বরষায় প্রেমের শর্তই হোক কদম না ছেঁড়া
১৫ জুন ২০২৪ ১৫:১৬
সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, করেছ দান’। সে-ই কাল হলো। তারপর থেকে শতবর্ষ ধরে দানবাক্সে কদম জুটছে জোড় কদম। বর্ষা এলেই সুন্দরী প্রেমিকাকে প্রথম কদম ফুলটা দেওয়া চাই, নইলে সম্পর্কই না যায় টুটে। আর প্রেম প্রত্যাশীরা তো পারলে গাছে কুঁড়ি ধরতেই কদম্বতলে বসিয়া থাকেন প্রথম কদম ফুলটা উপহার দিয়ে রূপসীর মন জয় করার তাড়নায়।
আর নাগরিক প্রেমের সেই দায় মেটাতে পথশিশু বালক বালিকারা শহরের সব কদম্ববৃক্ষ উজাড় করে গোল গোল বলের মতো কদম ফুলের তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করেন ট্রাফিক সিগন্যালের মোড়ে মোড়ে। প্রেমিকের হাত ঘুরে সে ফুল কিছুক্ষণ প্রেমিকার খোঁপার সৌন্দর্য বর্ধন করলেও একসময় তার ঠাঁই হয় ডাস্টবিনে অথবা ফুটপাথের ভাঙা পথের রাঙা ধূলায়।
অথচ ক্ষণিকের এই একটুখানি আনন্দের বিনিময়ে প্রকৃতি আর পরিবেশকে কতটুকু মূল্য দিতে হয় তা অনেকেই জানেন না।
গ্রীষ্মকালে ফলের অভাব হয় না। মানুষ, পশু, পাখি সবারই খাদ্য অফুরান। কিন্তু আম কাঁঠাল লিচুর মধুমাস শেষ হলে গাছে গাছে যখন ফলের আকাল হয় তখন যে অল্প কিছু ফলের ওপর পাখি, কাঠবিড়ালি, বাদুর প্রভৃতি প্রাণ নির্ভর করে বাঁচে- কদম তার মধ্যে অন্যতম। ভাদ্রমাসে যখন গাছে ফল থাকে না, তখন তাদের মঙ্গা-কাল। কদমের ফুল থেকে ফল না হলে প্রাণীজগতে নেমে আসে দূর্ভিক্ষ। আমরা তা টেরই পাই না, জানতেও পারি না। যদি আমরা বর্ষায় কদম না ছিঁড়ি, গাছেই তাকে ফল হতে দেই, তাহলে প্রাণীজগতে এই আকাল বা মঙ্গা আমরা রুখতে পারবো। বাঁচাতে পারবো অনেক প্রাণ।
আর একটা কদম ফলে থাকে প্রায় ৮ হাজার বীজ। পাখি, কাঠবিড়ালি, বাদুর সেই ফল খেয়ে বীজগুলো ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতিতে। একটা কদম ফুল ছেঁড়া মানে গাছের ৮ হাজার বীজ ধ্বংস করা। যদিও ৮ হাজার বীজ থেকেই যে গাছ হবে তেমন কথা নেই। কিন্তু যদি ১ হাজার গাছও হয়? সেই সম্ভাবনাকে আমরা বিনষ্ট করে দেবো আমাদের ক্ষণিকের একটু আনন্দের জন্য?
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষক গওহার নঈম ওয়ারা একটা পত্রিকায় বলেছেন “মন যতই চাক, কদম ফুল ছিঁড়বেন না। কেউ হীরার আংটির বিনিময়ে চাইলেও না। কদম তিনবার পুষ্পিত হয়। তাকে ফুটতে দিন। ভাদ্রমাসে যখন গাছে গাছে ফল থাকে না তখন পাখিদের, প্রাণীদের খাবারের আকাল চলে, সেটা তাদের মঙ্গাকাল। ঠিক তেমনি যেমনটা কার্তিকে আমাদের মঙ্গা হতো। ফলে ঐ সময় কদম প্রধান খাবার হয়ে ওঠে বাদুড় ও কাঠবিড়ালির। ওরাই বীজ ছড়ায়। পাখ-পাখালি না খেলে কদমবীজ থেকে গাছ হবে না। কদম বাঁচাতে- পাখিদের বাঁচাতে কদম ফুল ছেঁড়া বন্ধ রাখুন।”
আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রেজিনা লাজ বলেছেন “কদম ফল পাকলে ফলটি অনেকে খায়। একটা ফলের ভেতরে প্রায় ৮ হাজার বীজ থাকে। পাখি, বাদুড়, কাঠবিড়ালির খুব প্রিয় এই ফল। পাখিদের খাদ্য ধ্বংস করে দিচ্ছি কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার এবং অযথা ফুল ছেঁড়া বন্ধ করতে হবে। ফুল বেশি বেশি ছিঁড়লে যেকোনও উদ্ভিদের বিস্তার ব্যাহত হয়। কারণ ফল পরিপক্ক না হলে বীজের অঙ্কুরোদগম হবে না। তবে ফল পেকে গেলে এটা ফেটে যায় এবং বাতাস অথবা বৃষ্টির পানির মাধ্যমেও বীজের বিস্তার ঘটে।”
একসময় এই ঢাকা শহরে প্রচুর কদম ফুলের গাছ ছিল। কমতে কমতে এখন তলানীতে ঠেকেছে। আমাদের প্রেমের ক্ষণিক আনন্দের বলি হয়ে গাছটি না চিরতরে হারিয়ে যায়। কদম এমনিতে গাছ হিসেবে বিশাল। বহুশাখাবিশিষ্ট, ছায়াদানকারী। বেশ বড় বড় পাতা হয়, পাতাগুলোও দেখতে বেশ সুন্দর। কিন্তু সমস্যা হলো এই গাছের আর্থিক উপযোগিতা ভীষণ কম। কাঠ খুব নরম, তাই আসবাবপত্র তৈরি করা যায় না, আর তাই কাঠ হিসেবে এ গাছ অর্থকরী না। অথচ গাছটি বেশ অনেকটা জায়গা দখল করে রাখে। ফলে প্রায় কেউই এই গাছটি রাখতে চান না। শুধু ফুল দিয়ে তো আর সবার পেট চলে না। ফলে দিনে দিনে সারাদেশ থেকেই এ গাছ কমে যাচ্ছে। লাল কদম তো প্রায় বিলুপ্তই। হলুদ কদমও যাই যাই করছে। কিন্তু প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষায় এই গাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কদম বহিরাগত কোনো গাছ না, আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়া, চীন আর মালয়ের গাছ। আমাদের নিজেদের গাছ। তাই তো আমাদের সাহিত্যে, সঙ্গীতে, প্রেমে কদমের এতো উপস্থিতি। আমাদের কৃষ্ণ তো কদম্বতল ছাড়া বাঁশীই বাজান না!
কদম গাছ দিয়ে আসবাব না হলেও এর মন্ড দিয়ে কাগজ হয়, আর কাগজ দিয়ে হয় বই, শিক্ষা উপকরণ। কদম গাছ একেবারে যে অপ্রয়োজনীয়, তা কিন্তু বলা যায় না।
আধুনিক তরুণ তরুণীদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বেড়েছে। বৃক্ষপ্রেম বেড়েছে। ‘গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’ স্লোগান ছুটছে। সত্যি বলতে গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষা করতে হবে না, বিশ্বাস করুন। শুধু গাছগুলোকে বাঁচতে দিন। ফুলগুলোকে হাতের মুঠোয় না এনে গাছে থাকতে দিন, তাহলেই পরিবেশ রক্ষা পাবে। আপনাকে পরিবেশ রক্ষা করতে হবে না, পরিবেশ তার নিজের যোগ্যতাতেই নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। আপনি শুধু নিজ হাতে তার ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা ঠেকান। আর কিছু করতে হবে না।
তাই, প্রেমের শর্তই হোক কদম না ছেঁড়া। জুটিরা গর্ব করুক একটা কদম না ছিঁড়ে তারা ৮ হাজার গাছের জীবন বাঁচিয়েছে…। সেটাই হবে সবচেয়ে সুন্দর প্রেম।
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল না পেলে যে প্রেম হয় না, সে প্রেম এমনিতেও হবে না বলেই মনে হয়। বরং রবিঠাকুরের আরেকটি গান মনে করতে পারেন- ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথী তলে এসো করো স্নান নবধারাজলে…’। নীপবন হলো কদম বাগান। ফুলগুলোকে বাঁচান, নীপবন গড়ে উঠতে দিন, সেই নীপবনের ছায়াবীথীতলে স্নান করুন নবধারাজলে, ইচ্ছেমতো, দুজনে মিলে।
সবার জীবনে প্রেম আসুক, আনন্দময় হোক ধরা।
লেখক: লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই