Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমার বাবা, আমার গর্ব

ইমরান ইমন
১৬ জুন ২০২৪ ১৩:৫৩

বাবা দিবস আজ। কত কিছু নিয়েই তো লিখি, বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে কিছু না লিখতে পারলে নিজেকে অপরাধী মনে করবো। অন্য সবার বাবার মতো বাবা আমার বাবাও আমার নির্ভরতার আকাশ, বটবৃক্ষের ছায়া, নিরাপত্তার উষ্ণচাদর। পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ থাকতে পারে, কিন্তু কোনো খারাপ বাবা নেই।

আমার বাবা একজন আপাদমস্তক দায়িত্বশীল বাবা। ছোটবেলা থেকেই তা দেখে আসছি। পরিবারের প্রথম ও বড়ো সন্তান হিসেবে আমি পেয়েছি সর্বোচ্চ আদর, ভালোবাসা ও মমতা।
আমার মা বলেন, তোর পেছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, তুই যে পরিমাণ আদর পেয়েছিস, তোর ছোট দুই ভাইবোন তার অর্ধেকও পায়নি।

বিজ্ঞাপন

মা বলেন, তোর নেশা ছিল খেলনা গাড়ি কেনা আর ভাঙা, বিশেষ করে বড়ো বাস। এই কিনে এই ভাঙতি, আবার কিনে দিতে হতো। এতে তোর বাবা একটুও বিরক্তবোধ করতো না। আর একটা জিনিস তোর প্রতিদিন না হলে দুনিয়া উল্টে যেত, তা হলো আঙুর ফল। প্রতিদিন তোর দুই কেজি আঙুর লাগতো। আমি আঙুরকে নাকি ‘হাম’ বলতাম।

পারিবারিক দায়িত্বের কষাঘাতে আমার বাবা বেশিদূর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু তার মধ্যে যে জীবনবোধ আর মনুষ্যত্ববোধ, তা একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষের কাছেও লক্ষ্য করা যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার মাত্রা বেশি না হলেও তিনি একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। তার প্রগাঢ় জীবনবোধ আমাকে প্রতিনিয়ত প্রাণিত করে ও প্রেরণা জোগায়। নিজে বেশিদূর পড়াশোনা না করতে পারলেও সন্তানদের পড়াশোনার জন্য মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।

আমার শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই অত্র অঞ্চলের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাকে পড়িয়েছেন। বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটি আমাদের জন্য কিনেছেন, এখনও বাজারের সবচেয়ে বড়ো মাছটি আমাদের ঘরেই আসে।কোথাও কোনো কমতি রাখেননি। আমিও ছোটবেলা থেকে বড়বেলা পর্যন্ত বাবার সে প্রতিদান দিয়ে আসার চেষ্টা করছি। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন থেকেই গায়ে ‘ভালো ছাত্রের’ তকমা ছিল। সবসময়ই ছিলাম ক্লাসের ফার্স্ট বয়। সে সুবাদে ক্লাস ফাইভ থেকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বৃত্তি পেয়ে এসেছি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রয়াত চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামের পিতা মাস্টার নুরুল হকের নামে একটা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং সেটিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই। বৃত্তির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে বাবাও যান। সেদিন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ লোক ও হাজার হাজার মানুষের সামনে সংবর্ধনা নিতে ছেলের সঙ্গে বাবাও মঞ্চে ওঠেন। সেদিনই প্রথম আমার বাবার চোখে আনন্দের অশ্রু দেখেছি। সেদিন আমার বাবাকে বিশ্বজয় করার খুশিতে মেতে ওঠতে দেখেছি।

বিজ্ঞাপন

এরপর প্রতিনিয়ত আমার বিভিন্ন সাফল্যে বাবা বেশ আনন্দিত। তাকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানুষ যখন বলেন, আপনার ছেলেকে এই জায়গায় দেখেছি, এই এই অর্জন। বাবা তখন নিজেকে সফল পিতা, গর্বিত বাবা মনে করেন। আমার লেখালেখি নিয়ে মানুষজন যখন প্রশংসা করেন এবং বলেন, ‘আপনার ছেলে দারুণ ও দুঃসাহসিক লেখক, আমাদের এলাকার গর্ব।’ তিনি তাতে বেশ সুখ অনুভব করেন এবং বাড়িতে মা’কে এসে বলেন সে কথা। কিছুদিন আগে আমাকে হেসে হেসে বললেন, ‘আমি ইমরান ইমনের বাবা বলে এখন অনেকে চেয়ার ছেড়ে দেয়, বিশেষ গুরুত্ব দেয়।’ তখন আমি নিজেকে সফল সন্তান মনে করলাম। মনে হলো, একটু হলেও বাবার ঋণ শোধ করতে সক্ষম হয়েছি। জীবিত থাকাকালীন বাবাকে সন্তুষ্ট ও সম্মানিত করতে পেরেছি।

মানুষ হিসেবে আমার বাবা একজন সৎ মানুষ, ভালো মানুষ, অমায়িক মানুষ। এতটা সরল ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। সেটা এ অঞ্চলের মানুষজনই বলে থাকেন। আমার সঙ্গে দেখা হলে অনেকে বলেন, ‘তোমার বাবা ভীষণ ভালো মানুষ। এমন ভালো মানুষ এখন আর নেই।’

মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা, উদারতা অগাধ। পরোপকার যার ধর্ম। যার যেকোনো বিপদে যিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আর মানুষকে আপ্যায়নের ব্যাপারে তিনি সেরাদের সেরা হবেন। মানুষের জন্য তার এত খরচ করা নিয়ে পরিবারে মায়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে ঝামেলাও হয়। কিন্তু পরোপকার যার ধর্ম তাকে কি আটকিয়ে রাখা যায়? এ কারণে ব্যবসায়িক ঈর্ষান্বিত আসনে থেকেও তিনি তেমন অর্থকড়ি বানাতে পারেননি। এ নিয়ে তার কোনো আফসোস নেই। তিনি বলেন, তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে তার বড় সম্পদ। এবং তার বড়ছেলে তার বড় সঞ্চয়।

বড়ছেলে হিসেবে পড়াশোনার বাইরে তিনি আমাকে অন্য কোনো প্রকার জটিলতা যেমন জায়গাজমিন, ব্যবসা, পারিবারিক ঝুটঝামেলা—এসবে কোনদিন জড়াননি। আমি যুক্ত হতে চাইলে তিনি বলতেন, ‘তোর এসবে জড়াতে হবে না, তোর কাজ পড়াশোনা করা, জ্ঞানার্জন করা, মানুষ হওয়া। এসব মেটানোর জন্য তো আমি এখনও বেঁচে আছি।’ বাড়িতে যখন থাকি তখন কোনো দিন কোনো বেলা আমাকে না ডেকে তিনি খেতে বসেননি।

সন্তান হিসেবে আমি আমার বাবাকে নিয়ে গর্ব করি। যার কাছে আমার কোনদিনও কিছু চাইতে হয়নি, চাওয়ার আগেই যিনি দিয়ে যান, যিনি বুঝে ফেলেন আমার চাওয়া-পাওয়া কী। কেননা ছোটবেলা থেকেই তার ছেলে এমন কোনো নেতিবাচক কাজ করেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ, এলাকা—সব জায়গায় তার ছেলের গায়ে ‘ভালো ছেলের’ তকমা ছিল।

গত চার বছরে বাবা থেকে এক পয়সাও আমি নিইনি, তিনি প্রতিনিয়ত দেওয়ার জোরাজুরি করলেও। যদিও কোনো কালেই নিইনি, তিনি দিয়ে গেছেন। এই টাকাপয়সা না নেওয়া নিয়েও তার মন খারাপ হয় মাঝেমাঝে, মা’কে তা বলে থাকেন। কারণ, আমি আমার আয় দিয়ে নিজে সুন্দরভাবে চলতে পারি। এই বয়সে বাবার কাছ থেকে অর্থ নেওয়া কোনভাবেই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যাপার ছিল না। আমি আত্মনির্ভরশীল হবো এবং থাকবো—এই ছিল আমার নিজের প্রতি নিজের কমিটমেন্ট। এবার রমজানের ঈদে ঈদসালামি দিলেন—আমি বললাম, আমি তো এখন বড়ো হয়ে গেছি, আমাকে কেন? বাবা বললেন, তোর কাছে তুই বড় মনে হলেও আমার কাছে তো তুই এখনও সেই ছোট্ট আব্বুনিটা। বাবা আমাকে আদর করে ডাকেন ‘আব্বুনি’ আর মা ডাকেন ‘ইমনি’।

বাবার কাছে আমি এখনও সেই ছোট্ট শিশুটি। কয়েকদিন আগে ফেনী থেকে রাত সাড়ে এগারোটায় মুন্সিরহাট এসে পৌঁছলাম। তুমুল বৃষ্টি ঝড়-তুফান শুরু হলো। আমাকে কল করে জিজ্ঞেস করলেন, আব্বু কোথায় আছো? আমি বললাম, মাত্র গাড়ি থেকে নামলাম, বৃষ্টি শুরু হলো। তিনি তুমুল বৃষ্টি ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে বগলে আরেকটা ছাতা নিয়ে কাকভেজা হয়ে হাজির হলেন আমার সামনে। আমাকে পরম মমতায় উষ্ণতার চাদরে ঘরে নিয়ে আসবেন বলে। বাবার সেদিনের ঘটনায় অনেক শক্ত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরেছে। আমি গুমরে মরলাম এই ভেবে যে, বাবা ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো? যখন তিনি থাকবেন না, তখন কী হবে আমার…

আমার বাবা নিজেই বড় বিশেষণ, তার তুলনা একান্ত তিনি নিজেই। বাবার অসীম ঋণ আমার কোনদিনও শোধ করা সম্ভব হবে না। তবে নিজেকে আমি সৌভাগ্যবান মনে করি এই দিক থেকে, জীবিত অবস্থায় বাবা আমার সাফল্য কিছুটা হলেও দেখতে পেয়েছেন এবং নিজেকে গর্বিত মনে করছেন। আমার বাবার জন্য আমি দোয়া চাই, যাতে তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করেন।

বাবা দিবসে পৃথিবীর সব বাবার প্রতি অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

আমার বাবা- আমার গর্ব ইমরান ইমন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর