Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অসাম্প্রদায়িক-চেতনা: নজরুলের কবিতা, নজরুলের বাস্তবজীবন

আবু আফজাল সালেহ
২৪ মে ২০২৪ ২০:৩৭

এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈশা মুসা পেল সত্যের পরিচয় (সাম্যবাদী)

—বাংলা কবিতায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতার জন্য জোরালোতম উচ্চারণ ‘আমি সাম্যের গান গাই। কুলি-মজুর ও শ্রমিক শ্রেণির প্রতি দেখালেন গভীর সহমর্মিতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসায় দরদ। শোষণ-মুক্তির আহ্ববান জানান ক্ষণে ক্ষণে। সাম্যবাদী কাব্যের বারাঙ্গনা,কুলি-মজুর, মানুষ, রাজা-প্রজা, নারী, পাপ, চোর-ডাকাত প্রভৃতি কবিতায় সাম্যবাদী নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। বাংলাসাহিত্যে তিনিই প্রথম সাম্যের গান গেয়েছেন, নির্যাতিত মানুষের সাফাই গেয়েছেন। মূলনীতি হিসাবে প্রচার করেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান—/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান (মানুষ)’। আবার ‘’সাম্যবাদী’’ কবিতায় বলেন:
‘গাহি সাম্যের গান—
যেখানে আসিয়া এক হ’য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-মুসলিম-ক্রীশ্চান!’

উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নারী ও পুরুষের সমান অবদান বল শক্ত কিছু কথা কাজী নজরুল ইসলামই বলেছেন। তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যে ঐক্য চেয়েছেন, বৈষম্যের অবসান চেয়েছেন। নারীকে প্রগতির মূলস্রোতে রাখতে চেয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক এ দেশে নেতিবাচক খবরগুলোর কারণ যেন নারী। তিনি এ ধারণা ও বিশ্বাসের প্রবল বিরোধী: ‘গাহি সাম্যের গান— /আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।/বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর ‘ [নারী]। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবি নজরুলের প্রতিনিধিত্বকারী একটি শ্রেষ্টতর কবিতা। কবিতাটি কবি নজরুলের আত্মোপলব্ধির জীবনদর্শন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। নজরুলের ভাবনা বা চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে এ কবিতায়। তিনি আসলে মানবতার পক্ষেই ছিলেন। মানুষই তার মূল লক্ষ্য। তিনি কোনো পক্ষে জড়িত হননি:
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পতি-রাম ভাবে কনফুশি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের অঙ্কুশি!
নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী।

‘জাতের বজ্জাতি’ কবিতাটি তো ব্যাপক জনপ্রিয়। ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া/ছুঁ’লেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।।’ দিয়েই কবিতাটি শুরু করেছেন কবি নজরুল। হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় জাত-পাত নিয়ে অনেক কুসংস্কার ও আলোচনা হত। একঘরে করার নীতিও ছিল সমাজে। এখনও এমন দৃশ্য-কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোয় কমেছে কিছুটা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রবলও হয়। হানাহানি হয়, দাঙ্গা হয়। রক্তারক্তি হয় প্রায়ই। এসবের বিরুদ্ধেই কবি কলম ধরেছেন। কবির মতে, জাত অত সহজে নষ্ট হওয়ার জিনিস নয়। জাতের স্বরূপ নিয়ে কবিতার মধ্যভাগে লিখলেন: ‘সকল জাতই সৃষ্টি যে তার, এ বিশ্ব-মায়ের বিশ্ব-ঘর,/মায়ের ছেলে সবাই সমান, তার কাছে নাই আত্ম পর’। হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন জাত-পাত আছে, বিভিন্ন সম্প্রদায়-উপসম্প্রদায় আছে। এসবে বিভিন্ন শ্রেণি-বৈষম্য বিদ্যমান। কবির কাছে ‘মানুষ’-ই মূখ্য। সবাই মানুষ। স্রষ্টা একজনই, সবাই তারই সৃষ্টি। তাহলে কেন বিভেদ-বিভাজন থাকবে? নজরুলের শক্তিশালী এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ বর্তমান সমাজেও কুঠারাঘাত হানার জন্য অক্সিজেন জোগাতে সক্ষম। ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’। মানুষ যদি অন্তরাত্মকে না চেনে, অন্য ধর্মকে সম্মান করতে না শিখে নিজেকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ প্রমাণের জন্য ব্যস্ত থাকে, তাহলে সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে না।

‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। নজরুল গড়তে চেয়েছেন একটি সুন্দর অসাম্প্রদায়িক-সমাজ; শোষণমুক্ত বিশ্ব। ইসলামী সংগীত, হামদ ও নাতগুলো চমৎকার। হিন্দুদের জন্য রচিত শ্যামাসংগীতও দারুণ জনপ্রিয়। নজরুল বর্তমানেও খুবই প্রাসঙ্গিক। তার জাতীয়তাবোধ, ধর্ম,বর্ণ, জাতিবিদ্বেষের উর্দ্ধে উঠে মনুষ্যত্বকে প্রাধান্য দেওয়ার উদার জীবনদর্শন, নতুন প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জরুরি একটি পাঠ হতে পারে। আজকের পৃথিবীতে যখন মানুষ সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হতে হতে ক্রমশ ছোট হতে বসেছে। শেষ হতে বসেছে সম্প্রীতি, সমানুভাবের মতো বিষয়গুলো। ফলে নতুন করে কাজী নজরুল প্রাসঙ্গিকতা এখনও আছে। সামাজিক এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বা অসাম্প্রদায়িকতার মতো বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সুস্থ পরিবেশ, দৃঢ় মানসিক গঠনের জন্য নজরুলকে সামনে আনা দরকার। স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে আরও বেশি করে নজরুল ইসলামকে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ তার অসাম্প্রদায়িকতার চেতনতার দৃঢ়তা আমাদেরকে অনেক শিক্ষা দেয়। নজরুল শুধু কবিতা বা সাহিত্যেই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রদর্শণ করেননি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সংসারেও বাস্তবায়নের চরম নমুনা রেখেছেন। তিনি প্রথমে ব্রাহ্মণ নারী আশালতা সেনগুপ্তার সঙ্গে প্রেমে পড়েন এবং পরবর্তীতে তাকে বিয়েও করেন। প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করার সময় তাকে ধর্মান্তরিত করা হয়নি। কবি নজরুল তার চার সন্তানের নাম রাখেন হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের সম্মিলিনে—কৃষ্ণ মুহম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ইসলাম ও কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম। অসাম্প্রদায়িক নিদর্শন আর কী হতে পারে! মসজিদে গজল আর ইসলামী সঙ্গীত আর মন্দিরে শ্যামাগীতি; সমানভাবে জনপ্রিয়। বিশ্বের শীর্ষ দু-ধর্মেও অনুসারীদের কাছে ধর্মগ্রন্থের পরেই প্রিয় সঙ্গীত! ভাবা যায়! বিশ্বের আর কোন সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে বা আইডলের কাছে এমন হয়নি। তিনি বিদ্বেষহীন ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছেন। তিনি বহুসংস্কৃতির ধৈর্যশীল একটি একক সম্প্রদায়ের কল্পনা বাস্তবায়ন করতে নিজেই প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছেন। এর মাধ্যমেই তার আন্তরিকতা নিয়ে ন্যুনতম প্রশ্ন রাখার সুযোগ রাখেননি।

মানুষ ও মানবতার পক্ষে তার অবস্থান, বিপক্ষে জোরালো উচ্চারণ।  মানবতার পক্ষে এত শব্দ বিশ্বের কোনো সাহিত্যিক (এমনকি রাজবীতিবিদ বা সংগঠক) ব্যবহার বা প্রয়োগ করেননি। বিশ্ব মানবতার জোরালো কণ্ঠস্বর তিনি। শোষণ ও সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে সফল নায়ক তিনি। সেজন্যই হাত উঁচিয়ে বলতে পেরেছেন:
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
[কাণ্ডারী হুশিয়ার!]

সম্পদ, সংগঠন, ধর্ম, শিক্ষা বা জ্ঞ্যানার্জন, সামাজিক প্রবেশাধিকার, বা অন্য কোনো ক্ষমতার ক্ষেত্রে সমতাবিধান নিশ্চিত করতে চেয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। অশুভ শক্তিগুলোকে ছিদ্র করতে ব্যাপক শক্তির প্রয়োজন। কবি নজরুল অনুপ্রেরণার এক নাম। তার কবিতা শক্তির বিশাল আধার। নজরুল সাম্যবাদকে জীবনযন্ত্রণার অভিজ্ঞতায় প্রোথিত করেছেন এবং কবিতাকে প্রকৃত মানবতাবাদীর দিকে নিয়ে গেছেন। অসাম্প্রদায়িক-ধারা তিনি বজ্রকণ্ঠে শুরু ও বাস্তবায়ন করেছেন।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এজেডএস

আবু আফজাল সালেহ কাজী নজরুল ইসলাম


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর