ফারাক্কা বাঁধ: বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ, ভারতের জন্য আত্মঘাতী
১৬ মে ২০২৪ ১৪:২৮
ফারাক্কা বাঁধের ফলে নদীর নাব্যতা কেড়ে নেওয়ার আশঙ্কায় ও পানি ন্যায্য হিস্যার দাবীতে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সারাদেশের লাখ লাখ মানুষ রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দান থেকে মরণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চে অংশ নেন ও লংমার্চ শেষে কানসাট হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সেদিন থেকেই ১৬ মে ফারাক্কা দিবস নামে পরিচিতি লাভ করে।
দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জনদুর্ভোগের জন্য তারা ওইদিন লংমার্চ করে ভারত সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানায়। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেন মহান নেতা মাওলানা ভাসানী। তাই এ দিনটি আজও শোষণ, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং দাবি আদায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে পানিশুন্য করতে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কি.মি. দূরে ভারতের মনোহরপুরে দেওয়া হয় ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭০ সালে শেষ হয় বাঁধটির নির্মাণকাজ। তখন পরীক্ষামূলকভাবে ভারত কিছু কিছু পানি ছাড়ে। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কার বাঁধ চালু হয়। ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করে ১৯৭৬ থেকে একতরফাভাবে পানি নিজ দেশের অভ্যন্তরে ফিডার ক্যানেল দিয়ে প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে। ফলে ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চাহিদানুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিতই হচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে, শীতকালের শুষ্ক মৌসুমেও পদ্মা নদী থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পেত বাংলাদেশ।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি ইস্যু নিয়ে ৩০ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেন। কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই সে চুক্তি ভারত অকার্যকর করে দেয়। ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ মাত্র ছয় হাজার ৪৫৭ কিউসেক পানি পায়, যা ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর সর্বনিম্ন প্রবাহ ছিল। অথচ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের পানি পাওয়ার কথা ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক। ১৯৭৭ সালের পানি চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল, কিন্তু এ চুক্তিতে তা না থাকায় ভারত বাংলাদেশকে তার ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য ছিল না। ফলে বাংলাদেশ পানি কম পেলেও তার প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই। এছাড়া চুক্তিটিতে আন্তর্জাতিক সালিসিতে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। অথচ নেপালের সাথে মহাকালী নদী চুক্তিতে ভারত আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন মেনে নিয়েছে। কাজেই গঙ্গা নদীর পানি নিয়ে ভারতর সাথে যে পানি চুক্তি করা হয়েছে, তা ত্রুটিপূর্ণ এবং বাংলাদেশের অনুকূলে নয়। এ চুক্তির সফলতা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। এর কারণ গ্যারান্টি ক্লজ বা অঙ্গীকার অনুচ্ছেদ না থাকা। বাস্তবে চুক্তির ফলাফল প্রায় শূন্য। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ২০০১ সাল ২০১৫ সাল পর্যন্ত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের পানি মিলছে মাত্র ৩ বছর।
ফারাক্কা বাঁধের বিরুপ প্রভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা, মহানন্দাসহ দেশের বড় বড় সব নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলে হয়ে পড়েছে পানিশূন্য বালির চরাঞ্চল। ফারাক্কা ব্যারেজের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মাসহ অন্য তিন নদী মহানন্দা, পাগলা ও পূনর্ভবা শুকিয়ে যাচ্ছে। পানি না থাকায় পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরুপ প্রভাব। পানি বিশ্লেষকগণ বলেছেন, উজানে একাধিক বাঁধ দিয়ে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় ফারাক্কা পয়েন্টেই পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হতে যেতে পারে।
ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মাসহ চার নদীই এখন মৃতপ্রায়। নদীতে এখন পানির প্রবাহ নির্ভর করে ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না, আবার বর্ষায় হঠাৎ পানি ছেড়ে দিলে বন্যা এবং নদীভাঙন দেখা দেয়। পরিবেশবাদীরা বলছেন, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
সেভ দ্য নেচারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বলেছে, পদ্মায় পানি না থাকায় পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উদ্ভিদ ও জীবচক্র। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক জানায়, ফারাক্কা ব্যারাজের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মাসহ অন্য তিন নদী- মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা শুকিয়ে যাচ্ছে, ব্যারাজ নির্মাণের পর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নদীতে নাব্যসংকট দেখা দিয়েছে। এখন প্রয়োজনীয় পানি পেলেও তা ধরে রাখা যায় না। আর ফারাক্কা ব্যারাজের দরজা হঠাৎ খুলে দেওয়ার কারণে বন্যা ও নদীভাঙন প্রবণতা বাড়ছে।
আজ থেকে ৪৮ বছর আগে আজকের এই ১৬ই মে তারিখেই ভারতে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে লংমার্চে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহান নেতা মাওলানা ভাসানী। তখন থেকেই বাংলাদেশে এই দিনটি ‘ফারাক্কা লং মার্চ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে, যদিও বিগত পাঁচ দশকে ফারাক্কা নিয়ে ভারতের অনড় অবস্থানে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।
বস্তুত সাতের দশকের মাঝামাঝি ভারত যখন গঙ্গার বুকে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করেছিল, তারপর থেকে বিতর্ক কখনওই এই প্রকল্পটির পিছু ছাড়েনি। সম্প্রতি ভারতেও ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত জোরালো হচ্ছে—বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তো ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে ফেলারও প্রস্তাব করেছেন। মেধা পাটকরের মতো অ্যাক্টিভিস্ট ও অনেক বিশেষজ্ঞও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ভারতেও ফারাক্কা এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে—কাজেই এটি অবিলম্বে ‘ডিকমিশন’ করা দরকার। আর সে জন্য মাওলানা ভাসানীর মতো একজন সিংহপুরুষের বড়ই দরকার এই সময়ে। অশীতিপর এ মানুষটি ভগ্নশরীর নিয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে জাতিকে এককাতারে সমবেত করতে ডাক দিয়েছিলেন। তার সে ডাকে লাখ লাখ মানুষ সাড়া দিয়ে আগ্রাসী শক্তির ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
তথ্যউপাত্ত আর বিশ্লেষণ বলছে, বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের জন্যই এই ফারাক্কা বাঁধ এখন সুফল বয়ে আনছে না। উল্টো অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাই, দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকা অকল্যাণকর এই ফারাক্কা বাঁধ সমস্যার কার্যকর সমাধান হোক। ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবসে এই প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান ইমন ফারাক্কা বাঁধ: বাংলাদেশের অভিশাপ- ভারতের জন্য আত্মঘাতী মুক্তমত