Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এলডিসি থেকে উত্তরণ: চ্যালেঞ্জও কম নয়

ড. মিহির কুমার রায়
১৬ মে ২০২৪ ১২:৫৭

গত ২৮ মার্চ একনেক সভায় এলডিসি উত্তরণের পর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশন হবে। এখন থেকে এ নিয়ে কাজ করতে হবে। সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অল্প টাকা দিলে কাজ শেষ হবে সেসব প্রকল্প দ্রুত বরাদ্দ নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা। এটি চলতি অর্থবছরের ৮ম সভা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব, কৃষি, পানি ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য , পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এবং ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য।

বিজ্ঞাপন

তাত্বিক বিশ্লেষনে দেখা যায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে বিশ্বের দেশগুলোকে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত হিসেবে বিভাজন করা হয়ে থাকে। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে জাতিসংঘের উদ্যোগে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। এলডিসি বা স্বল্পোন্নত থেকে কোন কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ জন্য তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচকের ভিত্তিতে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কিনা, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা এর নিচে থাকতে হবে। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পেতে হবে। মাথাপিছু আয় সূচকে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার থাকতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৮ ও ২০২১ সালের মূল্যায়নে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচকেই মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেই সময়ে ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছিল সিডিপি। সাধারণত সিডিপির চূড়ান্ত সুপারিশের তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু করোনার প্রভাব মোকাবিলা করে প্র¯ুÍত নিতে বাড়তি দুই বছর সময় দেওয়া হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশও বাড়তি সময় চেয়েছিল সিডিপির কাছে। সে হিসাবে এলডিসি থেকে বের হতে বাংলাদেশকে ২০২৬ সাল পর্যšন্তঅপেক্ষা করতে হবে। প্রস্তুতির এ সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে। উল্লেখ্য, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলো বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে-যেমন, শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা, জিএসপি সুবিধা ইত্যাদি।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এসব সুবিধা আর পাবে না। তখন এলডিসির দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশকে রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে রপ্তানির পরিমাণ কমেও যেতে পারে া স্বল্পোন্নত দেশ হতে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখাসহ মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে বেসরকারী খাত ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় নীতিকৌশল ও পদক্ষেপ প্রণয়ন করছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তারপর ১৩টি ক্ষেত্রে সুপারিশমালা দিয়ে এলডিসি উত্তরণে ‘এ্যাকশন প্লান’ তৈরি করেছিল পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। কোন মন্ত্রণালয়, সংস্থা বা অধিদফতর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে সেটিও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, এলডিসি উত্তরণের ‘পলিসি মোট্রিক্স ফর কপিং আপ উইথ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন’ নামে একটি সুপারিশমালা দিয়েছিল জিইডি। এর মধ্যে রাজস্ব নীতি, মুদ্রা নীতি, শিল্প ও বাণিজ্য নীতি, অবকাঠামো খাত উন্নয়ন, সরকারী- বেসরকারী অংশীদারিত্ব (পিপিপি) এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মতো কর্মসূচী রয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর কিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আসবে। কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলেও সুযোগও তৈরি হবে অনেক। সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। এ লক্ষ্যেই পলিসি মোট্রিক্স ফর কপিং আপ উইথ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন শীর্ষক একটি সুপারিশমালা তৈরি করা হয়েছে।

যেসব ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ তা হলো: এক: জাতিসংঘের এই স্বীকৃতির ফলে বিশ্ববাজারে বর্তমানে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা বর্তমানে পায়, তা বন্ধ হওয়ার সময় গণনা শুরু হলো যেমন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠলে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া এবং বিভিন্ন রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক আইনকানুনের অব্যাহতিও থাকবে না, যদিও এ ক্ষেত্রে আমরা আরও বেশি সময় পাব;দুই: কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে;তিন: ২০১৬ সালেই বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশকে ‘বে¬ন্ড কান্ট্রি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উচ্চ সুদ পরিশোধে অভ্যন্ত হয়েছে সুতরাং সহজ শর্তে ঋণ না পেলেও খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়; চার: উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা মোকাবিলায় প্র¯স্তুতি নিতে হবে। বিশ্ববাজারে বিপণন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। তবে মূল সমস্যা হলো, একমাত্র ভুটান ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ বা পিটিএ নেই। উন্নত দেশগুলো ছাড়াও ভারত ও চীনের মতো বড় বড় উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ করতে হবে। দেশের বাণিজ্যে স্থানীয় শিল্পের জন্য সুরক্ষা কমানো না হলে অন্য দেশ পিটিএ বা এফটিএতে আগ্রহী হবে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি রয়েছে । পাঁচ: ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জিএসপি প¬াস পাওয়ার জন্য চেষ্টা অব্যাহত নাখতে হবে। যদি জিএসপি প¬াস পাওয়া কঠিন হয় বা পাওয়া না যায়, তাহলে এর বিকল্প কিছু পেতে হবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে যে ধরনের সুরক্ষাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাপাসিটি থাকা দরকার, তার ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির এই প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি দেশের ভেতরেও প্রতিযোগিতা বাড়াতে অভ্যন্তরীণ অনেক কাজ করতে হবে। ছয়: পরিবহন, বন্দর, আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন করার মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিতে ব্যয় কমানো যেতে পারে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে এবং বিদ্যুতের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। কাজেই শুধু আন্তর্জাতিক বাজার সুবিধার দিকে নজর রাখলে চলবে না বরংচ। বাজার সুবিধা না থাকলেও যে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারি, সে দৃষ্টান্ত আমাদের আছে। সাত: স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেসরকারি খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রস্তুতির এই সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকবে। তা ছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে।; অষ্ঠমত: তবে কিছু কৌশল গ্রহণ করা গেলে সহজেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে । তবে দেশের প্রধান রফতানিপণ্য তৈরি পোশাক রফতানিতে জিএসপি প্লাস এবং স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি পাওয়া যেতে পারে। তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে শ্রম অধিকার, কারখানার কর্ম পরিবেশ এবং মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭টি শর্ত পরিপালনের শর্ত দিয়েছে ইইউ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব শর্ত পালনে বেশ কিছু কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ঘটনা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। গরিব দেশগুলোকে সহজ শর্ত ও কম সুদে ঋণ দেয় উন্নয়ন সহযোগীরা। এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। অবশ্য এখন আর বাংলাদেশকে গরিব দেশ হিসেবে দেখে না দাতারা। ২০১৬ সাল থেকে মিশ্রিত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

এলডিসি থেকে বের হওয়ার অনেক সুবিধাও রয়েছে যেমন এক:এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে। উন্নয়নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ;দুই: আন্তর্জাতিক বাজারে নাগরিকদের কদর বাড়বে এবং উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে আত্ম মর্যাদা পাব ; তিন: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন, দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে ও বাংলাদেশের বড় ধরনের ব্র্যান্ডিং হবে; চার: বর্তমান অর্থনীতি উদীয়মান এবং এখানে বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছে- এমন বার্তা বিশ্ববাসী পাবে এবং এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম হচ্ছে, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়াযা বাংলাদেশ এ শর্ত পূরণ করতে পেরেছে বিধায় অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম ঝুঁকি রয়েছে। ইতোমধ্যে ১১টি দেশের সঙ্গে এ সংক্রান্ত সম্ভাব্যতা ও সমীক্ষা যাচাই করা হয়। ভুটানের পর এবার নেপালের সঙ্গে পিটিএ করা হবে। এরপর ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গে পিটিএ করা হবে। শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে পিটিএ, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এফটিএ এবং বৃহৎ অংশীদারিত্ব বাণিজ্য চুক্তির (সিপা) মতো বড় বড় চুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে রফতানিতে জিএসপি প¬াস সুবিধা নিশ্চিত করতে চায়

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

এলডিসি থেকে উত্তরণ: চ্যালেঞ্জও কম নয় ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর