Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হিপ্পি সংস্কৃতি ও আধুনিক সমাজের বৈসাদৃশ্য

মো. আবদুল্লাহ আলমামুন
৮ জুন ২০২৪ ১৩:২৭

সংস্কৃতি ও মানুষ খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। কারণ মানুষ সংস্কৃতি লালন করে। কোনো অঞ্চলের মানুষের চলাফেরা, প্রথা, রীতিনীতি, উৎসব নিয়ে সংস্কৃতি গঠিত হয়। তবে স্থান, কাল ভেদে সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার এর মতে, ‘আমরা যা তাই সংস্কৃতি’। সুতরাং সংস্কৃতি প্রত্যেক সমাজের অপরিহার্য অংশ। বাঙালি জাতির আছে হাজার বছরের পুরনো সংস্কৃতি। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এক সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। তারা নিজেদের বলে ‘আই অ্যাম হিপ্পি’ পরিচয় দিত। আবার কিছু মানুষ তাদের হিপ্পিস্টারস বলে অভিহিত করত। ষাট ও সত্তর দশকে মার্কিন তরুণ প্রজন্ম কেন্দ্র মূলত হিপ্পি সংস্কৃতি আবির্ভাব হয়। তৎকালীন সময়ে তরুণ প্রজন্ম বিপ্লবের ডাক দিয়েছিল। তারা চেয়েছিল সমাজ পরিবর্তন করতে। এভাবে হিপ্পি আন্দোলন শুরু।

বিজ্ঞাপন

সংগীত সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সে সময়ে সংগীতের ধরনও পরিবর্তন হয়েছিল। জ্যাজ ও সুইং জায়গা দখল করে নেয় রক এবং রক অ্যান্ড রোল। এই কারণে ধারণা করা হয় বিট সংস্কৃতি থেকেই হিপ্পি সংস্কৃতির উদ্ভব। মার্কিন তরুণ প্রজন্ম স্বপ্নাতুর আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল এবং সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল মার্কিন দেশ থেকে ভিন্ন দেশে। ফলে বিশ্বের অনেক দেশ খুব দ্রুত হিপ্পি সংস্কৃতি নিয়ে জানতে পারে। সে সব দেশেও সৃষ্টি হয়েছিল বিদ্রোহের সূত্রাপাত। এ যেন এক স্বাপ্নিক আন্দোলন। যদিও আন্দোলনটি সুসমন্বিত ছিল না। ছিল না লিখিত ইশতেহার কিংবা একক কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব; ছিল কেবল পরিবর্তনের জন্য হাহাকার আর কর্পোরেট-প্রভাব, ভোগবাদ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের রক্তাক্ত অভিলাষ পরিত্যাগ করে এক যৌথ পরিভ্রমণশীল সহজ জীবনধারায় ফিরে যাওয়ার তীব্র আকুতি।

বিজ্ঞাপন

হিপ্পি সংস্কৃতির যুগান্তকারী রূপ নেয় সানফ্রানসিসকোতে। এখানে গড়ে উঠে হিপ্পি বিপ্লবের কেন্দ্র। ষাটের দশকের গোড়ায় সংগীত, সাইকোঅ্যাকটিভ ড্রাগস, যৌনস্বাধীনতা, সৃজনশীলতা এবং প্রগতিশীল রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। সানফ্রানসিসকোর হাইট-অ্যাশবারি; এখানেই ১৯৬৭ সালের গ্রীষ্মে মার্কিন সমাজের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে এক লাখ সংস্কৃতি কর্মী ও হিপ্পিদের এক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই মহাসমাবেশ ‘দ্য সামার অব লাভ’ নামে পরিচিত। ওই একই সময় হিপ্পিরা নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, ফিলাডেলফিয়া এসব শহরে জড়ো হয়ে নিজেদের উপস্থিতি তুলে ধরে। এর ফলে হিপ্পি-দর্শন এর প্রতি মার্কিন জনগণ সচেতন হয়ে ওঠে। ফলে বিংশ শতকে ত্রিশ বছরের মধ্যে দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হলো। মার্কিন সমাজে অর্থনৈতিক মহামন্দা দেখা দেয়। সাধারণ জনজীবনে বিপর্যয় দেখা দেয়। এসব মর্মান্তিক ঘটনার ফলে সচেতন কবি-সাহিত্যিক সচেতন হয়। তাদের মনে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের ভাবনা তৈরি হয়। তারা ভাবল আসলে সমাজ মানুষের ওপর মূল্য আরোপ করে মানুষের অবশ্যই সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করা উচিত। এভাবে পঞ্চাশের দশকে-বিশেষ করে মার্কিন সাহিত্যমহলে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ। তবে এই কবির নাম সবার জানা থাকলেও তাদের ভূমিকা অজানায় রয়ে গেছে।

পঞ্চাশের দশকের কবিদের কবিতায় ক্ষোভ আর হতাশা বাড়তে থাকে। তাদের যে ঞযব ইবধঃং বলা হত তার কারণ এই কবিতার সুরারোপ ও তালের প্রয়োগ। পঞ্চাশের দশকে এ আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। কফি হাউসগুলোয় আড্ডা চলে। আজো কফিহাউসগুলো কবিতার পাঠ হয়। এসব ছন্নছাড়া দের পরনে সর্বদা শীর্ণ পোশাক, মুখ ভরতি দাড়িগোঁফ, লম্বা চুল আর চোখে লালচে সানগ্লাস। দিনভর মূলত জ্যাজ ও সুইং সংগীত ডুবে থাকতো। তবে হিপ্পি শব্দের প্রকৃত মানে অনেকেই জানে না। সান ফ্রানসিসকো ক্রনিকলের কলাম লেখক হেরব কায়েন শব্দটি জনপ্রিয় করে তোলেন। হিপ্পিদের বিটনিকসদের নতুন প্রজন্ম বলা হল। হিপ্পিরা বিটনিকসদের কফিহাউসভিত্তিক সংলাপ আড্ডা ছড়িয়ে দিল আমেরিকার পথে প্রান্তরে। সীমানা পেরিয়ে গেল। নিউজিল্যান্ডের নামবাসা থেকে মেক্সিকোর আভানডারো। সবর্ত্রই বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর বিতৃষ্ণা। আর যৌথ পরিভ্রমণশীল সহজ জীবনধারায় ফিরে যাওয়ার আকুতি।

হিপ্পিদের অনেকেই যিশু, বুদ্ধ, হেনরি ডেভিড থুরো এবং মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত। তবে হিপ্পিরা শান্তিপ্রিয় ছিল। তারা ষাট দশক জুড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করছে। তারা বিশ্বাস করত যুদ্ধ কখনো শান্তি নিয়ে আসতে পারে না। ১৯৬৪ সালের ২২ এপ্রিল ডাবলিউ এন বিসির টিভির চ্যানেল ফোর-এ এক জন ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদকারীকে দেখা যায় নিউইর্য়ক শহরের রাস্তায় অবস্থান ধর্মঘট করছে। প্রতিবাদকারীর পরনে টিশার্ট, ডেনিম জিন্স ও লম্বা চুল। বিশেষ করে হিপ্পিদের পোশাক পরিচ্ছেদের কারণে সারা বিশ্বে নতুন রূপ নেয়। পুলিশ অফিসার ও রিপোর্টাররা তাদের বলছে হিপ্পি। আর এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো মার্কিন টিভিতে হিপ্পি শব্দটি উচ্চারিত হল। হিপ্পিরা এমন এক বিশ্বজনীন বিশ্বাস-ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে যা প্রতিষ্ঠিত সামাজিক, রাজনৈতি এবং নৈতিক কাঠামোকে ছাপিয়ে যায়।

হিপ্পি-দর্শনের মূলে রয়েছে প্রেম ও স্বাধীনতা-যা বিদ্যমান দমনমূলক পুরোহিততান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোয় নেই। এ কারণেই অনেকে ষাটের দশকের হিপ্পি আন্দোলনে আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছিল। কারণ হিপ্পি আন্দোলন ছিল প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা-কাঠামোর বিরুদ্ধে বিপ্লব। যদিও হিপ্পিরা নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন করতে চায় না। হিপ্পিরা অন্যদের ওপর তাদের বিশ্বাস চাপিয়ে দেয় না। তারা নিজেদের জীবনধারা ও যুক্তি দিয়ে পৃথিবীকে বদলাতে চায়। মূলত হিপ্পিরা চেয়েছিল প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা প্রতিষ্ঠিত করতে। এছাড়া শান্তি ও অহিংসা সবার ছড়িয়ে দিতে।এই জন্য তারা অদ্ভুত পোশাক পরিধান শুরু করেছিল।

বর্তমান সমাজে হিপ্পি সংস্কৃতির প্রভাব হিপ্পি সংস্কৃতির কিছু আদর্শ ও মূল্যবোধ বর্তমান সমাজে বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান। বর্তমান পরিবেশগত আন্দোলনগুলি অনেকাংশে হিপ্পি সংস্কৃতির মূল্যবোধ থেকে অনুপ্রাণিত। টেকসই জীবনযাপন, পুনর্ব্যবহার, এবং পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব আধুনিক সমাজে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। মুক্ত চিন্তা ও সৃজনশীলতা, সংগীত ও উৎসব, প্রেম ও সৌহার্দ্য ইত্যাদির মাধ্যমে বর্তমান সমাজে আন্দোলন করে অনিয়ম প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু আধুনিক প্রজন্ম ভোগবিলাসী জীবনযাপন করে। তারা কিছুটা হিপ্পিদের মত ছেড়া পোশাক পরলেও কোনো প্রতিবাদী প্রতীক বহন করে না। বরং তাদের পোশাক পরিচ্ছেদ নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। বর্তমান সমাজে তরুণ প্রজন্ম ডিজে গান শুনে, যার কোনো অর্থ নেই। মাদক ও নেশাদ্রব্যে আসক্ত হয়ে গেছে। সংস্কৃতির মুখোশ পড়ে অপসংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে। কিন্তু হিপ্পিরা প্রেম ও মানবতার বার্তা প্রচার করতেন এবং একে অপরের প্রতি সদয় এবং সহানুভূতিশীল হওয়ার প্রচেষ্টা করতেন। তাই বর্তমান তরুন প্রজন্মের উচিত হিপ্পি সংস্কৃতির মতো গর্জে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য উদ্বুদ্ধ হওয়া।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তমত মো. আবদুল্লাহ আলমামুন হিপ্পি সংস্কৃতি ও আধুনিক সমাজের বৈসাদৃশ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর