Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চিন্তাই যখন মুক্তির পথ

মনোয়ার পারভেজ
৩১ মে ২০২৪ ১৮:৩৮

আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, বাঙালি নাকি অলস জাতি? আপনার কাছেও কি তাই মনে হয়? কই, বাঙালি তো প্রচুর পরিশ্রম করে থাকে। বিশেষ করে যদি বাংলাদেশের বাঙালিদের কথা বলি। অবহমান কাল থেকে বাঙালি মাঠে-ঘাটে-হাটে-বন্দরে পরিশ্রম করে আসছে। পরিশ্রমে থেমে নেই কোথাও। তবুও বাঙালির মুক্তি নেই কোথাও। তাহলে বাঙালির অলসতা আসলে কোথায়? বাঙালির অলসতার কথা যদি বলি, তাহলে সেটা হচ্ছে চিন্তাশক্তি বা চিন্তাভাবনার দিক থেকে। চিন্তাভাবনার দিক থেকে বাঙালি অনেকেটাই অলস জাতি সাথে ভীতুও। সুতরাং বাঙালির এই অলসতার কথা অগ্রাহ্য করা যাবে না। অথচ চিন্তাই হচ্ছে মানুষের মুক্তির পথ। চিন্তা থেকেই মানুষকে তার মুক্তির পথ খোঁজতে হয়। তাই বাঙালিকে সেই পথ চিনিয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে চিন্তাভাবনার দিক থেকে পিছিয়ে আছে বাঙালি মুসলমান সমাজ। এই নিয়ে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রসঙ্গে মহাত্মা আহমদ ছফা বলেছেন, “বাঙালি মুসলমানসমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসাভাবে, অনেককিছুই জানার ভান করে, আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সংকুচিত।”

বিজ্ঞাপন

মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা আছে। এটা অবশ্যই মানুষের জন্য আলাদা একটি বিশেষ যোগ্যতা। তাহলে মানুষ কেন চিন্তা করবে না? অবশ্যই মানুষকে চিন্তা করতে হবে। চিন্তা করবে এজন্যই যে, চিন্তায় তার নিজের মুক্তির উপায় খোঁজে বের করতে হবে, তারপর একে একে গোষ্ঠী, দেশ ও বিশ্ব অর্থাৎ মনুষ্য জাতির মুক্তির পথ খোঁজে বের করতে হবে। কেননা জাতির ও জাতীয় মুক্তির সাথে অর্থনৈতিক মুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লেনিনের ভাষায়, “জাতীয় মুক্তি ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি আসে না।” কোথায় যেন শুনেছিলাম “শিক্ষার শক্তি, অর্থনীতির মুক্তি।” একটি রাষ্ট্রের জন্য অর্থনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাও পারে সেই অর্থনীতির মুক্তি ঘটাতে। কিন্তু এখনকার প্রচলিত শিক্ষা থেকে সেটা হবেনা। কেননা এখনকার শিক্ষা হচ্ছে ব্যক্তি স্বার্থ কেন্দ্রিক ও পুঁজিবাদী। কিন্তু এই থেকে উত্তরণের পথ কি আমাদের খোঁজে বের করতে হবেনা? কী বলেন? অবশ্যই করতে হবে। তার জন্য চিন্তাকে শানিত করতে হবে। আপনি আপনার চিন্তা প্রকাশ করতে পারছেন না, এখানে অবশ্য পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর দায় চাপানো যায়। কিন্তু আপনি চিন্তাই করতে পারছেন না এটা অবশ্যই আপনার দৈন্যতা হিশেবে মেনে নিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

আমাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা ছিল শিক্ষা থেকেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষা মাধ্যম গুলো বাস্তবতা কী বলে? আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা মাধ্যমের কথাই যদি বলি। বিজ্ঞান ক্লাসে তোতাপাখির মুখস্ত বিদ্যার প্রসঙ্গ নাহয় আপাতত বাদেই দিলাম। বিজ্ঞান ক্লাসে আমাদের একেক জন শিক্ষক যেন ধর্মীয় স্কলার হয়ে যান। ধর্ম শিক্ষা খারাপ কিছু বলছিনা। তবে এমন ধাচের শিক্ষক আর বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে আর যাই হোক না কেন, কোনো সৃজনশীল ও বিজ্ঞান চিন্তার প্রজন্ম তৈরি হয়না!

আসলে আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি বা তৈরি করতে পারিনি। এখানে নামে মাত্র বিজ্ঞান বিভাগ নামে একটা শাখা তৈরি হয়েছে। তারপর অধিকাংশ বিজ্ঞান শিক্ষকেরাই নাম মাত্র চাকরি করতে আসেন। বিজ্ঞান শেখাতে আসেন না। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা – সর্বত্র বিজ্ঞানের নামে মুখস্ত বিদ্যাই চলে। নেই কোনো জ্ঞান চর্চা ও গবেষণা! আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা চিন্তা করতে শেখায় না, কৌতূহল বা আগ্রহও সৃষ্টি করেনা। কেননা তারা মুখস্ত করতে ব্যস্ত। অথচ শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান শিক্ষা হওয়ার কথা ছিল আনন্দদায়ক ও কৌতূহলী। শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান চিন্তায় খেলা করবে। তাদের চিন্তায় প্রসারণ ও সৃজনশীলতা প্রকাশ পাবে। সেই পরিবেশ কি এখানে তৈরি করতে পেরেছি বা হবে কখনও?

এবার সাহিত্যে চিন্তাধারার ইতিহাস প্রসঙ্গে কিছুটা আলোচনা করা যাক। সাহিত্য ও মানুষের চিন্তাভাবনার শক্তিকে জাগ্রত করতে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বিংশ শতাব্দিতে। ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন মূলত গড়ে উঠেছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’, এই আপ্তবাক্য সামনে রেখে। বাঙালি মুসলমান সমাজের যুগ যুগান্তরের আড়ষ্ট বুদ্ধিকে মুক্ত করে জ্ঞান-পিপাসা জাগিয়ে তোলাই ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য। এছাড়াও আরো লক্ষ্যের মধ্যে ছিল ‘শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো’ বিতরণের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা, কৃষি নির্ভর দেশ মাতৃকার কৃষকদের স্বাবলম্বী করে তুলতে সাহায্য করা এবং কৃষক সমাজের দুঃখ দুর্দশা থেকে মুক্তির পথ দেখানো। এই আন্দোলন গড়ে ওঠার পেছনে মূল প্রেরণা হয়ে কাজ করেছে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামের অরাজনৈতিক ও প্রগতিশীল একটি সংগঠন। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের সমাজ সচেতন করে তোলা এবং নানারূপ অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করা। সংগঠনটির নাম ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ হলেও, এর কর্মকান্ড আবর্তিত হতো হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালির জন্য। এই আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন কাজী আবদুল ওয়াদুদ, আবুল ফজল, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম ও আবদুল কাদির প্রমুখ। এই সংগঠনের মুখপত্রের নাম ছিল ‘শিখা’। শিখা’তে যারা লেখালেখি করতেন তারা বা সে সূত্রে এর সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা ‘শিখা গোষ্ঠী’র লেখকরূপে পরিচিত ছিলেন। শিখা’ মুখপত্রে লেখকরা সমাজে বুদ্ধির মুক্তির উপায়ন্তর নিয়ে লেখালেখি করতেন এবং পাঠক সমাজের কাছে তোলে ধরতেন। এবং তারা বলতে ও বুঝাতে চেয়েছেন চিন্তাই হতে পারে মুক্তির পথ। তাই সমাজের মধ্যে যেসকল গোড়ামী রয়েছে সেটা ধরিয়ে দেওয়া সাহিত্যের একটি কাজ। সেই কাজটিই করে যাচ্ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদেরকে আবার নতুন করে সেই আন্দোলনে সোচ্চার ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব গড়ে তোলা অতীব প্রয়োজন। আর চিন্তার মুক্তি মানেই বুদ্ধির মুক্তি। নিজের চিন্তাকে সংকুচিত রেখে অন্যের চিন্তায় দাসত্ব করার মাধ্যমকে পাল্টাতে হবে। মনে রাখতে হবে, চিন্তা ব্যথিত আপনার নিজস্ব মুক্তি আসবে না। আপনার মুক্তি আপনাকেই খোঁজে নিতে হবে বিদায়, সেটা নিয়ে আপনাকে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। এবং সকলের চিন্তার মাধ্যমেই জাতীয় মুক্তির পথ খোঁজে পাওয়া সম্ভব।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

চিন্তাই যখন মুক্তির পথ মনোয়ার পারভেজ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর