হাসিনা-মোদি আমলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো
৯ জুন ২০২৪ ১৭:১৯
তৃতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। রোববার (৯ জুন) সন্ধ্যায় শপথ নিয়েছেন তিনি। এই রেকর্ড গড়তে মোদির পাড়ি দিতে হয়ে দীর্ঘ পথ। একদম সাধারণের কাতার থেকে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। মোদির এ ইতিহাস যেন কোনো রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। নির্বাচিত সরকারের প্রধান হিসাবে এরইমধ্যে জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীকে টপকেছেন তিনি। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী পদে তিনি থেকেছেন ৮ হাজার ২৭৭ দিন। সেখানে জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন ৬ হাজার ১৩০ দিন। আর ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচিত সরকারের প্রধান পদে ছিলেন পাঁচ হাজার ৮২৯ দিন। এবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ শেষ করতে পারলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীকে টপকে যাবেন মোদি।
এবারের লোকসভার ভোটের ফলাফল নিয়ে ভারত তো বটেই বাংলাদেশেও চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা তথ্য প্রকাশ হয়েছিল, যার কেন্দ্রে ছিলেন নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি। অনেকের প্রার্থনা ছিল- যেই জয়ী হোক সমস্যা নেই, কিন্তু মোদি যেন হেরে যান। গণমাধ্যমের বিশ্লেষণেও ছিল সেই ইঙ্গিত। ৬ জুন প্রকাশ হয় ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল। চারশোর বেশি আসন পাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচনে মাঠে নামা বিজেপি জয়ী হয় ২৪০ আসনে। দেশটিতে মোট ৫৪৫টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭২ আসন। অর্থাৎ, বিজেপি সেই ম্যাজিক সংখ্যা ছুঁতে পারেনি। আর শরীক দলগুলো মিলিয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট পায় ২৯২ আসন। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ইন্ডিয়া পায় ২৩৪ আসন।
নরেন্দ্র মোদি এবার লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন। প্রথমবার সরকার চলাতে ভরসা করতে হচ্ছে শরিকদের ওপর। সবার ভাবনা ছিল বিজেপির শরীক দল ডিগবাজি খেতে পারে। চন্দ্রবাবু নাইডু ও নীতীশ কুমার বারবার জোট বদল করেছেন। এবারও তেমনি হতে পারে বলে গণমাধ্যমে ফলাও করে খবর আসে। কংগ্রেসও ওই নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বেঠকে মোদিকে জোট নেতা নির্বাচন করেন চন্দ্রবাবু নাইডু ও নীতীশ কুমার। এখানেই শেষ নয়, জোট নির্ভর সেই সরকার কতটা স্বস্তির হবে তা নিয়ে যখন এরই মধ্যে বিরোধীরা সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেছেন, তখন এনডিএ বৈঠকে নরেন্দ্র মোদির পাশে মজবুতভাবেই দাঁড়ালেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা সংযুক্ত জনতা দলের নেতা নীতীশ কুমার। পুরনো সংসদ ভবনের ঐতিহ্যশালী সেন্ট্রাল হলে শুক্রবার এনডিএ-র বৈঠক বসে। সেই বৈঠকে মোদিকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে তাঁর পা ছোঁয়ার চেষ্টা করেন নীতীশ কুমার। মোদি অবশ্য তার আগেই নীতীশের হাত ধরে ফেলেন।
এত কিছুর পরও মোদি ম্যাজিক যে পুরোপুরি ফিকে হয়ে গেছে, তা বলার সময় আসেনি। এখনও এমন বহু ফ্যাক্টর রয়েছে, যা বুঝিয়ে দেয় ভারতের এক এবং অবিসংবাদী নেতা এখনও মোদি। কারণ বিজেপি তথা এনডিএর প্রত্যেক প্রার্থী দেশের সব প্রান্তেই ভোট চেয়েছেন শুধু মোদির নামে। তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জিতেও এসেছেন। কেউ কেউ হেরেছেন। এতে একটা জিনিস স্পষ্ট, এবারেও গোটা দেশে ভোট পড়েছে মোদির নামে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এবারের নির্বাচনে করেছেন মোদি। যে কেউ ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলে তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা মাথাচাড়া দিতে বাধ্য। সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ছাপিয়ে ১০ বছর পরও ২৪০ আসন পাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। যে ফলাফলকে বিজেপির জন্য বিপর্যয় বলা হচ্ছে, অতীতে বহু তাবড় নেতা সেই সংখ্যক সাংসদ জেতাতে পারেননি। এবার বিজেপির একার সাংসদ সংখ্যা কংগ্রেসের প্রায় আড়াই গুণ। গোটা ইন্ডিয়া জোটের চেয়ে বেশি।
চব্বিশের যে ফলাফলকে ‘বিপর্যয়’ বলা হচ্ছে, তাতেও বিজেপির ভোটভিত্তি বেড়েছে। এমন এমন রাজ্যে বিজেপির ভোট বেড়েছে, যেগুলোকে অতীতে গেরুয়া শিবিরের জন্য দুর্ভেদ্য বলে মনে করা হতো। দক্ষিণে ছাপ ফেলেছেন মোদি। আর উড়িষ্যাতে রীতিমতো চমক দিয়ে ক্ষমতা দখলের পথে বিজেপি। অটল বিহারী বাজপেয়ীর আমলেও যে বিজেপিকে শুধু হিন্দি বলয়ের পার্টি বলে মনে করা হতো, সেই দল এখন আসমুদ্রহিমাচল বিরাজমান। মোদির ‘দুর্দশা’র দিনেও দক্ষিণ এবং পূর্ব ভারতে ক্ষমতা বাড়াচ্ছে গেরুয়া শিবির।
টানা তৃতীয়বারের মোদির শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশ ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবীন্দ কুমার জগন্নাথ, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোগবে, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর আমন্ত্রণে বিদেশি অতিথিরা নৈশভোজেও যোগ দেন।
ভারত নেইবারহুড পলিসি (প্রতিবেশী দেশগুলো সম্পর্কে নীতি) মেনে চেলে। সেকারণে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। নরেন্দ্র মোদি সরকারের ১০ বছরে সেই বন্ধুত্ব আরও মজবুত হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ ও ভারতে নতুন সরকার গঠন হয়েছে, ফলে দুই দেশের সম্পর্কের ধারাবাহিকতাই থাকবে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ দেখা যাবে। তাই তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসছেন নরেন্দ্র মোদি। আগামী মাস দেড়েকের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত ও চীন সফরের কথা, স্বভাবতই এই বৈঠকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার বহাল থাকায়, তিস্তা চুক্তি সম্পাদন ও গঙ্গা চুক্তির নবায়ন, সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়ে উদ্যোগের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। মোদি -হাসিনা সরকারের আমলেই দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়, স্থল সীমান্ত চুক্তি, সড়ক পথে ট্রানজিট, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের অনুমতিসহ আরও বেশ কিছু চুক্তি হয়েছে। তাই ভারতের প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, মোদি ও হাসিনার আমলেই দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো হয়েছে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/আইই