বাজেট ভাবনা: উপকূলের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে
১৬ মে ২০২৪ ১৪:০৪
প্রতি অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়ে থাকে জাতীয় সংসদে। বাজেট ঘোষনার আগে থেকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়-এটা হবে মানুষের জীবন রক্ষার বাজেট, এটা হবে মানুষের জীবিকা রক্ষার বাজেট, এটা হবে জনগণের কল্যাণের বাজেট। আবার বাজেট নিয়ে জনগণেরও ভাবনা থাকে- বাজেট নিয়ে কি ভাবছেন সাধারণ মানুষ? বাজেট থেকে তাদের কী প্রত্যাশা? আসলেই কি জনবান্ধব বাজেট কিনা? বাজেট কি জনগণের কল্যাণে কাজে আসে? বাজেট দিয়ে কি হবে ইত্যাদি। এমন নানা প্রশ্ন জাগে মানুষের মাঝে। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠি অর্থাৎ উপকূল নিয়ে কেউ ভাবছে না, বলছেও না।
যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় বাজেট কি? বাজেট দিয়ে কি হয়? উত্তরে অধিকাংশ মানুষের কাছ থেকে প্রশ্ন আসবে বাজেট বুঝিনা, সরকার বাজেট দেয় তা শুনি। নিজেরা আয় করি, ব্যয় করি ইত্যাদি। দেশের কিছু সংখ্যক মানুষের মাঝে বাজেট ভাবনা থাকলেও অধিকাংশ মানুষের মাঝে বাজেট ভাবনাই নেই। যার সংখ্যা বেশি উপকূলে। আর বেশি সংখ্যক মানুষই জানে না বাজেটের বিষয়। যদি তাদের মতো করে খুব সহজ করে বলি বাজেট কি তাহলে বলতে হয় একটি পরিবারে এক বছরের সম্ভাব্য সব আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য।
বাজেট কী? ‘বাজেট’ কথাটির সঙ্গে কম-বেশি আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু বাজেট কী বা কত প্রকার, সেটা সম্পর্কে আমরা অনেকেই খুব বেশি জানি না। এক কথায় বললে, বাজেট হচ্ছে একটি দেশের এক বছরের সম্ভাব্য সব আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব-নিকাশের বিবরণী। একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য সরকারের সম্ভাব্য ব্যয় এবং রাজস্বসহ অন্যান্য আয়ের একটি পূর্বাভাসও বলা যায় একে। কোনো নির্দিষ্ট আর্থিক বছরে সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে কতটুকু আয় প্রাপ্তির আশা করে এবং বিভিন্ন খাতে কী পরিমাণ ব্যয় করতে চায়, তার সুবিন্যস্ত হিসাবকে সরকারি বাজেট বলে। বাংলাদেশ সরকারের একটি বাজেটের সময়কাল হচ্ছে এক অর্থবছর, যা ১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ধরা হয়। মূলত সরকারের এ নির্দিষ্ট সময়ে দেশের আর্থিক পরিকল্পনার সুষ্ঠু প্রতিফলন থাকে বাজেটে। বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বাজেট’ শব্দটি নেই, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাজেট শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে সমরূপ শব্দ ‘বার্ষিক আর্থিক বিবরণী’ ব্যবহার করা হয়েছে। বাজেট হলো সরকারি অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। বাজেটে যেমন সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটে, তেমনি দেশের অর্থনীতির চিত্র ফুটে ওঠে। বাজেটে শুধু সরকারি সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাবই থাকে না; বরং আয়-ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেমন- আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে কীভাবে ঘাটতি পূরণ হবে এবং ব্যয়ের চেযে আয় বেশি হলে সে উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কী করা হবে ইত্যাদি বিষয়ও বাজেটে লিপিবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশে সরকার বাজেট প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করে। পরে জাতীয় সংসদে তা অনুমোদন নিতে হয় এবং চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে সরকারের নির্ধারিত আয়-ব্যয় ও তার পদ্ধতি কার্যকর হয়।
আর কয়েকদিন পরই জাতীয় বাজেট। জাতীয় বাজেট নিয়ে অনেক কথাইতো হলো, কিন্তু উপকুল তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বাজেট নিয়ে কেউ ভাবছেন? বা ইতোপুর্বে কখনো ভাবতে দেখেছেন? কিছুসংখ্যক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং কিছুসংখ্যক লেখকদের ভাষায় প্রান্তিকের বাজেট ভাবনা উঠে আসে। কিন্তু আসলেই কি উপকূল জনগোষ্ঠির জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় কিনা; এমন প্রশ্ন থাকাটাই স¦াভাবিক। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মধ্যে অন্যতম রয়েছে মৎস্য খাত, এ খাত থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা সরকার রাজস¦ নিয়ে থাকে। এছাড়াও উপকূলে গোলাপাতা, মধুসহ নানা খাত রয়েছে। মৎস্যসহ নানাখাতে অসংখ্য শ্রমিক কাজ করছেন।
উপকূলীয় অঞ্চলনীতি ২০০৫ অনুযায়ী বঙ্গোপসাগর বরাবর উপকূলীয় তটরেখার দৈর্ঘ্য ৭১০ কিঃ মিঃ। সংকট ও সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। এখানে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বেশি। এছাড়া প্রাকৃতিক ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগসমূহ যেমন নদী ভাঙ্গন, ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক, জলাবদ্ধতা, ভূমিকম্প, পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা, নানা রকমের দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ইত্যাদির সম্মিলিত প্রভাবের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের জীবন ও জীবিকার ধারা যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে তেমনি এ অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিও হয়েছে মন্থর। দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন সম্ভাবনা আছে যা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অর্থবহ অবদান রাখতে পারে। উপকূলীয় মাছ ও চিংড়ি, বন, লবণ এবং খনিজদ্রব্যসহ বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সম্পদের সমাহার এই অঞ্চলে বিদ্যমান। এখানে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, স্থলবন্দর এবং পর্যটন ও অন্যান্য শিল্পের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়া বেলাভূমি ও সমুদ্রবক্ষে প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণের সম্ভাবনাও বিশাল। এসব সম্পদের অনেক কিছুই এখন পর্যন্ত অনাহরিত এবং এগুলোর অনেক অংশ ব্যবহারের সুযোগ ও সম্প্রসারণ করার অবকাশ রয়েছে। এ ছাড়াও উপকূলে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষণযোগ্য কিছু প্রতিবেশ বা ইকোসিস্টেম আছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ প্রতিবেশ সুন্দরবনের অংশবিশেষকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে রয়েছে প্রবাল প্রতিবেশ। উপকূলীয় অঞ্চল শুধু জীববৈচিত্র্যের এক বিশাল আধারই নয় বরং এই এলাকা একটি সার্বজনীন সম্পদের পরিবেশগত ভিত্তি। এই সম্পদের এক বিরাট অংশ হলো বঙ্গোপসাগরের রকমারি মৎস্য ভান্ডার। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, সীমিত সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা, প্রকৃতি ও মানুষের বৈরীতার কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়, অর্থনৈতিক সুযোগের অপ্রতুলতা, গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত আধার ইত্যাদি কারণে সমন্বিত উপকূলীয় ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরী। এই উপলব্ধি থেকেই সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা, কৌশল (দারিদ্র্য হ্রাসের জাতীয় কৌশলসহ) এবং বিভিন্ন পরিকল্পনায় উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নের বিষয়গুলো বারংবার উপস্থাপিত হয়েছে।
ওই নীতির ১.২ এ বলা হয়েছে-সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পাদনের লক্ষ্যে নিজস্ব নীতিমালা ঘোষণা করেছে। মন্ত্রণালয়সমূহ তাদের অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে এবং এই নীতিগুলোর সাথে উপকূলীয় বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। যেমন ‘পরিবেশ নীতি (১৯৯২) ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম (১৯৯২), জাতীয় বন নীতি (১৯৯৪), পশু সম্পদ উন্নয়ন নীতি (১৯৯২), জাতীয় মৎস্য নীতি (১৯৯৮), জাতীয় পর্যটন নীতি (১৯৯২), জাতীয় জ্বালানী নীতি (১৯৯৬), নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন নীতি (১৯৯৮), জাতীয় পল্লী উন্নয়ন নীতি (২০০১), জাতীয় শিক্ষা নীতি (১৯৯৭), জাতীয় শিশু নীতি (১৯৯৪), নারী উন্নয়নের জন্য জাতীয় নীতি (১৯৯৮), জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯), জাতীয় কৃষি নীতি (১৯৯৯), শিল্প নীতি (১৯৯৯), জাতীয় নৌ নীতি (২০০০), জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি (২০০১), জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (২০০০)। কিন্তু এতো বছরে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে এসব নীতিমালা? উপকূলীয় অঞ্চল নীতি ২০০৫ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে? এমনকি এ নীতির বিষয় উপকূলের কত সংখ্যাক মানুষ জানে? উপকূলীয় অঞ্চল নীতি ২০০৫ যদি উপকূলীয় অঞ্চলের কল্যাণের জন্যই হয়ে থাকে তাহলে এটার প্রচার প্রচারণা বাড়ানো উচিত। উপকূলীয় অঞ্চল নীতি ২০০৫ এর ১.৩ এ বলা যৌক্তিতায় উল্লেখ করা হয়েছে, আর্থ সামাজিক উন্নয়নে উপকূলীয় অঞ্চল নানাভাবে পিছিয়ে আছে, বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবোয় অনগ্রসরতা ও পরিবেশের ক্রমাবনতি এবং জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখার প্রচুর সম্ভাবনা উপকূলীয় অঞ্চলে বিদ্যমান।
দেশের স্থলভাগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা নিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল গঠিত। ২০০১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ছিলো ৩ কোটি ৪৮ লাখ, ২০২২ সালে এসে স¦াভাবিকভাবেই আগের চেয়ে বেশি। উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমিভিত্তিক সীমা নির্ধারণের জন্য তিনটি সুচক বিবেচনা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছেঃ জোয়ার-ভাটার প্রভাব, লোনা পানির অনুপ্রবেশ এবং ঘূর্ণিঝড়/জলোচ্ছাস। এদের কোন না কোনটির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বলয়ে রয়েছে ১৯টি জেলার। ওই নীতিমালার ২ এ ঘোষণা রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চল দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বিভিন্নভাবে বৈশিষ্ট্যপুর্ণ। সকলের অংশগ্রহণ ও সমন¦য়ের মাধ্যমে উপকূলীয় সম্পদ ব্যবহারে দ্বন্ধ নিরসন এবং বিভিন্ন সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের টেকসই ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নের সাধারণ দিক নির্দেকশনা, উপকূলীয় জনগণ একটি নিরাপদ ও অনুকুল পরিবেশ তাদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন এমন লক্ষে উপকূলীয় অঞ্চল নীতিমালা রচিত হলেও কতটুকু আলোর মুখ দেখেছে এটি প্রশ্ন ওঠা স¦াভাবিক নয় কি? আমি বলছি না যে সরকার উপকূলে কাজ করেনি বা করছে না। সরকার এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রচুর কাজ করে যাচ্ছেন এটি অস¦ীকার করার সুযোগ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু কৌশলগত এবং বাস্তবায়নের দিক থেকে ত্র“টি রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চল নীতির ৫.২ এ বলা হয়েছে কৌশলগত পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রনয়ন, যেমন- দারিদ্র হ্রাস, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের জন্যে একটি উপকূলীয় উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, কিন্তু জাতীয় বাজেটে আলাদা আলাদা কি পরিমাণ এবং কোন কোন খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে এটিও কিন্তু জনগণ জানছে না, অথচ জনগণের জন্যই এ বাজেট।
৪.৪.৩ এ প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ নিয়ে বলা হয়েছে জাতীয় মৎস্য নীতি অনুসারে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের আহরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রণীত নীতিমালা বাস্তবায়ন করা, উম্মুক্ত জলাশয়ে জেলেদের অধিকার রক্ষার মাধ্যমে টেকসই এবং দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। যদিও সম্প্রতি মৎস্য বিভাগ কর্তৃক বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ ও শামুক নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবেও এখানেও প্রশ্ন সরকারের উদ্যোগ কতটুকু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে?
আমরা পুর্বের হিসেবে মতে দেখছি, গত এক দশক ধরে জাতীয় বাজেটে নদনদী, জলাভূমি, পানিসম্পদ ও পরিবেশ সুরক্ষা সম্পর্কিত বরাদ্দ বাড়ছে। আমরা দেখেছি, ২০১৯-২০ অর্থবছরেও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য ৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জন্য ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এজন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সাধুবাদ পেতে পারে। আমাদের মনে আছে- ২০২০-২১ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় নদী, জলাভূমি, পানিসম্পদ ও পরিবেশ সুরক্ষা খাতে সার্বিক বরাদ্দই কেবল বাড়েনি; বাজেট উপস্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় এসব খাতে নতুন অথচ জরুরি কিছু বিষয়ে উদ্যোগের কথাও বলেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সারাদেশে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খনন কার্যক্রম। প্রথমবারের মতো ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। বরাদ্দ ছিল নদীভাঙন নিয়ন্ত্রণ ও ভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্পে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও উপকূলীয় বাঁধে নির্মাণ ও সংস্কারে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য সহায়ক আঞ্চলিক নৌপথ সম্প্রসারণেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বেসিন কমিশন গঠনে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি দখল, দূষণ প্রতিরোধসহ নদনদী ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গতানুগতিক বরাদ্দ তো ছিলই।
আমরা দেখতে চাই, আসন্ন বাজেটে উপকূলীয় জেলেদের অধিকার নিয়ে, নদী, জলাভূমি, পানিসম্পদ খাতে বরাদ্দ আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে উপকূলের খাদ্য উৎপাদন, বেড়িবাঁধ রক্ষা, লবনাক্ততা দূরীকরণ,সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রভৃতি খাতেও দিতে হবে বিশেষ মনোযোগ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন টেকসই রাখতে হলে পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষায়ও মনোযোগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এও ভুলে গেলে চলবে না বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কথা। আর বাংলাদেশে প্রকৃতি মানেই বহুলাংশে পানি-প্রকৃতি। নদনদী,খাল, জলাভূমি, বন, বনাঞ্চল, পানিসম্পদ অক্ষুন্ন থাকলে প্রকৃতির অন্যান্য সন্তান নির্বিঘœ থাকতে পারে। বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশের বাজেট হলো মূলত একটা দাপ্তরিক কাজ। অর্থনীতিবিদ ও একটা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার মাত্র। বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তারা এগুলো করেন। এখানে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের অংশগ্রহণের খুব বেশি সুযোগ নেই। প্রত্যেকবার বাজেটের সময় এলে বিভিন্ন আলোচনা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুতেই কিছু হয় না। সেজন্য আমার প্রস্তাব হলো আমরা শুধু বাজেটের সময় এ আলোচনা অব্যাহত রাখব না, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথম ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে জাতীয বাজেট উপকূল নিয়ে কি পরিমাণ বরাদ্দ রাখছে সেটি দেখার বিষয়। স্থানীয় পর্যায় থেকে সরকার কর আদায় করছে কিন্তু সে অনুযায়ী উন্নয়ন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। যেহেতু স্থানীয় উন্নয়নে যেমন স্থানীয় জনগোষ্ঠি উপকারভোগি, তেমনি স্থানীয় পর্যায় কর আদায়ও হওয়া উচিত লক্ষণীয়। সে হিসেবে উপকূলের জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্টভাবে বরাদ্দ দিতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ সামর্থ্যের অর্ধেকেরও কম। রাজস্ব আহরণ কাঙ্খিত মাত্রায় আহরণ করতে না পারায় অবকাঠামো উন্নয়ন, মানবপুঁজি গঠন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। তবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার এ পর্যায়ে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন ব্যয় তা খুব বেশি নয়। মূলত অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণেই সামাজিক অবকাঠামো খাতসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কমছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আহরণ হতাশাজনক। কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ঝুঁকির মধ্যে আছে অনেকদিন ধরে। রাজস্ব আয় কম, ব্যয় বেশি। তাই ধার করেই চলতে হচ্ছে সরকারকে। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। সরকারের এই ঋণ গ্রহণ মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংক নির্ভর। যদিও দিন দিন বাজেটের আকার বড় হচ্ছে, কিন্তু মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে বাজেট বরাদ্দ বাড়ছে না।
পরিশেষে বলতে চাই- একটি সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে যেমন দক্ষ ব্যক্তি এবং অর্থের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি একটি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও অর্থের প্রয়োজন। আর সেই অর্থ ব্যয যদি হয় পরিকল্পিত, যথাযথ তাহলে সেটি হবে প্রশংসনীয় এবং টেকসই। ১৯টি জেলা নিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল, এ অঞ্চলের মানুষ সব সময়েই অবহেলিত; উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য শুধু বাজেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না, এসির মধ্যে থেকে নীতিমালা, আইন, বাজেট না করে এ বাজেট তৃণমুলে সময়োপযোগি পরিকল্পনা নিয়ে প্রকল্প তৈরী করে ব্যয় করা এবং সরকারের স¦ল্প ও দীর্ঘমেয়াদী টেকসই নীতি, উপকূল উন্নয়ন বোর্ড এবং উপকূল মন্ত্রনালয় গঠণ এখন সময়ের দাবি মাত্র।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
বাজেট ভাবনা: উপকূলের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে মুক্তমত শফিকুল ইসলাম খোকন