শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং মানবতায় গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা
২২ মে ২০২৪ ১৫:২৫
সব ধর্ম-বর্ণ মিলেমিশে থাকার শত-শত বছরের ঐতিহ্যের নাম বাংলাদেশ। এই দেশেই আসে ঈদ, দুর্গা পূজা, বুদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিনসহ আরও অনেক ধর্মীয় উৎসব। ধর্মের শিক্ষা ও নীতিগুলো মানুষকে সত্যের পথে, সুন্দরের পথে পরিচালিত করে। প্রতিটি ধর্মই মানবতার কথা বলে। একের পর এক এসব উৎসবের আমেজে সারাবছর দেশে আনন্দপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে। কয়েকদিন আগেই গেলো মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। সামনেই রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই দিনটি অন্য নামেও পালন করা হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা বৈশাখী পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ পূর্ণিমা নামের এই মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের কাছে এই দিনটি অতি পবিত্র। কারণ এই দিনেই ভগবান বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বোধিসত্ত্ব লাভ করেছিলেন এবং মহানির্বাণ লাভ করেছিলেন। এরকম এক বৈশাখী পূর্ণিমাতেই তিনি নিজ গৃহ ছেড়েছিলেন এবং মানুষের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়েছিলেন। তিনি এক নতুন ধর্মের পথ দেখান। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যান্য দেশেও এই উৎসব মহা আনন্দের ভক্তিসহকারে পালিত হয়। এই দিন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এই দিনটির আরও বিশেষত্ব হলো দিনটি হিন্দু ধর্মের মানুষের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গৌতম বুদ্ধ ভগবান শ্রী বিষ্ণুর নবম অবতার বলেই গণ্য করা হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটি পালন করে থাকেন। এই দিনে তারা স্নান শেসে শুচিবস্ত্র পরিধান করে ভগবান বৌদ্ধের মন্দির প্যাগোডায় প্যাগোডায় প্রার্থনায় রত থাকেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। পূজার পাশাপাশি তারা পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপাঠ, সমবেত প্রার্থনা করে সময় কাটান। একটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটি অত্যন্ত পবিত্র। জানা যায়, এই দিন উপলক্ষ্যে দেশের সবচেয়ে বড় মেলা বসে চট্রগ্রামের বৈদ্যপাড়া গ্রামে। মেলায় বিভিন্ন ধর্মের শিশু-কিশোর-যুবারা ভিড় করেন। সারাদিন আনন্দে সময় পার করেন। ১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ’ওয়াল্ড ফেলোশিপ অফ বুদ্ধিস্ট’ এর প্রথম কনফারেন্সে বৈশাখ মাসের এই পূর্ণিমা তিথিটিতে বুদ্ধের জন্মদিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রাণ গৌতম বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের তরাই অঞ্চলের কপিলাবস্তুও লুম্বিনী উদ্যানে শাক্য নামে এক ক্ষত্রিয় রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল শুদ্ধোধন এবং মাতার নাম ছিল মায়াদেবী। গৌতম বুদ্ধের জন্ম তারিখ নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে তিনি ৫৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। একটি রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও রাজপরিবারের ধনসম্পদ, বিত্ত-বৈভব তাকে টানতে পারেনি। একসময় তিনি মানব জীবনের চরম সত্যগুলো অনুধাবন করতে শুরু করেন। একদিন তিনি নগর পরিদর্শনে বেরয়ে রাস্তায় জরাগ্রস্থ বৃদ্ধ এবং এক মৃতদেহ দেখে তার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। এরপরেই তিনি জীবনের প্রকৃত সত্য নিয়ে ভাবতে থাকেন। মানব জীবন নানাভাবে দুঃখ কষ্টে জর্জরিত। সুখের বিপরীতে বেশিরভাগ অংশেই দুঃখ। তিনি মানুষের নিয়তি সুখের বিপরীতে দুঃখ, কষ্ট, জরা, ব্যাধি দেখে ভাবিত হন। এবং মানুষের চরম পরিণতি মৃত্যু নিয়ে ভাবিত হন। তিনি ভাবেন যদি মানুষের চরম পরিণতি মৃত্যু হয় তাহলে এই ধন-সম্পদে মানুষের কি শান্তি আছে। একজন রাজকুমার, রাজসুখ, রাজ ক্ষমতা এসব পরিত্যাগ করে সন্যাসী বেশে তিনি বেরিয়ে যান। পেছনে পরে থাকে তাঁর স্ত্রী, পুত্র, রাজ্যসুখ প্রভৃতি। তিনি মনেস করতেন যে সুখ স্থায়ীভাবে বিরাজ করে না তাতে সুখ নেই। মানুষ হবে অহিংস। জীবের প্রতি মমতা অর্থাৎ কোনো হিংসা না করা। তার এই উদাসীন মানসিক অবস্থায় তার পিতা তাকে বিয়ে দেন। তার স্ত্রীর নাম ছিল যশোধরা। বৌদ্ধ ধর্মে ত্রিতাপ দুঃখ নামে মানব জীবনের তিনটি অবস্থাকে নির্দেশ করা হয়। এই তিনটি দুঃখ হলো দুঃখ, জরা-ব্যাধি এবং মৃত্যু। মানব জীবনের আবশ্যক পরিণতি এই ত্রিতাপ দুঃখ নিয়ে তিনি চিন্তা করেন এবং মানুষের মনকে কিভাবে এই কষ্ট থেকে দূর করা যায় সেই চিন্তায় ডুবে থাকতেন। এই যখন তার মানসিক অবস্থা তখন তিনি গৃহ ত্যাগ করার মনস্থির করেন। অবশ্য এর পূর্বে তার একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়।গৃহ ত্যাগ করে তিনি বিভিন্ন স্থানে সত্যের সন্ধান করলেন। বহু সাধুর সাথে তার পরিচয় ঘটে।
বুদ্ধগয়ায় একটি বটগাছের নিচে তিনি টানা ৪৯ দিন ধরে ধ্যান করেন। এরপর তিনি বোধি লাভ করেন। কথিত আছে যে, বুদ্ধত্ব লাভের দিন তিনি রাতের প্রথম যামে পূর্বজন্মের জ্ঞান লাভ হয়, দ্বিতীয় যামে তাঁর দিব্যচক্ষু বিশুদ্ধ হয়, অন্তিম যামে দ্বাদশ প্রতীতসমুৎপাদ এবং অরুণোদয়ে সর্বজ্ঞাতা প্রত্যক্ষ করেন। বোধি লাভ করার পর তার নাম হয় গৌতম বুদ্ধ। তিঁনি প্রচার করেন তার ধর্মের মূলমন্ত্র অহিংসা, দয়া ও ভালোবাসা। এই তিনে তিঁনি মানব জাতিকে দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর তিনি ধর্মপ্রচারে মনোযোগী হন। তাঁর প্রচারিত ধর্মে দলে দলে মানুষ আশ্রয় নিতে থাকে। অনেক বড় বড় রাজাও বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষিত হন। এক্ষেত্রে স¤্রাট অশোকের নাম উল্লেখযোগ্য। তিঁনি প্রথমে তাঁর পাঁচজন অনুরাগীর ভেতর তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন। এরা হলেন কৌন্ডিণ্য, ভদ্রিক, অশ^জিৎ, বাস্প এবং মহানাম। এই ধর্মপ্রচারের ঘটনা বৌদ্ধধর্মে ’ধর্মচক্রপ্রবর্তন’ নামে পরিচিত। বৌদ্ধরা তাকে বোধিপ্রাপ্ত শিক্ষক মনে করেন, যিনি সম্পূর্ণ বন্ধুত্ব অর্জন করেছেন এবং নিজের অর্ন্তদৃষ্টির কথা সবাইকে জানিয়ে চেতন সত্ত্বাদের পুনর্জন্ম ও দুঃখের সমাপ্তি ঘটাতে সাহায্য করেছেন। গৌতম বুদ্ধ ৪৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে আশি বছর বয়সে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার কুশীনগরে দেহত্যাগ করেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই
অলোক আচার্য মুক্তমত শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং মানবতায় গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা