তাহারা আমাদের আপদ না বিপদ? নাকি সম্পদ?
২৮ মে ২০২৪ ১৬:৪৬
শব্দ নিয়ে জব্দ হতে হয় প্রায়শই। এই যেমন আপদ আর বিপদ নিয়ে। খুব কাছাকাছি অর্থবোধক হলেও আপদ মোটেই বিপদ না। তবে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বা বিপদের পূর্বাভাস। অহেতুক সমস্যা সৃষ্টিকারী বিষয় বা ব্যাক্তি হচ্ছে আপদ। আর বিপদ হচ্ছে সৃষ্ট সমস্যা, দুর্ঘটনা বা অনাকাংখিত পরিস্থিতি। কিন্তু সম্পদ শব্দের অর্থ নিয়ে এরূপ কোন অসুবিধে না থাকলেও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পার্থক্য ব্যাপক হয়ে যেতে পারে। যেমন অতিরিক্ত জনসংখ্যা আমাদের জন্য সম্পদ না অভিশাপ? এই বিতর্কের শেষ নেই।
প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। বঙ্কিমচন্দ্র শুধু সাহিত্য সম্রাটই ছিলেন না। ছিলেন ডাকসাইটে আমলাও। ছিলেন ইংরেজ শাসনামলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর। তার শেষোক্ত এই পরিচিত নগণ্য সংখ্যক শিক্ষিত মানুষ জানলেও বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের জানার মধ্যে নেই। তার নিজের এক কাহিনী আছে এই আপদ আর বিপদ নিয়ে। সর্বমহলের পাঠকের সুবিধার্থে তুলে ধরলে সেটা খুব প্রাসঙ্গিক ও জলবৎ তরল হবে আশা করি। একবার তাকে চাকরির পরীক্ষা দিতে ইংরেজ সাহেবের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। ইংরেজ সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আপদ আর বিপদের মধ্যে পার্থক্য কি? উত্তরে সাহিত্যরথী বঙ্কিম বাবু একটি গল্পের অবতারণা করলেন। বললেন, একবার স্টিমারে করে তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ঝড়ের কবলে পড়েন। সেই ঝড়ের কবলে পড়া হলো বিপদ। আর বাঙ্গালি হয়ে ইংরেজ সাহেবের কাছে বাংলা ভাষায় পরীক্ষা দেওয়াটা হলো আপদ।
সে যা-ই হোক। বলছিলাম আপদ আর বিপদ নিয়ে। তাই বলে তার সাথে সম্পদ জুড়ে দিলাম কেন? কারণ আছে বৈকি! সেটা পরে মিলিয়ে নেওয়া যাবে। এবার চলুন অন্য প্রসঙ্গে।
সম্প্রতি এবছরের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। দেশের শীর্ষ স্থানীয় এক বিদ্যাপীঠের জিপিএ ফাইভ প্রাপ্ত দুইজন ছাত্রী টিভি চ্যানেলে জানিয়েছে যে, তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হলো টিকটকার, ইউটিউবার, ভ্লগার হওয়া। বোধকরি এরকম অভিন্ন অভিলাষ গ্রামের শিক্ষার্থীদেরও। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে।
সম্প্রতি তুর্কি সুপার স্টার, মডেল, সেলিব্রেটি ও এক সময়ের এক প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সেরা দ্বিতীয় পুরুষ হিসেবে নির্বাচিত ওসমান বে খ্যাত মি: বুরাক ঔজচিভিত বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন। তিনি এলেন, দেখলেন, জয়ও করলেন। কি দেখলেন, কি কাজ সারলেন, কি জয় করলেন তা মিডিয়ার কল্যাণে আজ সবাই অবহিত। একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির ব্র্যাণ্ড এম্বাসেডর হিসেবে প্রমোশনাল কাজে তিনি এসেছিলেন। সেটা অতি স্বাভাবিক বিষয়। পারিশ্রমিক বলেন আর সম্মানী বলেন তার বিনিময়েই তাকে বিশ্বব্যাপী যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু জয় করার বিষয়টি অতিরিক্ত প্রাপ্তি। যা সাধারণ রাজনীতিক, আধিকারিক, ব্যবসায়ী বা অন্য কোন পেশার লোকজনদের ক্ষেত্রে মোটেই সহজ না। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, জনাব বুরাক ঔজচিভিত এর বাংলাদেশ জয়ের কারণ কি? মোটা দাগে বলা যায়, তিনি সুদর্শন, সেলিব্রেটি, বিশ্বের দ্বিতীয় সুন্দর পুরুষ বলে ঘোষিত, আন্তর্জাতিক ব্র্যা-ের এম্বাসেডর, মিডিয়ার ক্রেজ আর তরুণ-তরুণীদের কাছে শক্তিশালী চুম্বক। তার সংবাদ সম্মেলন থেকে যতটুকু অনুমান করা যায় যে, এদেশে তার বরণচিত্র দেখে তিনি অভিভূত, আপ্লুত ও মুগ্ধ হয়েছেন। হবেন তো বটেই। তাকে দেখার জন্য রাজপথ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। পাগলাটে ভক্তরা তাকে দূর থেকে দেখে কেঁদেছে কাছে যেতে না পারার বেদনায়, যারা কাছে থেকে দেখেছে তারা কেঁদেছে স্পর্শ করতে না পারার কষ্টে। আর যারা সময় মত সাত-সমুদ্র পার হয়ে এসেও মিস করেছেন তারা করেছেন পিতৃ-মাতৃ শোকতুল্য বিলাপ। বাঙ্গালি যে আবেগী জাতি এ কথা বোধকরি তার জানা ছিলো না। এরা আবেগের ঠেলায় বিবেক বিসর্জন দেয়, অগ্রপশ্চাৎ ভাবনা স্থগিত করে রাখে। আর উচ্ছ্বাস প্রকাশে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত পাগলপ্রায় হয়ে ওঠে।
বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সেলিব্রেটি ও মডেলরা এখন আমাদের সামনে অপ্রতিরোধ্য মডেল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। শুধু কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরাই এদের ডাইহার্ট ফ্যান নয়। এই কিউতে অতি সন্তর্পণে এরিমধ্যে ঢুকে গেছেন প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও।
বৈশ্বিক এ ঢেউ এখন বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের সাথে মিলে মিশে বঙ্গদেশ সয়লাব করে দিচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ। বলাচলে আমরা এখন মডেল ও সেলিব্রেটিদের একনিষ্ঠ অনুগামী ও অনুরক্ত ভক্ত। তারা আমাদের লাইট হাউজ। তারা আমাদের পরম প্রিয় পরামর্শক ও পথ প্রদর্শক। তারা যেমন আমাদের হার্ট বিটের কারণ, অফুরান ইন্দ্রিয় সুখের পাওয়ার হাউস তেমনি রতিসুখের আধারও। তাদের দেখলেই আমাদের সমস্ত অর্জন বিসর্জন দিতে এতটুকু আফসোস হয় না। মিডিয়া জুড়ে তাদের সরব উপস্থিতি আমাদের এই আটপৌরে জীবনকে যারপরনাই উজ্জীবিত রাখে, তাদের সান্নিধ্যসুখ আমাদেরকে অর্গাজমের উচ্চমাত্রায় নিয়ে যায়।
আমাদের দেশীয় যারা মডেল আর সেলিব্রেটি হিসেবে করে খাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রেও আমাদের আকর্ষণ ও পাগলামির কমতি নেই। আমরা তাদেরকে সারাক্ষণ মিডিয়ার বুকে বিচরণ করতে দেখতে চাই। আমাদের কাছে তাদের স্বাভাবিক আচরণের চেয়ে অস্বাভাবিক আচরণ, উদ্ভট ও অসংলগ্ন কথাবার্তা পছন্দের, তাদের প্রায় খোলামেলা পোষাক আমাদের কাছে নয়ন সুখের। তাদের উঠা-বসা-শোয়া-নাওয়া-খাওয়া আমাদের কৌতুহলের টপ চার্টে থাকে। তাদের জন্য আমরা ছুটে যাই, হাত নাড়ি, সেল্ফি তুলি, অটোগ্রাফ নেই। তাদের পাশাপাশি হাঁটতে চাই, দাঁড়িয়ে হাসি বিনিময়ে ছত্রিশ খান হয়ে যেতে চাই। চান্স পেলে উষ্ণতা-স্পর্শে ধন্য হই। মিডিয়ার লোকেরা আরো সরেস। পারফেক্ট জোড় যেন! সারাক্ষণ আপু আপু করে আর কীসব প্রশ্নœ করে তা তারা নিজেরাও জানে না। ক্যামেরা যার হাতে আজ তার সর্বত্র ইজি এক্সেস, প্রিভিলেজ। ভাঁজ মত থাকলে তার মত তোলা দিয়ে রাখতে আর কেউ যে জানে না এটা এইসব চাতকি সেলিব্রেটি-মডেলরা খুব ভালো জানে। আবার সমীকরণ বরাবর বা অনুকূল না হলে তারাই আলটপকা অজানা উছিলায় হাতে ভাঙ্গা হারিকেন ধরিয়ে দিবে, আগাম টেরও পাওয়া যাবে না। অথচ কিছু-মিছু দিলে এরাই তাদের পক্ষ হয়ে সত্য-মিথ্যার গসিপ তৈরি করে পরিবেশন করবে। এই সমীকরণেই চলছে সেলিব্রেটি আর মডেল কালচার। এদেশে আরেক প্রকার সেলিব্রেটি ও মডেল আছে। এরা টিকটকার, ইউটিউবার, ভøগার, রিল মেকার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। লাজ-লজ্জা, মান-সম্মান, ধ্যান-জ্ঞান-শিক্ষা এদের কাছে ধর্তব্য কোন বিষয়ই না। এদের কাছে ভিউ, লাইক, শেয়ারটাই সব।
আমাদের এইসব সেলিব্রেটি আর মডেলরা এক একজন হ্যামিলনের বংশীবাদকের মত মোহিনী সুরের অধিকারী। হ্যামিলনের বংশীবাদকের কাহিনী হয়ত এদের সবার খুব বেশি জানা নেই। এরা তারচেয়েও ক্ষমতাবান। ম্যাজিক মন্ত্র তাদের কন্ঠে, দোলা জাগানিয়া অর্কেস্ট্রা এদের দেহবল্লরীর ভাঁজে ভাঁজে। এদের অপার ক্ষমতা আর অপরিসীম প্রভাব। এরা উপর তলার লোকদের কাছে প্রিয়ংবদা, মনোরঞ্জনে মেনকা, পারফরমেন্সে দুর্দান্ত রাসপুটিন। বলাবাহুল্য, এইসব পাইড পাইপারদের থাকে এক বা একাধিক গুণমুগ্ধ বস।
সেলিব্রেটি কালচার অনেক আগেও ছিলো। তবে তাদের নির্ধারিত বৃত্ত ছিলো। চলাফেরা সীমাবদ্ধ ছিলো। বাছাই করা মিডিয়া থাকত। তারাই তাদেরকে তুলে-মেলে-খুলে ধরত বিনোদন পিয়াসী পাবলিকের কাছে। তাদেরও ব্যাক্তিগত গসিপ থাকত, চাপা দু:খ-যাতনা-কষ্ট ছিলো। তবে জনসমক্ষে এসে কান্নাকাটি ছিলো না, বিষোদগার ছিলো না। এদেশে মডেল কালচারের শুরুটা কিন্তু খুব ভালো ভালো পারফরমারের হাত ধরে হয়েছিলো। পণ্যের বিজ্ঞাপনে, ব্র্যাণ্ডের বিপননে তাদের বেশ ভালো একটা ভূমিকাও ছিলো। পরবর্তীতে তারাই মিডিয়া পাড়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখত। এখন এসব পদ্ধতিগত শিক্ষা-দীক্ষা লাগে না। কোন রিহার্সেলের প্রয়োজন পড়ে না। স্টেজে নেচে-কুঁদে উত্তাল জনতাকে মাতাল করে দিতে যা যা করা প্রয়োজন তার কোন ঘাটতি থাকে না। এরা সমাজকে কী ম্যাসেজ দিচ্ছে তা তারা নিজেরাও জানে না, জানার প্রয়োজনই বোধ করেনা। উপলব্ধিও করে না। টিনএজরা তাদেরকে অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে নেশাগ্রস্ত ইঁদুরের মত কোথায় ঝাঁপ দিচ্ছে তাও জানে না। অথচ এদের মধ্যে যারা যোগ্য, সভ্য, শিক্ষিত তাদের মাধ্যমেই পুরাতন চিন্ত-াচেতনাকে ঝেড়ে ফেলে নতুন, সৃজনশীল, সময়োপযোগী অনেক কিছুই করা যেত, উদ্যোগী-উদ্যমী প্রতিভার উন্মেষ ঘটানো যেত।
বর্তমান সেলিব্রেটি ও মডেল কালচার কর্মক্ষম জনশক্তিকে রঙ্গীন ফানুসমুখী করে ফেলেছে। সবাই এখন মোবাইল হাতে, ক্যামেরা কাঁধে যেন এক একজন সেলিব্রেটি-মডেল হতে মরিয়া। এদেরকে যারা এপথে নামাচ্ছে, শিখাচ্ছে, পড়াচ্ছে তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই, না সমাজে না পরিবারে না রাষ্ট্রের কাছে। বুদ্ধিজীবিরা চুপ। উদোরপূর্তির ভাত ঘুমে বিভোর। সৃজনশীল ব্যাক্তিত্বরাও শীত নিদ্রায় কাতর। যেন কোথাও কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই। সবাই ভাব নিয়ে বসে আছে, দেখি শালা কী হয়! সবাই নিরব। সাইলেন্স ইজ ক্রাইম। এটা মানলে এইরূপ সেলিব্রেটি-মডেল কালচারের পৃষ্ঠপোষকরা তাহলে কি?
আমরা পুঁথিগত শিক্ষার দুয়ারে নানা কিছিমের রঙ্গীন পোস্টার সেঁটেছি। পারিবারিক শিক্ষাকে দিয়েছি বর্হিমুখী শিক্ষার কাছে বন্ধক। নীতি-নৈতিকতার চর্চাকে করে তুলেছি হাস্যকর ও অচল মুদ্রার মত। সভ্যতা-ভব্যতা-লাজ-শরমকে চিহ্নিত করেছি উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে। সামাজিক বন্ধনকে ছিন্ন করে গড়ে তুলেছি গুটি কয়েকের এক একটি অলিগার্কি। সি-িকেটের কাছে সমর্পণ করেছি আমাদের যাবতীয় অভিপ্রায়, অভীষ্ট। অথচ এর প্রতিটি ক্ষেত্রের বিশদ ও ব্যাপক অনুশীলন আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই আমরা আমাদেরকে আরো বলিষ্ঠ, নীতিনিষ্ঠ, আধাত্মিক চর্চায় সমৃদ্ধ করতে পারতাম। দেশ গঠনে, উন্নয়নে, বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা দূরীকরণে হতে পারতাম এক একজন সংশপ্তক।
এখন আর আমাদের কাছে রোল মডেল নন কোন শিক্ষক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, ইতিহাসবিদ, নেতা বা সাদা মনের অগ্রণী কোন মানুষ। সে জায়গায় রোল মডেল হচ্ছে তুর্ক ম্যানদের মত সেলিব্রেটি-মডেল-ব্র্যা- এম্বাসেডর। হিরো আর এঞ্জেল নামধারীরা। আমরা কি এগোচ্ছি নাকি ক্রমশঃ ঘেরাটোপে আটকে যাচ্ছি?
বিপদের বিপরীত শব্দ কি সম্পদ? এখন যারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা কি আমাদের সম্পদ? নাকি আপদ নাকি বিপদ? তাদের কর্মকা- কি আমাদের জন্য ‘বিপদ’? কেউ কি কলকাঠি নাড়ছে? শুনেছি শয়তানে লাড়া দিলে এরকম অনেক কিছুই সম্ভব। আমাদের এখন দরকার ভূত তাড়ানিয়া দাওয়াই। সেটা হতে হবে দেশীয় ঔষধি ভেষজ, বিদেশী সুগার কোটেড বাহারি কালার আর ফ্লেভারের ক্যাপসুল না। আমরা কি তবে আগামীতে টিকটকার, ইউটিউবার, সস্তা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, রিল মেকার বা নয়ন সুখ এইসব সেলিব্রেটি-মডেলের আদলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাজাচ্ছি? ধরণী বিভক্ত হও, মাটিতেই ঢের শান্তি। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই