বাংলাদেশে মরুময়তা: একটি জীবনচক্র
৫ জুন ২০২৪ ১৪:৪৫
“সে ছিল এক নাতিশীতোষ্ণ দেশ, হৃদয়জুড়ে যার মমতার আবেশ; কালের ছোবলে হারিয়েছে যত মহনীয় তটিনী, বিষন্ন প্রকৃতিতে ছেয়েছে অবিরত এক ক্ষয়িষ্ণুতার রেশ; দিকে দিকে মরুময়তার রুক্ষতায় জেগে উঠেছে ছিন্নমুল কলমের কালি অশেষ সংকল্প, সহিষ্ণুতা, সাগ্রহ আর সন্নিবেশে অর্জন করতে হবে সুরক্ষিত পরিবেশ বিশেষ।”
কোলাব্যাঙের গান শুনতে পায়নি, বাংলাদেশের এমন কোনও নাগরিক খুঁজে পাওয়া যাবে না। জল ও স্থলে বসবাস করা উভচর প্রাণী এই কোলাব্যাঙের (Bullfrog) প্রজনন মৌসুম হল বর্ষাকাল। এ সময় পুরুষ কোলাব্যাঙ ও স্ত্রী কোলাব্যাঙ এর মিলনের ফলে পরিণত সময়ে একটি স্ত্রী কোলাব্যাঙ গুচ্ছাকারে পানিতে ডিম পাড়ে এবং ৩৫০০ থেকে ১২৫০০টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। প্রায় ২১ দিনে ডিম ফুটে ব্যাঙাচিতে পরিণত হয়। এই ব্যাঙাচি পানিতে সাঁতার কাটে এবং বেড়ে উঠতে উঠতে ছোট ছোট উদ্ভিদ, শৈবাল ইত্যাদি খায়। এরপর প্রায় ৪৩ দিনে পরিপূর্ণ ব্যাঙের রূপ নেয়। শীতকালে এরা কোনও ফাঁকফোকরে বা নরম মাটির নিচে আশ্রয় নেয়- অপেক্ষায় থাকে আবার বৃষ্টির। বৃষ্টির পানি পেয়ে গরমে শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া মাটি নরম হলেই মাটি ফেটে, ফাঁকফোকরে লুকিয়ে থাকা কোলাব্যাঙের দল বেরিয়ে আসে। শুরু হয় নতুন জীবন চক্র। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রাণের সঞ্চারে ঠিক এভাবেই বাংলার জল-ডাঙ্গায় প্রকৃতি তার প্রাণচাঞ্চল্য পায়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকৃতির স্বাভাবিক এই বাস্তবতাও রূপ নিয়েছে নির্মমতায়। জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়ন্ত্রিত ভূমি ও নদনদী দখল/হরণ আর নগরায়নের ফলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে তার রুপময় নাব্যতাকে। তাহলে কী করে বাঁচবে এই কোলাব্যাঙের জীবনচক্র?
বাংলাদেশের মরুময়তার প্রশ্নে আমাদের দেশের সাংবাদিক, পরিবেশবিদ এবং সুধী সমাজ তাদের তথ্য, লেখনী কিংবা বক্তব্যে বরাবরই সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। এক্ষেত্রে, ২০২২ সালের ১৮ মার্চ, দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত “মরুকরণ প্রশ্নে বাংলাদেশ” শীর্ষক লেখনিতে যে বিষয়গুলোতে আলোকপাত করা হয়েছিল তা ছিল মূলত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বড় বড় শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ, নির্বিচারে বন উজাড়, অপরিকল্পিত নদী শাসনের ফলে পানির বৃদ্ধি এবং হ্রাসের প্রকট প্রভাবে বাংলাদেশ আশংকাজনকভাবে মরুকরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে। আরেকদিকে পানির সঙ্কটের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, এই প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল, মার্কিন ভূবিজ্ঞানী ড. নারম্যান ম্যাকলিয়ও-এর কথা। যিনি সাহারা মরুভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন, তিনি জানিয়েছেন, “সাহারা মরুভূমি শুরু থেকে যেভাবে মরুকরণের দিকে এগিয়েছে, ঠিক একই কায়দায় বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বাতাসেও সাহারা মরুভূমির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো লু হাওয়া বইছে।”
‘বিশ্ব মরুময়তা ও খরা প্রতিরোধ দিবস ২০২২’ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার ভূমির অবক্ষয় রোধে ব্যাপক হারে বনায়ন করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভূমি অবক্ষয় রোধ এবং খরা প্রশমন করে একটি ভূমি অবক্ষয়-নিরপেক্ষ দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে। তিনি বলেন, সরকার বন উজাড় রোধ, বনাঞ্চল পুনরুদ্ধার, নতুন বন সৃষ্টি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ভূমির ক্ষয়রোধ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। জনগণ নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক হারে বৃক্ষরোপণ করলে এ কাজে সফল হবে বাংলাদেশ।
বর্তমান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী গত ১২ মে ২০২৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে জানান, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তাপমাত্রা কমাতে ঢাকায় নগর বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে সেজন্য বিশেষ স্যাটেলাইট ইমেজ তৈরি করা হচ্ছে যার মাধ্যমে কোথায় গাছ লাগাতে হবে তা নির্ধারণ করা হবে। মাননীয় মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ঢাকার ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান (ক্যোপ) চালুর মাধ্যমে পরিবেশ টেকসই করার জন্য রূপান্তরমূলক যাত্রা শুরু হয়েছে। এদিকে গত ১ মে ২০২৪ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও সিসকোর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী বলেন, ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাস এবং ডি-কার্বনাইজেশনের প্রভাবের মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার সময় উৎপাদনশীলতা বাড়াতে স্মাট কৃষি কৌশল বাস্তবায়নে সরকার বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা এবং কৃষকদের মাধ্যমে উদ্যোগী হয়েছে। ৩০ এপ্রিল ২০২৪ এর আরেকটি মত বিনিময় সভায় মাননীয় মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতনতা এবং সংলাপ বৃদ্ধি করতে গণমাধ্যমকে ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে গণমাধ্যমকর্মীরা জলবায়ু অভিযোজন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে পারেন। মরুময়তা রোধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা এবং পদক্ষেপ এখানে মুখ্য।
মরুময়তায় প্রকৃতির রূপক অর্থে কোলাব্যাঙের জীবনচক্র ও পরিবেশের বিপর্যয়ের ব্যাখ্যায় সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারের উদ্যোগের তথ্যগুলো আটিকেলটিকে অনেকটাই পূর্ণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ/প্রভাব/বিপর্যয় ঠেকানো বেশ করেই সম্ভব। যেখানে বাঁধা মূলত, আমরা। অপরিকল্পিতভাবে বন, গাছপালা উজাড় করে বন্যপ্রাণী, কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনে আমরাই হুমকি/বিলুপ্তির পথ তৈরি করছি। অনিয়মের বেড়াজালে নদনদী ভরাট করে, দখল করে জলজ আর উভচর প্রাণীদের বিনাশ করছি। প্রাণী হয়ে অন্য প্রাণীর জন্য হুমকি হচ্ছি, খরতায় ভূমিকা রাখছি। প্রাণী হয়ে প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন করে কীভাবে আমরা আশান্বিত হই আমাদের স্বাভাবিক জীবনচক্র নিয়ে!
বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে বদ্ধ পরিকর। তাদের উদ্যোগগুলো হয়েছে প্রশংসনীয়, সমাদৃত। যাতবে কাগজে-কলমে এসব উদ্যোগ সফলতায় রুপান্তরিত হয়নি এখনও। হতে পারে শুধুমাত্র আপামর জনসাধারণ পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ হলে, গৃহীত প্রকল্পে বাধা সৃষ্টি না করে সহযগিতার হাত বাড়ালে, নিজেকে ক্রমাগত সম্পৃক্ত রাখলে এবং এসব উদ্যমের পুনরাবৃত্তি হবে। আমাদের চারপাশে যা কিছু বিদ্যমান তার সবকিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ, যেখানে চাই একটি স্বাভাবিক জীবনচক্র। তাই সবশেষে প্রশ্ন একটাই, আমরা কী সেই স্বাভাবিক জীবনচক্রটা চাই?
লেখক: আইনজীবী
সারাবাংলা/এসবিডিই