জোনাকির আলো আজ হারালো কোথায়?
২৫ মে ২০২৪ ১৫:৫৩
জোনাকিপোকা— যার পেঠ থেকে আলো বের হয়। আর এ আলো পরিবেশের চারপাশ আলোকিত করে তোলে। এ যেন নিখাঁদ আলো। যে আলোর পিছনে পিছনে দৌঁড়ে কতজনই না তাদের শৈশব পার করেছে। যে জোনাকি নিয়ে কত স্মৃতিই না জমা আছে আমাদের স্মৃতিপটে। ছোট কালে কতই না দৌঁড়েছি এই জোনাকির পিছনে। কিন্তু এখনকার ছোট ছেলেমেয়েরা কি জোনাকির পেছনে দৌড়ায়? হাতে নিয়ে আবার কি উড়িয়ে দেয় জোনাকি? এই প্রশ্নটা তেমন একটা জরুরি না হলেও ‘আগের মতো আর জোনাকির দেখা পাওয়া যায় না কেন?’- এটি একটি জরুরি প্রশ্ন।
মূলত পাখাওয়ালা গুবরে পোকাকে জোনাকি পোকা বলা হয়। কারণ, তারা জৈব রাসায়নিক ব্যবস্থায় নিজের শরীর থেকে আলো উৎপন্ন করে। এরা এই আলো দ্বারা যৌন মিলন ঘটানো বা শিকারের উদ্দেশ্যে জ্বেলে থাকে। এরা কোল্ড লাইট বা নীলাভ আলো উৎপন্ন করে কোন আল্ট্রাভায়োলেট বা ইনফ্রারেড তরঙ্গ ছাড়া। এই আলোর রং হলুদ, সবুজ বা ফিকে লাল হতে পারে। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হল ৫১০ থেকে ৬৭০ ন্যানোমিটার। বস্তুতপক্ষে, সব প্রজাতির জোনাকির আলো নেই। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শুধু প্রাপ্তবয়স্ক জোনাকিরাই আলো উৎপন্ন করে না, জোনাকির লার্ভা, এমনকি এর ডিম থেকেও আলো উৎপন্ন হয়।
প্রকৃতপক্ষে, জোনাকিরা মাংসাশী বা কীটভোজী প্রাণী। জোনাকির লার্ভা সাধারণত ছোট শামুক বা ক্রিমি খেয়ে থাকে। তবে কিছু প্রজাতির জোনাকি অন্য জোনাকিদেরও খেয়ে থাকে। বিশেষ করে কিছু স্ত্রী জোনাকি পুরুষ জোনাকিদের খেয়ে ফেলে- এমন প্রমাণও রয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্ক জোনাকি শুধুমাত্র প্রজনন এবং ডিম দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকে। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের খাওয়ার দরকার পড়ে না। লার্ভা সাধারণত এক থেকে দুই বছর বেঁচে থাকতে পারে। পুরুষ জোনাকিরা আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়ায় আর স্ত্রী জোনাকিরা গাছ, গুল্ম কিংবা ঘাসে পুরুষ জোনাকির অপেক্ষা করে। কোনো পুরুষ জোনাকি কাছে এলেই স্ত্রী জোনাকি নিজের আলো দেখিয়ে তাকে প্রজননের সংকেত পাঠায়। তবে শুধু প্রজননের জন্যই নয়, যোগাযোগ এবং শিকারীকে সতর্ক করতেও তারা এ আলো ব্যবহার করে। আক্রমণের শিকার হলে জোনাকিরা তাদের দেহ থেকে ‘রিফ্লেক্স ব্লিডিং’ নামক একধরনের রক্ত নিঃসরণ করে, যা তেতো এবং বিষাক্ত হয়ে থাকে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, আকর্ষণীয় এই জোনাকিপোকা যারা কিনা আমাদের রাতকে আলোকিত করে তোলে আর পরিবেশকেও করে তোলে সুন্দর ও রহস্যময়, সেই সমস্ত পোকারা আজ যেন চোখেই পড়ে না। অদ্ভুত এক ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে আসা এই পোকা আজ আমাদের মনকে প্রশান্তি দিবে দূরের তাদের দেখাটা যেন আজ মিলে না। কিন্তু কোথায় হারালো এরা? কেনই বা তাদের আর দেখা যায় না? কি বলছে পরিবেশ গবেষক- বিজ্ঞানীরা?
বিশেষ গবেষণায় গবেষকরা জোনাকিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করছেন। এতে তারা বেশ কিছু কারণ খুঁজেও পেয়েছেন। সর্বশেষ ২০২০ সালে সারা লুইসের নেতৃত্বে একটি দল জোনাকিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ নিয়ে গবেষণা করে। যেখানে উঠে এসেছে বাসস্থান হারানো, আলো দূষণ ও কীটনাশকের ব্যবহারসহ বেশ কিছু কারণ। এসব কারণেই তারা তাদের পরিবেশে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছেন।
বলতে গেলে, জোনাকিদের বেশিরভাগ প্রজাতিই পুকুর বা জলাধারের পাশে পচা কাঠ এবং বনাঞ্চলে লার্ভা হিসেবে বেড়ে ওঠে। কিছু প্রজাতির জোনাকি জলের ধারে থাকতেই বেশি ভালোবাসে। আবার কিছু প্রজাতিকে দেখা যায় শুকনো অঞ্চলে। তবে বেশিরভাগেরই দেখা মেলে মাঠ, বন এবং জলাভূমিতে। বসবাসের জন্য উষ্ণ, আর্দ্র এবং জলজ পরিবেশ, যেমন- পুকুর, নদী কিংবা জলধারা জোনাকিদের পছন্দের জায়গা হলেও সমস্যা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের জোয়ারে তাদের বাসস্থান আজ হুমকির মুখে। খোলা মাঠ কিংবা বনাঞ্চল সব উধাও হয়ে যাচ্ছে। জলাভূমিগুলোও দখল হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন ভবন উঠছে। জলে ভাসছে আধুনিক নৌকো, জাহাজ। এতসব উন্নয়নের ঝলকে জোনাকিদের বসবাসের জন্য যে পরিবেশ এবং অন্ধকার লাগে, সেটি আর পাচ্ছে না তারা। মূলত তাদের আবাসস্থল যতই উন্নয়নের ফাঁদে আটকা পড়ে যাচ্ছে, তাদের সংখ্যাও ততই কমে যাচ্ছে।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই