প্রতিদিন দুধ পানে সুস্থ-সবল জীবন গড়ি
১ জুন ২০২৪ ১৪:২৪
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’- ঈশ্বর পাটনীর করা এই উক্তিতে মূলত স্বচ্ছল অবস্থা বোঝালেও দুধ যে সেই বহু প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালির পাতে উঠেছে সে কথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়। বাড়িতে জামাই এলে আম-দুধ দেওয়ার রীতিও বহু প্রাচীন। যাই হোক প্রতিদিন দুধ পান করা ছিল বাঙালির অভ্যাস। যদিও এখন তা অনেকটা বদলেছে বিভিন্ন কারণেই। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় একটি শিল্প হলো দুগ্ধ শিল্প। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির একটি বড় অংশ হলো দুগ্ধশিল্প। পুষ্টিরও অন্যতম বড় উৎস হলো দুধ। পৃথিবীর সেরা পুষ্টিদায়ক খাবারের নাম দুধ। দুধে থাকা ল্যাকটোজ মানুষের দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বাড়াতে সহায়ক। গরুর দুধ নানা পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ একটি খাদ্য। গরুর দুধে আছে অ্যমাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন-ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দুধ উৎপাদনের জন্য খ্যাত। আমাদের দেশে দুধের মূল উৎস হলো গাভী। এছাড়াও ছাগল, মহিষ থেকেও দুধ আরোহণ করা হয়। তবে এখানে গরুর দুধই প্রধান। আমাদের দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার সাথে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক গড়ে ২৫০ মিলিলিটার দুধ প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষ ২০৮ মিলিলিটার পাচ্ছে। দেশে এখন উৎপাদন ঘাটতি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার টন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ভোলা জেলা। এবং দ্বিতীয় বৃহৎ দুগ্ধ উৎপাদনকারী জেলা পাবনা। পাবনায় বছরে সাড়ে ৪ লাখ টন দুধ উৎপাদন হয়। পাবনায় ডেইরি খামারি রয়েছেন ১০ হাজারের মতো। প্রতিদিনের পুষ্টির একটি অংশ পূরণ করে দুধ। তাছাড়া বাঙালির রসনা বিলাসের সাথে ঐতিহ্যগতভাবেই দুধের একটি সম্পর্ক রয়েছে। পিঠা, পুলির আয়োজনে দুধের বিকল্প নেই।
২০০১ সালে এফএও ১ জুনকে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ওই বছর থেকে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। দুধ শরীরকে ভালো ও সুস্থ রাখার পাশাপাশি, শরীরে শক্তি জোগান এবং ক্লান্তি দূর করে। মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। দাঁত ও হাত মজবুত রাখে। মাংসপেশি গঠনে ভূমিকা রাখে। চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে কম চর্বিযুক্ত দুধ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। পাকস্থলী পরিষ্কার রাখে এবং হজম শক্তি বাড়ায়। এ ছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের অভ্যন্তরে দুধের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সব বয়সী মানুষের প্রতিদিন দুধ পান করা প্রয়োজন। প্রতিদিনের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে দুধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুধ উৎপাদনও গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন জাতের গরু পালনের ফলে প্রসারিত হয়েছে দেশের দুগ্ধ শিল্প। স্বাধীনতার পর দেশে তরল দুধের উৎপাদন বেড়েছে ১৩ গুণ। আর গত ১১ বছরে দেশে দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাড়ে চারগুণ। তারপরও দেশে দুধের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। এই ঘাটতি পূরণ করাই এখন বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭১-৭২ অর্থ বছরে দুধ উৎপাদন ছিল ১০ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে দুধ উৎপাদন হয়েছে ১৪০ দশমিক ৬৮ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দুধ উৎপাদন ১৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে জনপ্রতি দৈনিক ২৫০ মিলি হিসেবে দেশে দুধের চাহিদা ১৫৮ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন। এ হিসেবে দুধের ঘাটতি রয়েছে ২৫ দশমিক ৯৪ লাখ মেট্রিক টন। প্রাণী সম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৩.৭০ লাখ টন। বহু চ্যালেঞ্জ পার করে দুগ্ধশিল্প বর্তমান অবস্থানে পৌছেছে।
২০১০-১১ অর্থবছরে দাড়ায় ২৯.৫০লাখ টন, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৪.৬০ লাখ টন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫০.৭০ লাখ টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬০.৯২ লাখ টন, ২০১৫-১৬ তে ৭২.৭৫ লাখ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯৪.১ লাখ টন, ২০১৮-১৯ তে ৯৯.২৩ লাখ টন এবং ২০১৯-২০ তে ১ কোটি ৬.৮০ লাখ টন দুধ উৎপাদন হয়। এক তথ্যে দেখা যায়, দেশে দুধের বার্ষিক চাহিদা ১৫২ লাখ মেট্রিক টন, যার বিপরীতে উৎপাদন ১০৬ দশমিক ৮ লাখ মেট্রিক টন। প্রাণী সম্পদ অধিদউুরের পক্ষ থেকে দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২০৩১ সালে ২০০ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০৪১ সালে ৩০০ লাখ মেট্রিক টন নির্ধারিত আছে। অর্থাৎ দেশ দুধ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বেশ কয়েক বছর ধরে ছাগলের দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে মোট দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ২৩তম। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ দুধ উৎপাদন হয় এশিয়ায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাজারে দুধের দামের সাথে গাভী পরিচালনা ব্যয়ের পার্থক্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ক্ষুদ্র খামারী বা যাদের একটি, দুটি গাভী রয়েছে তারা উৎসাহ হারাচ্ছে। এছাড়া বাজারজাত করণের অপর্যাপ্ত সুবিধার কারণেও দুধের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গো-খামারীরা। মূলত বাড়তি দামই এখন মাথা ব্যথার কারণ। বাজার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে এক লিটার পাস্তুরিত তরল দুধের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। কিন্তু এখন সেটা ১০০ টাকা ছুই ছুই। ডেইরি খাত শক্ত অবস্থানে ধরে রাখতে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। সেক্ষেত্রে সঠিকভাবে বাজারজাত করণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
বিশ্ববাজারে দুগ্ধপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাবে এই দাম বৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে। ফলে খামারিদের লোকসানও বাড়ছে এবং খামারের সংখ্যা কমছে। গ্লোবাল ডেইরি ট্রেডের চতি মাসের প্রথম নিলামে দুগ্ধপণ্যের বৈশ্বিক দাম ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি টনের গড় মূল্য দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১০৪ ডলারে। এ নিলামে সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয় ৪২ হাজার ১৫ টন দুগ্ধপণ্য। বিশ্ব অর্থনীতির চলমান সংকটের মধ্যে প্রভাবে দুগ্ধ পণ্য উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। শীর্ষ উৎপাদন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পরেছে। দুগ্ধপণ্যের শীর্ষ ক্রেতা হলো এশিয়ার দেশগুলো। এর মধ্যে ননিযুক্ত ও ননিবিহীন গুঁড়ো দুধ ও মাখনের সবচেয়ে বড় ক্রেতা উত্তর এশিয়ার দেশগুলো। আমাদের দেশের আনাচে কানাচে রয়েছে অসংখ্য গো-খামার। খামার ছাড়াও অর্থাৎ পরিকল্পিত খামার ছাড়াও গরু পালন করে অসংখ্য নারী-পুরুষ। গাভী পালন করে এবং দুধ বিক্রি করে গ্রামের অনেকেই আজ সাবলম্বী। এক তথ্যে দেখা যায়, সব মিলিয়ে সারা দেশে দুধ দেয় এমন গরু, মহিষ ও ছাগল আছে ১৮ লাখের মতো। সেখান থেকে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে দুধ উৎপাদন হয়। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) এর অগ্রগতি প্রতিবেদন (জানুয়ারি ২০১৯-ডিসেম্বর ২০২৩) অনুযায়ী দেশে দুধের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে মিল্ক কালেকশন সেন্টার, প্রসেসিং জোন উল্লেখ্যযোগ্য। দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় দুধ থাকা আবশ্যক। এতে পুষ্টির চাহিদার একটি বড় অংশই পূরণ হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ থেকেও রক্ষা পাবে জীবন।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই