Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বনাম ক্রলিং পেগ পদ্ধতি

ড. মিহির কুমার রায়
২৯ মে ২০২৪ ১৯:৫৫

সাধারণত তিনভাবে কোনো দেশের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে স্থির বিনিময় হার। এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থানীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার একটি বিনিময় হার নির্ধারণ করে দেয়। ব্যাংকগুলো সেই বিনিময় হার অনুসরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করে থাকে। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের ওপর ভিত্তি করে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হয়ে থাকে। এছাড়া মধ্যবর্তী একটি পদ্ধতি আছে, যাকে ‘ক্রলিং পেগ’ বলা হয়। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের একটি হার নির্ধারণ করে দেয়। ব্যাংকগুলো সেই নির্ধারিত বিনিময় হারের কিছু কম বা বেশি মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় করতে পারে। তবে ব্যাংক ইচ্ছা করলেই অস্বাভাবিক বেশি অথবা কমে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় করতে পারে না। বিশ্বের অনেক দেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে থাকে। আরও বলা যায় ‘ক্রলিং পেগ’ হলো কোনো দেশের স্থানীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এটি অনেকটা নিয়ন্ত্রিত নীতিরই অনুকরণ। এ নীতির মৌলিকত্ব হলো কোনো মুদ্রার বিনিময় হারকে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে ওঠানামার অনুমতি দেয়া। অর্থাৎ ডলারের বিনিময় হার ওঠানামার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা ঠিক করে দেয়া। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারজনিত অস্থিরতা তৈরি হলে এ সীমা ঘন ঘন সমন্বয় করা হয়। এটিকে দেখা হয় নিয়ন্ত্রিত বা বেঁধে দেয়া বিনিময় হার থেকে উন্মুক্ত বাজারদরে প্রবেশের আগের ধাপ হিসেবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ব্যাংক ৮ মে থেকে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এর ফল একদিনের ব্যবধানেই প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিপরীতে ৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, নতুন এ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ফলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। টাকার এ অবমূল্যায়ন নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। উল্লেখ্য, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার যদি সঠিক না হয়, তাহলে অর্থনীতিতে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। কৃত্রিমভাবে স্থানীয় মুদ্রাকে অবমূল্যায়িত করে রাখা বা অতিমূল্যায়িত করা কোনোটাই কাম্য নয়। বাংলাদেশি টাকার মান এতদিন প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারীকৃত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রলিং পেগ বিনিময় পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ডলারের জন্য ক্রলিং পেগ মিড-রেট (সিপিএমআর) নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। এখন থেকে আন্তঃব্যাংক ও গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেনে তফসিলি ব্যাংকগুলো সিপিএমআরের আশপাশে মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। এর আগে ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসছে এমন যুক্তিতে গত ডিসেম্বরে দুই দফায় মার্কিন মুদ্রাটির বিনিময় হার ১ টাকা কমানো হয়েছিল। এতে প্রতি ডলারের মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। যদিও দিনের শুরুতে সর্বোচ্চ ১১০ টাকায় নির্ধারিত ছিল মুদ্রাটির বিনিময় হার। সে অনুযায়ী একদিনেই মুদ্রাটির আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার বেড়েছে ৭ টাকা। তবে ব্যাংকগুলো চাইলে এর চেয়ে বেশি বা কম দরে ডলার বেচাকেনা করতে পারবে।

বিজ্ঞাপন

আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্বের বৃহৎ ও সুপ্রতিষ্ঠিত অর্থনীতির কোনো দেশেই বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এখন ‘ক্রলিং পেগ’ নীতির চর্চা নেই। নিকারাগুয়া, বতসোয়ানা, একুয়েডর, উরুগুয়ে, কোস্টারিকা, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনাসহ কিছু দেশ কেবল এ নীতি অনুসরণ করছে। এরই মধ্যে আবার অনেকগুলো এটি থেকে বের হয়েও এসেছে। সম্প্রতি এ নীতি অনুসরণের ঘোষণা দিয়েছে নাইজেরিয়া। দেশটির স্থানীয় মুদ্রা ‘নাইজেরিয়ান নাইরা’-এর বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতা চলছে। ব্যাংক খাতের সঙ্গে কালোবাজারে ডলারের বিপরীতে নাইরার বিনিময় হার প্রায় দ্বিগুণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের প্রভাবে দেশে বিরাজমান মূল্যস্ফীতি আরো উসকে উঠতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছরের শুরু থেকেই ক্রমাগত ঋণের সুদহার বাড়ালেও এখনো দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে টানা ২২ মাস ধরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ মার্চেও দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ । আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিশ্্রুত ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে ডলারের নতুন দর নির্ধারণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন সময়ে এসে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি অনুসরণের ঘোষণা দিল, যখন দাতা সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করছে। প্রতিশ্্রুত ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে পর্যালোচনা করতে গত ২৪ এপ্রিল আইএমএফের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। প্রতিনিধি দলটির দীর্ঘ সফর ৮ ই মে শেষ হয়েছে।

অন্যদিকে ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতা চলছে আড়াই বছর ধরে। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্ধারণ করে দেয়া দরেও বাজারে ডলার মিলছিল না। এ পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সের বড় অংশ চলে যাচ্ছিল হুন্ডির বাজারে। আবার আমদানিকারকরা ঘোষিত দরের চেয়ে ১০-১৫ টাকা পর্যন্ত বেশি দিয়ে ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে চলতি বছরের শুরুতে এসে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কীভাবে এ পদ্ধতি চালু হবে, সে বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এতে মার্চের মধ্যে এ পদ্ধতি কার্যকরের কথা থাকলেও এর ঘোষণা আসতে চলতি মে মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে ডলারের মধ্যবর্তী দর ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হলেও ব্যাংকগুলো এ থেকে সর্বোচ্চ কত টাকা বেশি দরে ডলার কিনতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর বলেন, ‘ডলারের প্রকৃত বিনিময় হার পর্যালোচনা করেই আমরা মধ্যবর্তী দর ঠিক করে দিয়েছি। আশা করছি, এর চেয়ে বেশি দরে ডলার কিনতে হবে না। খুচরা বাজারেও (কার্ব মার্কেট) ডলারের দর এখন স্থিতিশীল। ব্যাংক খাতের সঙ্গে কার্ব মার্কেটের দরের ব্যবধান ১ টাকার বেশি হবে না।’

মতিঝিলসহ রাজধানীর একাধিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, এক মাস ধরেই ডলারের কার্ব মার্কেট বেশ স্থিতিশীল। এ সময়ে প্রতি ডলারের দর ১১৬ থেকে ১১৮ টাকায় ওঠানামা করেছে। কার্ব মার্কেটে গতকাল দিনের শুরুতে প্রতি ডলারের দর ছিল ১১৭ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণার পর বিকালে তা ১১৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, সুযোগসন্ধানীরা চাইলে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আবারো কার্ব মার্কেটে ডলারের দর বাড়িয়ে দিতে পারে। এর আগে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১৩০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘ডলারের মধ্যবর্তী দর ১১৭ টাকায় নির্ধারণ করাটি যৌক্তিক। আশা করছি, এ সিদ্ধান্তের ফলে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়বে। আর হুন্ডির বাজারের প্রভাবও কমে আসবে।বাজার স্থিতিশীল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণের ঘোষণা দিলেও বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ভিন্ন তথ্যই দিচ্ছে। বিনিময় হারের অস্থিরতা দূর করতে এ নীতি গ্রহণকারী দেশগুলোর একটি আর্জেন্টিনা। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, স্থানীয় মুদ্রার রেকর্ড অবমূল্যায়নসহ নানা সংকটে অনেকটাই বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে লাতিন আমেরিকার দেশটির অর্থনীতি। এ সংকটের সূত্রপাত বিদেশী ঋণ অব্যবস্থাপনা থেকে। বিনিময় হারের অস্থিরতার কারণে দেশটির ব্যাংক খাতের সঙ্গে কালোবাজারে ডলারের বিনিময় হারের ব্যবধান দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। এ অবস্থায় বিনিময় হারে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থেকে গত বছরের আগস্টে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি গ্রহণ করে আর্জেন্টিনা। দেশটিতে পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল মাত্র ৩৭ পেসো। এর পর থেকেই দেশটির অর্থনীতিতে বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতা চলছে। গত এক বছরে এ সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। স্থানীয় মুদ্রার ধারাবাহিক অবমূল্যায়নের পর ২০২৩ সালের ২০ জানুয়ারি দেশটিতে প্রতি ডলারের আনুষ্ঠানিক দর বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৩ পেসোয়। যদিও খুচরা ও কালোবাজারে এ বাবদ গুনতে হচ্ছিল প্রায় দ্বিগুণ অর্থ। এ অবস্থায় ডলারের বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি গ্রহণ করে আর্জেন্টিনা। গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি এ নীতি অনুসরণ করে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৩৫০ থেকে ৩৫৫ পেসো নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতি মাসে মুদ্রাটির অবমূল্যায়ন ধরা হয় সর্বোচ্চ ২ শতাংশ। কিন্তু তিন মাস না যেতেই ক্রলিং পেগ নীতি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে। ব্যাংক খাতের সঙ্গে কালোবাজারে ডলারের বিনিময় হারের ব্যবধান আরো বেড়ে যায়। এ অবস্থায় গত ডিসেম্বরে এসে এক ধাক্কায় পেসোর ৫০ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটানো হয়। প্রতি ডলারের বিনিময় হার দাঁড়ায় ৮০০ পেসোয়। এর পরও বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। দেশটিতে এখন প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮১৮ পেসো ছাড়িয়ে গেছে।

এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এই পদ্বতির সুফল-কুফল নিয়ে কি ভাবে আগাবে সেটাই এখন দেখার বিষয় । আমাদের দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। বিশেষ করে পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণের উপস্থিতি ব্যাংক খাতের স্বাভাবিক চলার গতিকে রংদ্ধ করেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাংকের অভ্যনমশরীণ সুশাসন নিশ্চিতকরণসহ আবশ্যিক সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক,বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য,সিটি ইউনিভার্সিটি,ঢাকা ও এলকপ মনোনীত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষন টিমের সদস্য

সারাবাংলা/এজেডএস

ড. মিহির কুমার রায় বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বনাম ক্রলিং পেগ পদ্ধতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর