সব শিশুই যেন হাসিমুখে ফিরে মায়ের কোলে
২২ মে ২০২৪ ১৩:৫১
বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে বিশ্ব মা দিবস। এবার দিবসটির সূচনা লগ্নে, নিষ্পাপ শিশুরা স্কুল থেকে দেয়া ফুল নিয়ে যখন মাকে শুভেচ্ছা জানাতে বাসায় ফিরছিল, ঠিক তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মায়ের বুকে শুয়ে থাকা আহত এক শিশুর কান্নার ছবিটি। শিশুটির বয়স দুই বছর। নাম মেহেদি হাসান। তার মায়ের নাম জায়েদা (৩২)। তিনি সিলেট সুনামগঞ্জ জেলার দুয়ারা উপজেলার খুশিউড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. রমিজ উদ্দিনের মেয়ে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর মা ও শিশুকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মা মারা যান।
অজ্ঞান থাকা অবস্থায় শিশুটিকে মায়ের দুধ খাওয়ানো হয়েছে। কিন্তু শত চেষ্টা ব্যর্থ করে পরপারে চলে যান মা। কান্না থামে না আহত অবুঝ শিশুটির। তার কান্নায় কেঁদেছেন হাসপাতলের রোগী থেকে শুরু করে তাদের স্বজনরা। সবাই মায়ের মমতা দিয়ে তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন। পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় বারবার মায়ের কাছে নিয়ে গেছেন শিশুটিকে।
শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তো মায়ের কোল। সে তো দুর্ঘটনা বোঝে না। বোঝে না মৃত্যু, আহত বা চিকিৎসার কোন কিছুই। নিজেই যখন আক্রান্ত, তখন তার কাছে সবচেয়ে প্রশান্তির জায়গা মা। এটুকুই শিশুটির জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। তা না পেয়ে মেহেদী রীতিমতো অস্থির ছিল। দু’চোখ বেয়ে অঝোরে ঝড়ছিল পানি। তার কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে হাসপাতালের পরিবেশ। যেন পাষাণ হৃদয়ও ডুকরে কেঁদেছে মনের অজান্তে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই ঘটনার কয়েকটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। আহত মাকে বুকে শুয়ে থাকা শিশুটির কান্নার ছবি। অন্যটি হাতাপাতালের মানুষের কোলে তাকে পরম মমতায় আগলে রাখার ছবি।
জায়েদা ও তার শিশুটি সড়ক দুর্ঘটনায় কেমনে আহত হয়েছে এর বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। দুর্ঘটনার তথ্য দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেন কিছু হৃদয়বান মানুষ। সারাদেশের সড়কপথ যে অনিরাপদ এই দুর্ঘটনা একটি বড় নমুনা। সেইসঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা মানুষকে কতোটা অসহায় করে তুলতে পারে, তার বড় বাস্তবতা হলো এই শিশুটি। গত সোমবার এই শিশুটিকে মামার জিন্মায় নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশে দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনা রোধে নানামুখি পদক্ষেপের কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু সকল সূচকে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। তেমনি নীতি নির্ধারকরা দুর্ঘটনা প্রতিকারে আঁটঘাট বেধে মাঠে নেমেছেন তা বলা যাবে না। যখন ঘটনা ঘটে তখন কয়েকদিন হইচই হয়। তারপর সবকিছু স্বাভাবিক। সড়ক অনিরাপদ থেকেই যায়।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৭৩ জন নিহত হয়েছিল। সে মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ১৮ দশমিক ৪৮ জন। এপ্রিলে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছে ২২ দশমিক ৬৩ জন। অর্থাৎ প্রায় ২৩ জনের প্রাণ গেছে প্রতিদিন। এই হিসাবে এপ্রিল মাসে প্রাণহানি বেড়েছে ২২ দশমিক ৪৫ ভাগ। এপ্রিলে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮টি পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাদের কেউ বেঁচে নেই।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এপ্রিল মাসের সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানব সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য ২ হাজার ১ শত ১৯ কোটি ১১ লাখ ৯৬ হাজার টাকার মতো। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য অপ্রকাশিত থাকে, সেজন্য এই হিসাবের সাথে আরও ৩০ ভাগ যোগ করতে হবে। ওজঅচ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ জড়ধফ অংংবংংসবহঃ চৎড়মৎধস) সবঃযড়ফ অনুযায়ী হিসাবটি করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ যানবাহন বা প্রপার্টি ড্যামেজ হয়েছে তার তথ্য না পাওয়ার কারণে প্রপার্টি ড্যামেজের আর্থিক পরিমাপ নির্ণয় করা যায়নি। উল্লেখ্য, গণমাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, দেশে প্রায় সোয়া ছয় লাখ যানবাহন চলছে ফিটনেসবিহীন। রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের বিপরীতে ১৫ লাখের বেশি চালক সংকট আছে। সেইসঙ্গে বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের আনুমানিক হিসাব বলছে, সারাদেশে অনিবন্ধিত অটোরিক্সা ও বেটারীচালিক রিক্সা চলছে কমপক্ষে ৪০ লাখ। এসব চালকদের কেউই প্রশিক্ষিত নয়। তেমনি মোট যানবাহনের ৭০ ভাগের বেশি এখন মোটরসাইকেল। বিপজ্জনক এই যানের চালকদের একটা বড় অংশের লাইসেন্স নেই। একজনের বাইক তুলে দেয়া হচ্ছে অন্যজনের হাতে। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নিরাপদ সড়কের কথা চিন্তা করা সত্যিই কঠিন। তেমনি সরকার ও উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েও দেশের ২১টি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে পারেনি। এছাড়া সড়কে কেন দুর্ঘটনা হচ্ছে এই রোগ কিন্তু অনেক আগেই চিহ্নিত করা গেছে। কিন্তু রোগ অনুযায়ি দাওয়াই দেওয়া হচ্ছে না। এলোমেলো প্রতিকারে কোন সমস্যাই নির্মূল করা যাচ্ছে না। এখন বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের ঋণের অর্থ ছাড় হলেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পদক্ষেপ দৃশ্যমান হবে!
দুর্ঘটনা নির্মূলের অপেক্ষা করতে গিয়ে মেহেদি হাসানের মতো অনেক শিশু এতিম হচ্ছে। অনিশ্চিত হচ্ছে তাদের জীবন। শত প্রচেষ্টা, স্নেহ, ভালোবাসা আর শান্তনায় মেহেদীর কী মায়ের অভাব পূরণ হবে। মায়ের অভাবে শিশুটির নিরাপদ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা কে দেবে? এর দায়ও তো কেউ নেবে না।
পৃথিবীর মধুরতম ডাক মা। ছোট্ট এ শব্দের অতলে লুকানো থাকে গভীর স্নেহ, মমতা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা। এই ভালোবাসা তো কেড়ে নিল দুর্ঘটনা নামক আচমকা দানব।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সবশেষ আশ্রয়স্থল মা নামের ওই মমতাময়ী নারীর আঁচল। সেই আঁচল তো মেহেদীর হাত থেকে আজীবনের জন্য ছুটে গেল। অল্পের মধ্যেই পৃথিবীর অসহায় শিশুদের তালিকায় নাম উঠল মেহেদীর।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, নিহত জায়েদা ভালুকার স্কয়ার মাস্টার বাড়ি এলাকায় শিশু মেহিদকে নিয়ে বসবাস করতেন। তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিল কাপাশিয়ার বাসিন্দা ফারুক মিয়ার সঙ্গে। তার ঘরে প্রথম স্ত্রীসহ তিনটি সন্তান রয়েছে। এ কারণে তার দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি পরিবার মেনে নেয়নি। ফলে জায়েদা স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় ভালুকার স্কয়ার মাস্টার বাড়ি এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।
গত ৯ মে রাত ৩টার দিকে ভালুকা উপজেলার স্কয়ার মাস্টার বাড়ি এলাকায় কোলের শিশুটিকে নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন মা জায়েদা। তিনি প্রাণ হারালেও বেঁচে যায় শিশুটি। অর্থাৎ পারিবারিকভাবেও শিশুটি বেড়ে উঠার নিরাপদ পরিবেশ নেই। বাবার কাছে তার আশ্রয় পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাহলে দুগ্ধপোষ্য শিশুদের সুরক্ষা কোথায়? এটি প্রশ্নের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে।
সবশেষ কথা হলো, নিরাপদ সড়কের কোন বিকল্প নেই। দেশে একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ যেমন জরুরি তেমনি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে শিশু মা হারিয়েছে তার কষ্ট কি অর্থের মানদ-ে পরিমাপ করা যাবে? কিংবা যারা সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারিয়েছেন তারাই বোঝেন বেদনার রাত কতো দীর্ঘ। কত যন্ত্রণাময়। ঝীবনকে কতোটা অসহায় কওে তোলে।
তাই সরকারের নীতি নির্ধারক যারা আছেন, তারা সড়কের রোগ জানতে পেরেছেন। এখন পুরোদমে চিকিৎসা শুরু জরুরি। প্রতিটি বিশ^ মা দিবসে যেন কোন সন্তান এতিম বা অসহায় না হয়। যেন পথ না হারায়। তারা যেন হাসিমুখে ও নিরাপদে মায়ের কোলে ফিরতে পারে। সকলের সম্মিলিত পদক্ষেপে নিরাপদ হউক পথ। নিরাপদ থাকুন আগামী প্রজন্ম।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত রাজন ভট্টাচার্য সব শিশুই যেন হাসিমুখে ফিরে মায়ের কোলে