জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সংশয় কাটেনি
২০ মে ২০২৪ ১২:২৩
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.৭৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.০৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে শিল্প খাতে, ৩.২৪ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ শতাংশ। সরকার চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ৭.৫০ শতাংশ। যদিও এ লক্ষ্যমাত্রাকে ‘উচ্চাভিলাষী’ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে তুলনামূলক রক্ষণশীল প্রক্ষেপণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবিও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বড় কোনো সমস্যায় নয়, বরং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব, ডলার সংকট ও আর্থিক খাতের দুর্দশার কারণেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমছে। আর আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল কম আসায় শিল্প খাতে উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করায় প্রবৃদ্ধি কমাটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এটাকে মেনে নেয়ারও পরামর্শ তাদের। খাতসংশ্লিষ্টরা যদিও বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট সমাধান না হলে ভবিষ্যতে শিল্পোৎপাদন আরো কমে আসবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানতে প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি হিসাব প্রকাশ করছে বিবিএস। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত দুই অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে কম। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৩০ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৭.০৮ শতাংশ। এবার তা কমে ৩.৭৮ শতাংশে নেমেছে। শিল্প ও সেবা খাতের সংকোচনের কারণেই মূলত এ পতন। খাতভিত্তিক হিসেবে জিডিপিতে শিল্পের অবদান কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। সেবা খাতের অবদানও নেমেছে অর্ধেকে। তবে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি সামান্য বেড়েছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে বড় কোনো সমস্যার কারণে এমনটা ঘটেনি। কোনো দুর্যোগ কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কোনো ঘটনাও ঘটেনি; বরং দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব, ডলার সংকট ও আর্থিক খাতের দুর্দশার কারণেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে আসছে। ডলার সংকট পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তৃতীয় প্রান্তিকেও একই চিত্র থাকবে। আর এতে শিল্প খাতই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।’
ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের খাতভিত্তিক তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতের অবদান ছিল মাত্র ৩.২৪ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১০ শতাংশ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে সাড়ে ১৪ শতাংশ। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণেই শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট। তার মতে, ‘শিল্পের উৎপাদন প্রতিনিয়ত কমছে। এটার বাস্তব চিত্রই এসেছে বিবিএসের পরিসংখ্যানে। যেখানে গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই সেখানে কীভাবে উৎপাদন বাড়বে? গ্যাস না দিলে সামনে শিল্পের উৎপাদন আরো কমে আসবে। আমরা ব্যাংক ঋণে জর্জরিত। এভাবে ব্যবসা করার জন্য তো আর শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলিনি। তাই আমরা এখন নিরাপদে ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার সুযোগ খুঁজছি।’ এদিকে জিডিপিতে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও কমেছে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ খাতের অবদান ছিল ৩.০৬ শতাংশ, আগের অর্থবছরে যা ছিল ৬.৬২ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় জিডিপিতে সেবার অবদান কমেছে অর্ধেক। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতের অবদান ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি অবশ্য বিষয়টিকে সাময়িক সমস্যা বলে মনে করছেন।তার মতে, ‘গত নির্বাচন ও বৈশ্বিক কারণে কিছুটা সমস্যা হলেও সামনে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য এরই মধ্যে ব্রাজিল থেকে বড় একটি প্রতিনিধি দল দেশে এসেছিল। আগামীতে কাতার, সৌদি আরব ও কানাডা থেকেও প্রতিনিধিরা আসবেন।’ চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শুধু কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা ইতিবাচক ছিল। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষির অবদান ছিল ৪.৬৫ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪.২২ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ছিল ২.২০ শতাংশ।
প্রবৃদ্ধি কমে আসাকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপের প্রতিফলন বলে মনে করছেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সুদহার বাড়ায় বিনিয়োগ কমেছে। রফতানি স্মিমিত হয়েছে। সরকারের এডিপি বাস্তবায়নও কমেছে। তাই প্রবৃদ্ধি কমেছে। তবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রবৃদ্ধির সংকোচন মেনে নিতে হবে।’ মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সেদিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এটার জন্য স্থিতিশীলতা আসছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দিতে হবে। শুধু সংকোচনমূলক নীতিতে কাজ হবে না।’ চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংকও। তারা বলছে, এ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ . ৬ শতাংশ। যদিও গত এপ্রিলে ৬.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আভাস দিয়েছিল সংস্থাটি। নানাবিধ চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণ করে প্রবৃদ্ধি হ্রাসের এবং মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার কথা বলছে বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে দেশের জিডিপি ৬.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। দুই সংস্থার পূর্বাভাসের ব্যবধান .০৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। অন্যদিকে সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭.৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরেও সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একই ছিল। তবে সরকারের উচ্চাভিলাষী এ লক্ষ্য অর্জন হবে না বলে মনে করছেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দুই প্রান্তিক অতিবাহিত হওয়ার পর সরকারের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বাকি দুই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হতে হবে সাড়ে ৮ বা ৯ শতাংশ। কিন্তু এটা এখন কোনোভাবেই সম্ভব না। গত বাজেটের আগেই অর্থনীতিবিদরা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানোর কথা বলেছিলেন।’ সার্বিক বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি কমবে এটা বোঝাই যাচ্ছিল। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। সুদহার বাড়ানো হয়েছে। তাই বিনিয়োগ বাড়েনি। বিদেশী বিনিয়োগও নেই। মূল্যস্ফীতি বেশি। মুদ্রা সংকটে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে উৎপাদনের উপকরণও কমেছে। শিল্পে এটার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে। তবে নানা সংকটের মধ্যেও কৃষি ভালো করছে। তাই বছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হতে পারে।’
সামনে বাজেট আসছে,সরকার অতি শতর্কতার সাথে অর্থনীতির চলকনিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আসা করা যায় বাজেট প্রদানে নতুন অর্থমন্ত্রী জনগনের আশা পুরনে সমর্থ হবেন এই আশা রইল।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ও এলকপ মনোনীত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষন টিমের সদস্য
সারাবাংলা/এসবিডিই
জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সংশয় কাটেনি ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত