। সুতরাং বলা যেতে পারে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটের হার নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নির্বাচনের শৃঙ্খলা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। অথচ বিএনপির নেতারা নির্বাচনে আসলেন না।
জাতীয় পার্টি দলীয় প্রতীক নিয়েই অংশ নেয় উপজেলা নির্বাচনে। প্রথম দফায় তারা ৩টি উপজেলায় জয়ী হয়েছে। নির্বাচনে শিক্ষিত প্রার্থীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে ৫৪ ভাগ প্রার্থী ছিলেন গ্রাজুয়েট বা পোস্ট-গ্রাজুয়েট। অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন প্রার্থীর সংখ্যা এবারে কমে মাত্র ১.৬৩ শতাংশে নেমে আসে। পাশাপাশি বাড়ে ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও শিক্ষক প্রার্থীর সংখ্যা্ও। এদের মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ সরকার দলীয় প্রার্থী। বাকি তিন ভাগ অন্য রাজনৈতিক দলের এবং নির্দলীয়। তাই বলা যায় নির্বাচনে সেই অর্থে অনিয়ম হলে নিঃসন্দেহে কড়া প্রতিবাদ হতো।
অথচ ভোটের হার কমের অজুহাত দিয়ে বিএনপি নেতারা বলা শুরু করেছেন, মানুষ এই নির্বাচন বর্জন করেছে। বাাংলাদেশে ভোটের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটি নির্বাচনে ৪০ ভাগ ভোট বেশি নয়। তাই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ বলার অজুহাত হিসাবে এই হার মোটামুটি যুৎসই। আমার মনে হয় এই বলাটাই তাদের নির্বাচন বর্জনের উদ্দেশ্য। সামনে আরও তিন ধাপের উপজেলা নির্বাচন আছে। প্রত্যেকবার নিশ্চয়ই তারা একই কথা বলবেন।
বোঝাই যাচ্ছে বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত যেকোন নির্বাচন, তা ভালো হোক খারাপ হোক প্রশ্নবিদ্ধ বলতে হবে, এটাই এখন বিএনপির মনস্তত্ব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাতে কি একটি রাজনৈতিক দলের দলীয় লাভ আছে? আমারতো মনে হয় নেই। কারণ বাংলাদেশে নির্বাচন ছাড়া বৈধভাবে ক্ষমতা পাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের জনগণ ছাড়া কোন দল বা ব্যক্তিকে কেউ ক্ষমতায় বসাতে আসবে না। রাজনীতিতে টিকতে হলে ভোটারের কাছে আসতেই হবে। সেটা কবে শুরু করতে চায় বিএনপি?
বিএনপি নিয়ে এত কথা বলতাম না। বলছি একারণে যে ভোটের মাঠে এখনও তাদের প্রচুর অনুসারী রয়েছে। তৃণমূলে রয়েছে বহু নেতা-কর্মী। যেকারণে দেশের গণতন্ত্রের জন্যে এখনও তাদের অনেক করনীয় রয়ে গেছে। এটাকে শুধু করনীয় বললে কম বলা হবে। কারণ যে দল তিন বার দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে, দেশের মানুষের জন্যে তাদের যেটা থাকে, সেটা হচ্ছে দায়িত্ব। ভোট না করে বিএনপি সেই দায়িত্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে। তারা ভোটারের ওপর আস্থা না রেখে আস্থা রাখছে কোন এক দৈব শক্তির ওপর। কিন্ত এই দৈব চয়ন যে ঠিক নয় তা বুঝতে পারে দলের তৃণমূল। যারা মানুষের কাছে থাকে। যে কারণে তারা ভোটারদের থেকে বিচ্ছন্ন হতে চায় না। তাই নির্বাচনে অংশ নেয়।
প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৭জনসহ মোট ২১জন জিতেছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে আগামী তিন দফায় আরও বেশি বিএনপি নেতা প্রার্থী হবেন। এদিকে বিএনপি প্রথম দফার নির্বাচনে অংশ নেয়ার অপরাধে দল থেকে বহিষ্কার করেছে ১৪৮জন নেতাকে। দ্বিতীয় দফায় এখন পর্যন্ত ৬৬জন বহিষ্কার হয়েছেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার অপরাধে তৃণমূলের ১১শ’ নেতা কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এই তালিকা নিশ্চয় আরও দীর্ঘ হবে। কারণ সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আছে।
বিএনপির মধ্যম সারির এক নেতা বলেছেন “উপজেলা নির্বাচনে ১৫ থেকে ২০ জন বিএনপি নেতা অংশ নিয়েছে। কিন্তু বিএনপির কেউ তাদের সঙ্গে নেই। তাদের বহিষ্কার করার মাধ্যমে বিএনপি জঞ্জালমুক্ত হয়েছে। এরা ডামি প্রার্থী। এরা দলের জন্য আগাছা। অথচ বিএনপির একশ’র বেশি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে এখন মাত্র ৮টি সাংগঠনিক জেলায় কমিটি রয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে ১৪৮ জনকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের কোনো উপজেলায় বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। প্রায় দেড়শো উপজেলায় কোনো আহ্বায়ক কমিটিও নেই।
যাই হোক, সম্প্রতি সিনিয়র বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গণমাধ্যমে বলেছেন “আন্দোলন করতে করতে বিএনপি নেতাকর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবে তারা হতাশ হয়নি”। তার প্রথম কথাটি খুবই সত্য। ১৮ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকলে ক্লান্ত হ্ওয়ারই কথা। দ্বিতীয় কথাটা্ও হয়তো সত্য। “তারা হতাশ নন”। কিন্তু সেটা আর কতদিন? নির্বাচন নেই, তাই ভোটারদের সঙ্গেতো তাদের যোগযোগ নেই। বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল সন্দেহ নেই। কিন্তু কত বড়? একসময় মোট নেতা-কর্মীদের চেয়ে বহিষ্কৃতদের সংখ্যা বেশি হয়ে যাবে নাতো?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করলেই রাজনীতির পথ বন্ধ পলাশ আহসান মুক্তমত