বাবা দিবস ও প্রাসঙ্গিক কথা
১৬ জুন ২০২৪ ১৪:০১
যিনি সৃষ্টি করেন তিনি-ই মহান। পৃথিবীতে মানুষের বংশবৃদ্ধি এবং পৃথিবী ধংশের পূর্ব পযর্ন্ত মানবের অস্তিত্ব ঠিকে রাখতে এই মহান কাজে বাবা-মায়ের ভূমিকা বর্ণনা করে শেষ করার মতো নয়। এই মহান কাজ সাধন করতে মানব স্রষ্টাদের(পিতা-মাতা) কতো যে ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করতে হয় তা মনুষ্যত্ব চোখ না থাকলে অনুধাবন করা অসম্ভব্য প্রায়।
বাবার ছায়া শেষ বিকেলের বট গাছের ছায়ার চেয়েও বড়। সে তার সন্তানকে জীবনের সব উত্তাপ থেকে সামলে রাখেন। প্রচন্ড সূর্যের তাপে কিংবা মেঘের ভয়ানক গর্জনে ফসলের জমিনে, গার্মেন্টসে কিংবা অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রির মধ্য দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যিনি আমাদের মুখে খাবার তুলে দেন, মনুষ্যত্ববোধী মানুষ হওয়ার জন্য বর্ণমালার বই হাতে দিয়ে স্কুলে পাঠান, অসুখ হলে সারারাত না ঘুমিয়ে মায়ের সাথে পাশে বসে থাকেন আর কখন অসুখ সারবে এই প্রশ্নে ফার্মেসিতে থাকা ঔষুধ বিক্রিতা থেকে শুরু করে ডাক্তার পর্যন্ত সকলকে অস্থির করে তুলেন তিনি বাবা। যিনি ঘুম থেকে ওঠে হয়তো বা সন্তানের মুখ দেখতে না পেয়ে অফিসে চলে যান; সারাদিন কর্মব্যস্ততার মাঝে সময় পার করে রাতে যখন বাড়িতে ফিরে দেখেন সন্তান ঘুমিয়ে পড়েছে তখন মাথায় হাত রেখে স্পর্শ করা ছাড়া যার আর কিছুই করার থাকে না তিনি বাবা। আসলে বাবা-মায়ের নিদিষ্ট করে কোনো সংজ্ঞা হয় না, দেওয়া যায় না।
প্রত্যেক বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে বাবা দিবস পালিত হয়। সেই হিসেবে এবছরের ইংরেজি ক্যালেন্ডারে বাবা দিবস ১৬ জুন। ১৯০৮ সালে প্রথম বাবা দিবসের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টে প্রথম ৫ জুলাই দিবসটি পালন করা হয়। এরপর ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন জুনের তৃতীয় রোববারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস হিসাবে নির্ধারণ করেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রতিবছর জাতীয়ভাবে বাবা দিবস পালনের রীতি চালু করেন। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে বাবা দিবস পালন হয়ে আসছে।
বাবা দিবসে কেমন আছেন পৃথিবীর সকল বাবা? হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সন্তান বড় করার মধ্য দিয়ে সারাজীবন সন্তানের সুখে-দুঃখে একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখেছেন যেই বাবা আজ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার জন্য আশ্রয় নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে সেই বাবা কি ভালো আছেন? নিজের সুখ শান্তির কথা চিন্তা করে বিদেশে আশ্রয় নেওয়া সন্তানের অবহেলিত-উপেক্ষিত বাবা-মায়েরা কি ভালো আছেন? সারাজীবন পরিশ্রম করে বড় করা সন্তানেরা পৃথক পরিবার গড়ার কারণে শেষ বয়সে অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করা কিংবা বেঁচে থাকার তাগিদে রিক্সা-ভ্যান-অটো চালানো বাবা কি ভালো আছেন? কাজে গিয়ে লাশ হয়ে ফেরা কিংবা পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া সন্তানের বাবা কি ভালো আছেন? মাদকাসক্ত হয়ে অপরাধ থেকে শুরু করে গুরুতর অপরাধ, খুন, ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধে জড়িত(যদিও এই দায়ভার শেষমেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘাড়ে-ই পর্তায়) থাকা সন্তানের বাবা কি সুখে আছেন? নতুন শিক্ষাক্রমে স্কুলে পাঠগ্রহণ করা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বাবা-মা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে, এই সমাজব্যবস্থায় এই শিক্ষাক্রম আদৌও উপযুক্ত কি না ইত্যাদি ভাবনায় হাবুডুবু খাওয়া শিক্ষার্থীদের বাবা-মা কি ভালো আছেন কিংবা চিন্তামুক্ত আছেন? জীবন মান উন্নয়নের জন্য যে সন্তানেরা নগর মুখী হয়ে কর্মক্ষেত্রে অনিরাপত্তার কারণে কিংবা অনিরাপদ সড়কের কারণে বাড়িতে লাশ হয়ে ফিরেছে বা ফিরছে তাদের বাবা-মা কি ভালো আছেন? স্কুলে, কলেজে কিংবা কর্মসংস্থানে যাওয়ার পথে কিংবা ফেরার পথে ধর্ষণে শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করা সন্তানদের বাবা-মা কেমন আছেন? গ্রাম থেকে শুরু করে শহর সব জায়গায় মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় তা কিনে সেবন করে মাদকাসক্ত হওয়া ছেলে-মেয়ে’দের পরিবার কেমন আছেন? নিঃসন্দেহে ভালো নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র বাবা-মায়েদের ভালো রাখতে কতটা সিরিয়াস সেটা প্রশ্নের ব্যাপার। ভাল নেই সন্তান থাকার পরেও নিঃসন্তান হয়ে বেঁচে থাকা বাবা-মা। অথচ বাবা-মায়ের জীবন জুড়ে শুধুই তাঁদের সন্তান।
মা চাকরি করার কারণে ছোট বেলা থেকে বাবার সঙ্গ পেয়েছি বেশি। মা সকালে বের হয়ে যেতেন সন্ধ্যার আগে বাড়িতে ফিরতেন। ছোট বেলায় স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম বাবা প্রচন্ড তাপে ফসলের জমিনে কাজ করছেন। জ্ঞানপিপাসু হওয়ায় বাবা অবসর সময়ে বিভিন্ন রকমের বই পড়তেন, আমাদেরকেও বিভিন্ন রকমের বই কিনে এনে দিতেন, বিশেষকরে বিজ্ঞানমনষ্কের বই। তখন বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে কূপমন্ডুকতা চিন্তাভাবনায় বড় না করে বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তায় বড় করার জন্য বিজ্ঞান বই হাতে তুলে দিতেন। ছোট বেলায় দেখতাম বাবা ‘ছোটদের রাজনীতি ও অর্থনীতি’ বই পড়তেন। ভাবতাম বাবা কি এখনও ছোট আছে না-কি যে ছোটদের বই পড়ছে। বয়স বৃদ্ধির সাথে প্রগতিশীল রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ফলে বুঝতে পারলাম বাবা কেন ঐ বই পড়েছে। বাবার চেষ্টা ছিলো বাড়িতে একটা ছোট্টপরিসরে লাইব্রেরি গড়ার। তিনি সফল হয়েছেন। কেননা একদিন বাবা বাঁশের তৈরি বই রাখার র্যাক কিনে এনে তার সারাজীবনের কেনা বই ঐ র্যাকে তুললেন। এভাবেই গড়ে তুললের ছোট্ট পরিসরের লাইব্রেরি। জ্ঞানের আলো ছড়াতে থাকলে।
বাবা সফল হয়েছেন তার সন্তানদের বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল চিন্তায় বড় করার ক্ষেত্রে। তাইতো আজ আমাদের পরিবারে বিজ্ঞান চিন্তা আর প্রগতিশীল ভাবনা জীবনের আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাবা-মা’কে ভালোবাসার জন্য, স্মরণ করার জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন হয় কি? বাবা-মা সন্তানকে ভালোবাসার জন্য আদতে কোনো দিবসের কথা চিন্তা করতে পারেন কি? পারেন না। কারণ সন্তানকে বাবা-মা সবসময়ই ভালোবাসেন, যত্ন করেন, মনে রাখেন। তবে সন্তানদের জন্য বাবা দিবস কিংবা মা দিবসের প্রয়োজন পড়ে কেন? প্রয়োজন আছে। যেই সন্তান তার বাবা মায়ের কথা না শুনে সত্যের পথ ছেড়ে অসৎপথ বেচে নিয়েছে, যেই সন্তান বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটানোর বিপরীতে সারাজীবন দুঃখে কষ্টে রেখে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে, যেই সন্তান বাবা মায়ের খেয়াল না রেখে অবহেলা করেছে, অপমানিত করেছে, লাঞ্ছিত করেছে, স্বার্থের কারণে সারাজীবনের শ্রমের অর্থ দিয়ে তৈরি করা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে কিংবা বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে বলে অতিরিক্ত চাপ মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে চায়; যেই সন্তান সম্পত্তির লোভে বাবার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মামলা করে সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছে, সেই সকল সন্তানদের ভুল শুধরে নিয়ে মনুষ্যত্ববোধী মানুষ হওয়ার জন্য বাবা দিবস প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজনীয় কাজটি করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অন্যথায় বাবা দিবস অপ্রাসঙ্গিক।
এক বেসরকারি জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমান প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। বর্তমানে প্রায় ৫০ লক্ষ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবনযাপন করছেন। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অবহেলার শিকার এখন অসহায় প্রবীণরাই কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবিলা করার মত প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আমাদের নেই। অসহায় প্রবীণদের কল্যাণের বিষয়ে এখনই আমাদের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে। আর এখন থেকেই নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে। দয়া দাক্ষিণ্য বা করুনার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া পাওয়া সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা, আর এই গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো সব শিক্ষা পাঠ্য সূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান প্রদর্শন করা হবে। প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে বাবা দিবস।
বাবা দিবসে দুনিয়ার সকল বাবাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ, শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই