Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিল্প-সংস্কৃতি এবং বিনোদন: বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ

মো. বজলুর রশিদ
২০ জুন ২০২৪ ১৬:৫৮

শিল্প-সংস্কৃতি এবং বিনোদন মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজের সমৃদ্ধি এবং মানুষের মানসিক উন্নতির জন্য শিল্প ও সংস্কৃতির ভূমিকা অপরিসীম। বিনোদন আমাদের জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোকে সহজ করে তোলে এবং আমাদের মনোবল বাড়ায়। বাংলাদেশে শিল্প-সংস্কৃতি এবং বিনোদনের বর্তমান পরিস্থিতি যেমন আকর্ষণীয় তেমনি চ্যালেঞ্জপূর্ণ।

বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধশালী হয়েছে। লোকশিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, সাহিত্য, থিয়েটার এবং চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ নিজস্ব সত্তা গড়ে তুলেছে। লোকসংগীত এবং বাউলগান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লালন শাহ, হাসন রাজা, আব্দুল আলিম প্রমুখ শিল্পীরা আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। এ ধারা এখনও বিদ্যমান, কিন্তু আধুনিককালের পরিবর্তন এবং গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবও এ ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশে বিনোদনের মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসার বিনোদনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ইউটিউব, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এবং টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে স্বাধীন শিল্পীরা তাদের কাজ প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন। এতে করে তাদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে এবং নতুন নতুন প্রতিভা উদ্ভাসিত হচ্ছে।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে একটি বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এক সময়ে সিনেমা হল ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম, কিন্তু এখন অনেক দর্শক হলে গিয়ে সিনেমা দেখা থেকে বিরত থাকছেন। এই প্রবণতার পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্মগুলোর উত্থান হলের দর্শকসংখ্যা হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ। নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, হইচই, এবং বিভিন্ন দেশীয় প্ল্যাটফর্মে দর্শকরা ঘরে বসেই চলচ্চিত্র ও সিরিজ দেখতে পাচ্ছেন। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট এবং আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র ও সিরিজ সহজলভ্য হওয়ায় দর্শকদের মধ্যে হলের প্রতি আকর্ষণ কমে গেছে।

সিনেমা হলের টিকিটের উচ্চ মূল্যও দর্শকদের হলে না যাওয়ার একটি বড় কারণ। পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার খরচ অনেক সময় বেশ ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সাবস্ক্রিপশন ফি তুলনামূলকভাবে কম এবং সারা মাসব্যাপী বিভিন্ন কনটেন্ট দেখার সুযোগ দেয়।

বাংলাদেশের অনেক সিনেমা হলেই এখনও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। আধুনিক আসন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তার অভাব অনেক দর্শককে হলে যেতে নিরুৎসাহিত করে। এসব সমস্যার কারণে দর্শকরা ঘরে বসে আরামদায়ক পরিবেশে সিনেমা দেখতে বেশি পছন্দ করেন।

সিনেমার কনটেন্টের মানও দর্শকদের হলে না যাওয়ার একটি বড় কারণ। অনেক দর্শকের মতে, দেশের সিনেমাগুলোর গল্প, পরিচালনা এবং অভিনয়ের মান উন্নত করা প্রয়োজন। বৈচিত্র্যময় এবং মানসম্মত কনটেন্টের অভাব হলে দর্শকদের আকর্ষণ কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বৈচিত্র্যময় এবং মানসম্মত কনটেন্ট সহজলভ্য হওয়ায় দর্শকরা সেই দিকে ঝুঁকছেন।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পাইরেসি একটি বড় সমস্যা। নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র খুব দ্রুতই বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ফাঁস হয়ে যায়। দর্শকরা হলে গিয়ে টিকিট কিনে সিনেমা দেখার পরিবর্তে ইন্টারনেট থেকে সহজেই সিনেমা ডাউনলোড বা স্ট্রিম করে দেখতে পারেন, যা হলে দর্শকসংখ্যা কমিয়ে দেয়।

আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় অনেকেরই হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সময় থাকে না। কর্মব্যস্ত জীবন, দীর্ঘ কর্মদিবস এবং যানজটের কারণে অনেকেই হলে গিয়ে সিনেমা দেখার পরিবর্তে বাড়িতে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

কোভিড-১৯ মহামারি হলের দর্শকসংখ্যা হ্রাসের একটি বড় কারণ। মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ধরে সিনেমা হলগুলো বন্ধ ছিল। যদিও এখন হলগুলো পুনরায় খোলা হয়েছে, তবু অনেক দর্শক এখনও হলে যেতে চাননা। মহামারির সময় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অনেক দর্শকের অভ্যাস পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে।

সামাজিক পরিবর্তনও হলে দর্শকসংখ্যা হ্রাসের একটি কারণ। আগে যেখানে হলগামী দর্শকের সংখ্যা বেশি ছিল, সেখানে এখন অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করেন। এছাড়া, আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে সাথে অনেকেরই বিনোদনের রুচি এবং চাহিদা পরিবর্তিত হয়েছে।

শহরাঞ্চলের অনেক সিনেমা হলেই পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা নেই। দর্শকদের হলে গিয়ে গাড়ি পার্কিং করার সমস্যা হতে পারে, যা অনেককে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আগ্রহ কমিয়ে দেয়।

এই সমস্ত সমস্যার সমাধানে সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উদ্যোগী হতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে, টিকিটের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে, এবং মানসম্মত ও বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট তৈরি করে দর্শকদের হলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া, পাইরেসি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সাথে প্রতিযোগিতামূলক কৌশল গ্রহণ করাও জরুরি।

সম্মিলিত উদ্যোগ এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে আবারও স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দর্শকদের হলে ফিরিয়ে আনতে হলে তাদের চাহিদা এবং রুচির প্রতি সম্মান জানিয়ে, সৃষ্টিশীল এবং মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করাই হবে মূলমন্ত্র।

থিয়েটার এবং নাট্যকলা বাংলাদেশের সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। নাট্যদলগুলো সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে, আর্থিক সমস্যা এবং পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেক নাট্যদল তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তবুও, কিছু দল ও সংগঠন তাদের সৃষ্টিশীলতাকে ধরে রেখে কাজ করে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

সাহিত্য সবসময়ই আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা সবসময়ই তাদের সৃষ্টিশীলতা এবং সমাজের প্রতিফলন করে গেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে, বিভিন্ন সাহিত্য উৎসব এবং বইমেলার মাধ্যমে সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে নতুন উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে। তবে, সাহিত্যিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং প্রকাশনা শিল্পের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা আমাদের অতিক্রম করতে হবে।

নৃত্যকলায় বাংলাদেশ সবসময়ই সমৃদ্ধ। বিভিন্ন প্রকারের নৃত্য যেমন ক্লাসিকাল, লোকনৃত্য, এবং আধুনিক নৃত্য আমাদের সংস্কৃতিতে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। নৃত্যশিল্পীরা দেশ-বিদেশে তাদের প্রতিভা প্রদর্শন করে আসছেন এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করছেন। তবে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেক প্রতিভাবান নৃত্যশিল্পী তাদের প্রতিভা বিকাশে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন।

ভবিষ্যতে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি এবং বিনোদন খাতকে আরও এগিয়ে নিতে হলে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, সরকারের পক্ষ থেকে শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নে যথাযথ নীতিমালা এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতা এবং সরকারি অনুদান শিল্পীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তাদের সৃষ্টিশীলতাকে আরও উৎসাহিত করে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থায় শিল্প ও সংস্কৃতির গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার উপর গুরুত্বারোপ করে পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। এটি নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করবে।

তৃতীয়ত, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে নতুন নতুন প্রতিভার খোঁজ এবং প্রচার করা সম্ভব। তবে, এর সাথে সাথে সাইবার নিরাপত্তা এবং কপিরাইট আইন মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চতুর্থত, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসব এবং প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করতে হবে। এতে করে বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করা এবং দেশের পর্যটন শিল্পকে উন্নত করা সম্ভব।

বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি এবং বিনোদন খাত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে আমরা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিত করতে পারি। ভবিষ্যতে এ খাতে আরও উন্নয়ন ও সৃষ্টিশীলতা দেখতে আমরা সকলেই আশাবাদী।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তমত মো. বজলুর রশিদ শিল্প-সংস্কৃতি এবং বিনোদন: বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর