শুধু ভালো ফলাফল নয়, দক্ষতাও জরুরি
১৭ মে ২০২৪ ১৭:২৪
দেশে শিক্ষার চরম বাস্তবতা এখন সনদকেন্দ্রিক। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই এখন সনদ অর্জন করা। এমনিতেই দেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে সিলেবাসভিত্তিক পড়াশোনা করানো হয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও এই অদ্ভুত ধারণা বিদ্যমান। সেখানে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে সিলেবাস ভিত্তিক কিছু রসহীন কথা দায়সারাভাবে বলে যাচ্ছেন। এতে শিক্ষার প্রকৃত যে উদ্দেশ্য সেটা ব্যাহত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে পাঠ্যসূচির পরিবর্তনের চিন্তা সবাই করেন। কিন্তু শিক্ষার প্রাণ সংশোধনের দিকে মোটেই মনোযোগ দেয়া হয় না। অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষাগুরুর চারিত্রিক সংশোধন এবং সংস্কারসুলভ প্রশিক্ষণের উপর জোর দেয়া হয় না। ফলে হাজারো চেষ্টা যত্নের পর-ও কৃতি পুরুষের সৃষ্টি হয় না, যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও বলিষ্ঠতা অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং অন্যকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে।
২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন। তাদের মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ পাসের হার ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। আগের বছরের চেয়ে পাসের হার বেড়েছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ কমেছে ১ হাজার ৪৪৯।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক অধ্যাপক বলেছেন, আমাদের দেশে শিক্ষার মানের কতটুকু উন্নতি ঘটল, এটা বোঝাতে সাধারণভাবে পাসের হারকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পাসের হার যে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না তার প্রমাণ এইচএসসির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ব্যর্থতা। প্রতিবছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করে। অথচ এসব পাস করা শিক্ষার্থীর শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর তুলতে পারে না।
এখন শিক্ষা মানে জিপিএ-নির্দেশক একটি সার্টিফিকেট। সেটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কতটা সুবিধা দেবে কিংবা চাকরির বাজারে কতটা এগিয়ে রাখবে, এটা নিয়েই ভাবনা সবার। জিপিএ-৫ নিশ্চিত করার জন্য অভিভাবকেরা সবকিছু করতে প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু এই জিপিএ ও নম্বর শিক্ষার্থীর দক্ষতা বা পারদর্শিতা যথাযথভাবে নির্দেশ করে না। আর কৃতকার্য–অকৃতকার্যের হার দেখে কিংবা আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করে শিক্ষার অগ্রগতি-উন্নতি নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়।
শুধু তাই নয় হাতেগোনা যে কয়জন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় তারাও পরবর্তীতে দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করার ব্যাপারে মনযোগী হয়না। চান্স পাওয়ার পরেই অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এলোমেলো চলাফেরা, বিশৃঙ্খল জীবন-যাপন তাদের নিত্যনৈমত্তিক রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। শুধু পরীক্ষার আগে কিছু শিট মুখস্থ করে তারা পার পেয়ে যায়।
এরকম চলতে থাকলে একটি দেশ খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার ছন্দ হারিয়ে ফেলবে। দেশের মূল চালিকা শক্তি তরুণ প্রজন্ম। তারা যদি দক্ষতা-যোগ্যতার বদলে শুধু সনদ কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা করে তাহলে তাদের জন্যও সেটা ব্যুমেরাং হবে।
অনেক ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষার্থী এখন নতুন কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে পারেনা বা নতুন কোন ধারণার অবতারণা করতে পারেনা। সিলেবাসভিত্তিক পড়াশোনা আর কৌশলে ভাল রেজাল্ট করার কারণে তারা বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করা, সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করে নিজের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো বা অন্যান্য সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে অনুৎসাহী থাকে। তারা প্রচলিত সমাজের ধারণা অনুযায়ী মনে করে রেজাল্ট ভালো হলেই হলো, অন্যান্য প্রতিভা বা সৃজনশীলতার বিশেষ প্রয়োজন নেই।
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাষাগত সমস্যাও বিদ্যমান। অন্তত দুইটি ভাষায় পারদর্শীতা অর্জন করলে বিশ্বমানের হওয়া যায়। যেটা ভারতীয়রা করে দেখাচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাইভেট সেক্টরে ভারতীয়রা কাজ করছে। যদি দেশেই যোগ্য ক্যান্ডিডেট থাকত নিশ্চিই ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন হতনা।
প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার বহুমুখী উপকার করলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনা। মার্শাল ম্যাকলুহানের মতে বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে বিভিন্ন দেশের সভ্যতা-ভব্যতা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব দ্রুতই জ্ঞান লাভ করা যায়। জ্ঞান অর্জনের এই দিকটাতেও শিক্ষার্থীরা মনযোগ দেয়না।
সনদকেন্দ্রিক পড়াশোনা দেশে বেকারত্ব সমস্যা বাড়ার অন্যতম কারণ। দক্ষতা-যোগ্যতার সাথে সনদকে প্রাধান্য দিলে মূল বিষয়টি ঠিক থাকত সেই সাথে উদ্দ্যেশও হাসিল হত। সনদের সাথে সঠিক এবং সময়োপযোগী দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করলে দেশেরও উপকার হবে, বেকারত্বও অনেকাংশে কমে যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস