Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা কি অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে পারে?

মো. সাইফুল আলম তালুকদার
৩১ মে ২০২৪ ২০:৫০

বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, এমনকি ইকুইটি হারাচ্ছে, সেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া) ২০২৩-২৪ সালে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার কোটি রুপির রেকর্ড মুনাফা সরকারকে দিতে যাচ্ছে। এই সংখ্যা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এর আগের বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা ছিল ৮৬ হাজার কোটি রুপির কিছু বেশি।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিপুল পরিমাণে মুনাফার পিছনে রয়েছে ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে সফলতা, কারণ তাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস একাউন্টে উদ্বৃত্ত ছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশে ঠিক উল্টোটি ঘটেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক যেখানে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছিল, সেখানে গত বছর অর্থাৎ,  ২০২৩ সালে নেমে এসেছে মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকায়। (খরচ পরবর্তী নিট মুনাফা দাঁড়িয়ে ছিল ১০ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা।‌ ডলার সংকটের কারণে আমাদের এই অবস্থায় পড়তে হয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের ফরেন রিজার্ভ কমে যাওয়ার ধকলটাও সামলাতে হচ্ছে। তবে বাংলাদেশেরও ব্যালেন্স অব পেমেন্টস গত ২০২৩ থেকে উদ্বৃত্ত রয়েছে, যেটাতে আগে ঘাটতি (ঋণাত্মক) ব্যালেন্স ছিল। যদিও ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের আরেকটি অংশ কারেন্ট একাউন্ট গত চার বছর ধরে ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ বা ২৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা টাকার মুনাফা ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অর্জিত হয়েছিল। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচুর পরিমাণে টাকা ছাপিয়ে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি মিটিয়েছিল। যার বিরূপ ফল এখন আমরা ২০২৪ সালে ভোগ করছি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে মুদ্রাস্ফীতি কমা শুরু হলেও আমাদের দেশে তা বেড়েই যাচ্ছে। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা, যার ৮১ শতাংশ অর্থাৎ, এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।‌ আর বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুনাফা করেছে তার ৪৭ শতাংশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে সরকারকে ঋণ দিয়ে।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এত বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জনের পেছনে আরেকটি প্রধান কারণ ছিল তারা প্রচুর পরিমাণে উন্নত দেশগুলোর‌ ঝুঁকিমুক্ত সার্বভৌম সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ করেছিল, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিলে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ছিল। তবে এটা ঠিক, আগামী দিনে ডলার-রুপি থেকে মুনাফা কমে যাবে, কারণ গড় মুনাফা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ‌

২০২৩-২৪ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশাল অংকের মুনাফা আগামীতে বহির্বিশ্বে ভারতের ক্রেডিট রেটিং আরও উন্নত করবে। শুধু তাই নয়, রাজস্ব ঘাটতি মেটাতেও এই সাফল্য কাজে দেবে। ভারতীয় সরকার ইতোমধ্যে তাদের রাজস্ব ঘাটতি আগামী দুই বছরের মধ্যে ৫.৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য স্থির করেছে। চলতি বছরের বিপুল মুনাফা রাজস্ব ঘাটতি এ বছরেই ৫.১ শতাংশে নামিয়ে আনবে‌ বলে আশা করা হচ্ছে।

যদিও এ নিয়ে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এটা রাজস্ব বহির্ভূত মুনাফা এবং আগামীতে ডলার-রুপি থেকে মুনাফা কমে যাবে। তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটা জানে, বিধায় আরবিআই কনটেনেজেন্সি রিক্স বাফার (সিআরবি) অনুপাত ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬.৫ শতাংশে উন্নীত করেছে, যেটা কোভিডকালে ৫.৫ শতাংশ ছিল।

অন্যদিকে আমরা কেবল টাকা ছাপিয়েই যাচ্ছি। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অর্থাৎ, মুদ্রাস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদের হার কয়েক মাস অন্তর অন্তর বাড়ানো সত্ত্বেও টাকা ছাপানো কমানো হয়নি। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত টাকা ছাপানোর পরিমাণ দাঁড়িয়ে ছিল দুই লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা থেকে দুই লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, ওই তিন মাসে অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে।

অনেকেই বলছেন বাড়তি টাকা ছাপানো মুদ্রাস্ফীতির একমাত্র কারণ নয়। তাদের মতে, অধিকাংশ বড় বড় প্রজেক্ট থেকে আয় আসা এখনো শুরু হয়নি। যদিও আগামীতে এসব বড় প্রজেক্টের জন্য নেওয়া বিদেশি ঋণের কিস্তি প্রদান শুরু হলে অর্থনীতিতে  চাপ আসতে পারে, বিশেষ করে যদি রফতানি আয় না বাড়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ( ২০২৩ এর জুলাই থেকে ২০২৩  এর নভেম্বর) রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১ দশমিক ৩০ শতাংশ আর রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে ০.১৭ শতাংশ হারে।

এবার আসি আসল কথায়। অর্থাৎ, যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা কী একটি দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে পারে?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে পারে কিনা, তা নির্ভর করে কিভাবে এবং কোথায় সেই মুনাফা ব্যবহার করা হয় তার উপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাধারণত সরাসরি মুনাফার জন্য পরিচালিত হয় না। তাদের প্রধান ভূমিকা হলো মুদ্রানীতি ঠিক করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা কিছু ক্ষেত্রে অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

১) সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা সাধারণত সরকারের কোষাগারে জমা হয়। এই অতিরিক্ত অর্থ সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারে, যা অর্থনীতির বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি এই মুনাফা অবকাঠামো প্রকল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজের অর্থায়নের জন্য ব্যবহার করা হয় তবে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নকে উদ্দীপিত করতে পারে।

২) মুদ্রানীতি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুনাফা অর্জন করতে গিয়ে বিভিন্ন মুদ্রানীতি প্রয়োগ করতে পারে, যেমন সুদের হার পরিবর্তন বা ওপেন মার্কেট অপারেশন। এই নীতিগুলো সরাসরি অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও খরচে প্রভাব ফেলতে পারে।

৩) আর্থিক প্রভাব বৃদ্ধি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে। এটি সুদের হার কমাতে পারে এবং বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য সম্পদ ব্যবহার বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে।

৪) আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায়: এই লাভের দক্ষ ব্যবস্থাপনা আর্থিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে পারে, যা একটি সুস্থ অর্থনৈতিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূল্য এবং আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করে।

৫) ব্যাংকিং খাত: কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মুনাফা ব্যবহার করে ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করে, তবে তা বিনিয়োগ ও ঋণপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পারে, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করতে পারে।

যদিও সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা অর্থনীতির গতি সঞ্চার করার প্রধান উপায় নয়, তবে মুনাফার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তা অর্থনীতির বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করতে পারে।

একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি আসলে নির্ভর করে তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উপর। গত এক দশকে আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর‌ সক্ষমতা সেই হারে বাড়েনি।‌ গত ১০ বছরে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মুনাফা ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কিছু বিশেষায়িত এবং বেসরকারি ব্যাংক গত ১০ বছর ধরে ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

উচ্চ খেলাপি ঋণ, কম দক্ষতা ও বেশি ব্যয়ের কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের মুনাফা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। রিটার্ন অন অ্যাসেট (আরওএ) বা সম্পদের তুলনায় মুনাফার হার ২০২২ সালে ছিল ০.৫২ শতাংশ এবং গত বছরের জুনে তা আরও কমে ০.৪৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা কিনা আফগানিস্তানের চেয়েও কম। আফগানিস্তানে আরওএ ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

ক্যামেলস রেটিং যেকোনো দেশের ব্যাংকের সার্বিক শক্তিমত্তা নিরূপণ করে। ক্যামেলস রেটিংয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশক হচ্ছে ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, যার মধ্যে আয়-ব্যয়ের অনুপাত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বৈশ্বিক মান অনুসারে, আয়-ব্যয় অনুপাত ২৫ শতাংশ বা তার কম হলে সেটি প্রথম অবস্থানে থাকবে। ২৬ থেকে ৩০ শতাংশ হলে দ্বিতীয় স্থানে। এভাবে ৪৫ শতাংশ বা তার বেশি হলে সেটি থাকবে পঞ্চম বা একেবারে শেষ অবস্থানে। অথচ গত বছরের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আয় ব্যয় অনুপাত ছিল ৭১ শতাংশ। এই ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছে মন্দঋণের আধিক্য।‌ দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার পরে আমাদের মন্দঋণ সবচেয়ে বেশি।

লেখক: ব্যাংকার, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি

সারাবাংলা/আইই

টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর