দুষ্টু চক্রে আবর্তিত অর্থনীতি
১৫ জুন ২০২৪ ১৫:৫২
আমাদের ট্যাক্সের টাকার ২৩ শতাংশ, প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকা, কেন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন পরিশোধে ব্যয় হবে? সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে এই ব্যয় নির্বাহ করতে পারে না? এই প্রশ্ন অমূলক নয় যখন আপনি জানবেন বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের উপর ২৭.৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে, অথচ সরকারি চাকরিজীবীদের উপর এটা প্রযোজ্য নয়। তাহলে কি এটা দ্বিচারিতা নয়?
সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের মত হওয়া উচিত। এসিআরের পরিবর্তে তাদেরও কেপিআই থাকা উচিত যাতে তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকারদের মতো নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়াতে সহযোগী হতে পারেন।
বর্তমানে মন্দ ঋণ ১ লক্ষ ৮২ হাজার কোটি টাকায় (যদিও আসলে মন্দ ঋণ প্রায় ৫ লক্ষ কোটি টাকা যেখান থেকে ব্যাংকগুলো নিয়মিত মুনাফা পাচ্ছে না) পৌঁছেছে যা গত কয়েক মাস আগেও ছিল ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার মত। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতিও ক্রমান্বয়ে প্রতিমাসে বাড়ছে। তারা মনে হয় যমজ ভাই-বোন! আরো একজন যমজ ভাই বা বোন হচ্ছে বাজেট ঘাটতি। প্রতিবছর আমাদের দেশে বাজেট ঘাটতি থাকবে এটি এখন একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে প্রায় ৫৩% অর্থ সরকারকে নিতে হয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। ১.৫ লক্ষ কোটি টাকার মত টাকা যদি সরকার প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিতে থাকে তাহলে বেসরকারি পর্যায়ে ঋণ প্রদান ব্যাংকগুলো কিভাবে করবে? গত জুলাই-ডিসেম্বর এই ৬ মাসে ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদান করেছে মাত্র ৪৪ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, যেটা গত বছর একই সময় ছিল ৯০ হাজার কোটি টাকা। তার অর্থ কি এই নয়, বেসরকারি পর্যায়ে ঋণ প্রদান যথেষ্ট কমে যাচ্ছে। আর যদি তাই হয় তাহলে উন্নয়ন ধারা ব্যাহত হবে? ঋণ প্রদান কমে যাওয়ার সাথে যদি মন্দ ঋণ বাড়তে থাকে তবে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মন্দ ঋণের হার ভয়াবহ হারে বাড়বে।
এস্টোনিয়াতে ধনী-গরিব সবার ট্যাক্স হার সমান। শুধু তাই নয় এস্টোনিয়াতে সরকারি চাকরি বেসরকারি চাকরির চাইতে সম্মানজনক ও লাভজনক। তাদের দেশে পরিবহন খরচ বেশকম এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফ্রি। আর আমরা চড়ি লক্কর-ঝক্কর মার্কা পরিবহনে। বন্ড মার্কেট ব্যবহার করে আমরাও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে পারি এমন কি চাইলে শহর সম্প্রসারণে অর্থ যোগাড় করতে পারি।
ভিয়েতনামের উদাহরণও আমরা জানি, যারা গত বছর ভ্যাটের হার কমিয়েছে! ৯০ দশকে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক সূচক গুলো প্রায় একই রকম ছিল। সেই ভিয়েতনামের সংগ্রহ রয়েছে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ এফডিআই। আর আমরা এফডিআই অর্জন করেছি মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের মত। তাই শুধু ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ালেই রাজস্ব আয় বাড়বে না যতক্ষণ না আপনি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বাজেট ঘাটতি থাকতে পারে কারণ তারা চাইলে টাকা ছাপাতে পারে, আবার অন্যদিকে তাদের রয়েছে বন্ড মার্কেট। টাকা ছাপিয়ে আমরা মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়েছি কিন্তু বন্ড মার্কেট রয়ে গেছে শিশু পর্যায়ে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাটাসট্রফিক বন্ড থেকে মুনাফার হার ১৮-২০% কারণ সেখানে চার-পাঁচ বছর পরপর ঝড়-বন্যা থেকে বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি হয়, আর এই ক্ষয়-ক্ষতি সামলাতে ক্যাটাসট্রফিক বন্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় করা হয়।
এই জুন মাসে তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি থাকলেও অনুভূতি হয়েছে ৪৬ ডিগ্রি! এত বড় ব্যবধান কত কয়েক বছর আগেও দেখা যায়নি। জলবায়ু সংক্রান্ত বিপদ যে কত বড় বিপর্যয় আনতে পারে তা তো আমরা এখনই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, কিন্তু বাজেটে কি সেরকম কোন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা আছে যা আমাদেরকে ভবিষ্যতে বর্তমানের চাইতেও ভয়াবহ অবস্থা থেকে সুরক্ষা দিবে?
জলবায়ুর কথা বাদ দেই। ফিরে আসি ট্যাক্সের অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে তা নিয়ে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বর্তমানে যে অর্থ ব্যয় হয়, তা কি ট্যাক্সের টাকায় বাড়ানো যেত না? ২০১৬ সালে যেখানে বাজেটের ১৪% অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হত, তা আগামী বছরের জন্য কমে এসেছে ১১.৮৮% এ। যদিও আমরা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ জিপিএ-ফাইভ উৎপাদন করছি, তবে তার মান কি রকম তা তো আমরা সবাই জানি! বাজেট কমানোর সুফল তাই আমরা পাচ্ছি। জিবুতি, সেনেগাল এবং সামোয়ার মত দেশগুলোর পার ক্যাপিটা জিডিপি অনুযায়ী শিক্ষা খাতের বরাদ্দ আমাদের দেশের চেয়ে বেশি।
কোভিডের সময় লিখেছিলাম বরুণ্ডিতে রেডিও ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে দেবার কারণে তাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ করতে হয়নি, অথচ আমাদের দেশে এপ্রিল মাসেই স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে গরমের কারণে আর কোভিডে কি হয়েছিল সেটা তো জানাই আছে। শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানোর দরকার কি? অশিক্ষিত মূর্খদেরকে গত তিন বছর মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে একটি চক্র প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মত মুনাফা লুটেছে যার ফলশ্রুতিতে এখন মালয়েশিয়াতে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রয়েছে!
শিক্ষা খাতে যেখানে আগামী বছর জিডিপির ১.৬৯% ব্যয় করা হবে, সেখানে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হবে ০.৭৪%। এই দুটি খাতে সর্বমোট ব্যয় হয় ৯৫ হাজার কোটি টাকার মত। আগামী বছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের ব্যয় ৫.২% এ নেমে আসবে যেটা আগের বছর ছিল ৫.৩৩%। জিডিপির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ে আমাদের দেশের অবস্থান ২০২১ সালে এলডিসি দেশগুলোর তালিকায় থাকা ৪৫টি দেশের ভেতরে সর্বনিম্ন অবস্থায় ছিল!
আমরা প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করি, অথচ অল্প কিছু টাকা এই খাতে বাড়ালে ভারতে প্রতিবছর আমাদের চিকিৎসার জন্য খরচ হওয়া ৫ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো যেত। ভারতের কলকাতাই অধুনা ঘোষণা করেছে তারা বাংলাদেশীদের চিকিৎসা দেবার জন্য প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে প্রায় ২৫ লক্ষ লোক ভারতে যান চিকিৎসা করাতে আর এ কারণেই তাদের দেশে আমাদের ভ্রমণ প্রায় ৮৪% বেড়েছে গত কয়েক বছরে।
অর্থনীতিতে ক্রমশ অস্থিতিশীলতা তৈরি হবার কারণ হচ্ছে অব্যাহত মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভের পতন, রাজস্ব সংগ্রহে স্বল্পতা, পুঁজি পাচার, ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা, নিম্নমুখী রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ, বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান দায় বৃদ্ধি, সরকারি ব্যয়ের অনিয়ম অপচয়, দুর্নীতি ও জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা।
বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জের বাড়তি বোঝা, বাজেট ঘাটতির বড় অংশ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণগ্রহণ, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের সংকোচন, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও শেয়ারবাজার, মেগা প্রকল্পের হিড়িক, বিদেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ঠিকাদার নিয়োগ, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকা, জনগণের ডিজিটাল তথ্য চুরি, রমরমা হুন্ডি ব্যবসা, অপ্রদর্শিত বা কালো টাকায় ন্যূনতম ট্যাক্স, মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও আয়কর সীমা না কমিয়ে ভ্যাট থেকে সর্বোচ্চ কর আদায়ে অনড় থাকা, সম্পদের অসম বণ্টন ইত্যাদি
সব মিলিয়ে আমরা একটি দুষ্টু চক্রের অর্থনীতিতে আবর্তিত হচ্ছি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন না এলে সহসাই আমাদের উত্তরণের পথ খুবই সীমিত।
লেখক: ব্যাংকার