আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা
২২ জুন ২০২৪ ১২:১২
স্বাধীনতা অর্জনে জাতীয় সংহতি ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অতিপ্রয়োজনীয়। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন করে রাজনৈতিক দলগুলো। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইসের উক্তিটি বেশ প্রণিধানযোগ্য। তার মতে— ‘সংগঠন প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রনীতি প্রণয়নকারী ব্রোকার (broker) বৈ কিছু নয়।’
লর্ড ব্রাইসের এই উক্তির মিল পাওয়া যায় উপমহাদেশের রাজনীতির দিকে তাকালে। ব্রিটিশদের মদতপুষ্ট হয়ে ১৮৮৫ সালে উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। পরে এই দলের নেতৃত্বেই আসে ভারতের স্বাধীনতা।
পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে ও তাদের স্বার্থ রক্ষায় গড়ে ওঠে মুসলিম লীগ। ১৯০৬ সালে এই দলটি প্রতিষ্ঠার পর উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি দেশের জন্ম হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেনে’। ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে একাত্তর সালে স্বশস্ত্র যুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বিশ্বমানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ’ নামের নতুন রাষ্ট্র।
২৩ জুন বাঙালির জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্ত গিয়েছিল, ১৯২ বছর পর একই দিনে বাংলার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় ঢাকায় জন্ম হয় নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের। মূলত নিপীড়িত-নিষ্পেষিত বাঙালির অধিকার আদায় এবং তাদের সচেতন করে তুলতেই দলটির জন্ম। ‘আওয়াম’ মানে জনগণ— এই জনগণের দলই তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, দেশ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছে, সর্বোপরি এই দেশের ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দলের ভূমিকা ঐতিহাসিক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে লাল-সবুজের এই দেশ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার পথে। তার নেতৃত্বে পৃথিবীর বুকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
দেশ ভাগের পর মওলানা আকরাম খাঁর অনুসৃত মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গের নেতাকর্মীরা। মূলত তারাই আওয়ামী লীগ তৈরির উদ্যোগ নেন। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম লীগকে একটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। প্রথমে ‘মুসলিম’ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকলেও ওই সময় কৌশলগত কারণেই ‘মুসলিম’ শব্দটি রাখা হয়। তবে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে।
প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ও টাঙ্গাইলের তরুণ সংসদ সদস্য শামসুল হক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। শেখ মুজিবকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
আওয়ামী লীগ গঠনের মুহূর্তেই দলটি ব্যাপক বিশ্বাসযোগ্যতা পায় জনগণের কাছে। দেশজুড়ে দলটির কর্মসূচি ব্যাপক আলোড়ন ফেলে। এ বিষয়ে এম আর আখতার মুকুল লিখেছেন, ‘নানা রকমের বাধা-বিপত্তি আর শত অত্যাচার সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব অত্যন্ত অল্প সমযের মধ্যেই পূর্ববাংলার প্রতিটি জেলায় বিরাট কর্মীবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তারা কর্মীদের বুঝালেন কিভাবে পূর্ববাংলায় অত্যন্ত দ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হতে চলেছে। … ভাসানী-মুজিব উল্কার মতো বাংলার পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ালেন। তৎকালীন বাংলাদেশে নূতন যুগের সূচনা হলো।’ (সূত্র: এম আর আখতার মুকুল, পাকিস্তানের চব্বিশ বছর: ভাসানী মুজিবের রাজনীতি, পৃ: ১৭)
সাত-চল্লিশে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির পর বঙ্গবন্ধু দেখলেন, শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষ তথা বাঙালিকে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে। মর্মে মর্মে এই উপলদ্ধি নিয়েই ছয় দফার মতো একটা কিছু দেওয়া যায় কি না— তা আগেই ভাবতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবের এই উপলব্দি বিশেষ করে তার রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য বাঙালি রাষ্ট্রসাধনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন ও বাঙালি রাষ্ট্রের। সাতচল্লিশের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শেখ মুজিবের মনে দাগ কাটে। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী মানুষ। তাই পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে সেভাবেই কর্মসূচি প্রণয়ন করেন তিনি।
‘নিরাপত্তা আইনে’ জেলে আটক থাকার পর ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৫৩ সালে দলের দ্বিতীয় কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ভাসানী-মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্রুত দেশের আনাচে–কানাচে জনমত গড়ে তোলে এবং ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ তখন শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে ‘যুক্তফ্রন্ট’ করেছিল। ফজলুল হকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ক্ষমতার সম্মিলনে এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ধরাশায়ী হয়।
১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেন। তখন আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা রাজনীতিতে জরুরি হয়ে পড়ে। এর মাঝে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে নতুন দল গড়েন মওলানা ভাসানী। তখন থেকেই আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
দলকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালের ৬ মার্চ ঢাকার গ্রিন রোডে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে এবং এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক এবং শিক্ষা-সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রধান সংগঠনে পরিণত হওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করে।
প্রকৃতপক্ষে ওই সম্মেলনই আওয়ামী লীগকে সংগঠন হিসেবে এবং নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারের নিপীড়ন থেমে নেই। দমন-পীড়ন নীতি বাড়তেই থাকে। সরকারি নিপীড়ন সত্ত্বেও শেখ মুজিবসহ নেতারা পুরো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরেছেন, জনমত গড়ে তুলেছেন। এভাবে আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছে। পরবর্তী সময়ে বাঙালিকে অধিকার সচেতন করে মুক্তির জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করেন শেখ মুজিবুর রহমান।
আসছে ২৩ জুন, আওয়ামী লীগ ৭৫ বছরে পা দেবে। বলা হয়ে থাকে, বয়স শুধুই একটি সংখ্যা— সেটা হোক ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের জন্য। এই সংখ্যাটি তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন ওই ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান ভাল কিছু করে থাকে, মানুষের কল্যাণে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগ জনগণের দল, জনগণ নিয়েই থেকেছে। বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন তা এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। তাই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত এই দিন, এই সংখ্যাগুলোও তাৎপর্যপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে মানুষের দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। এমনকি দলের সাংগঠনিক কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে— এমন আশঙ্কা থেকে মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত ছেড়ে দেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও সেভাবেই দলকে সাজিয়ে তুলেছেন, দলের অভ্যন্তরে নিশ্চিত করেছেন গণতন্ত্রের চর্চা।
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যও বিরাট ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানি সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশি সামরিক শাসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে যে প্রত্যাবর্তন, তার কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর কঠিন সময় পার করা আওয়ামী লীগকে শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি।
উপমহাদেশে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে এখানে রাজনীতি নেতানির্ভর। কংগ্রেসে যেমন মহাত্মা গান্ধী, মুসলিম লীগে তেমনই জিন্নাহ। আর পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগে প্রথমে ছিলেন ভাসানী, পরে অপরিহার্য ছিলেন শেখ মুজিব, বর্তমানে শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধুর পরে আওয়ামী লীগকে সুসংবদ্ধ রাখা শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। পিতার মতো সম্মোহনী শক্তির নেতৃত্বগুণসম্পন্ন দূরদর্শী নেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মতো দেশ শাসন করছে আওয়ামী লীগ। এই দলের সময়ই শেখ হাসিনার ‘ভিশনারি’ চিন্তায় ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। গড় আয় বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর। অথচ চল্লিশের দশকে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল চল্লিশের নিচে।
বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে। বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হয়েছে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেলসহ বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প। বদলে গেছে দেশের অর্থনীতি। গড়ে উঠছে নতুন নতুন অর্থনীতির ক্ষেত্র। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য যোগ্য জনশক্তি গড়ে তুলতে বাস্তবায়ন হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ।
টানা চার বারসহ মোট পাঁচবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই সময়ে গড়ে উঠেছে নানা সুবিধাবাদী চক্র। দলে কলঙ্কলেপন যেন না হয় সেজন্য কঠোর হাতে সিদ্ধান্ত নেন দলীয় সভাপতি। এ ক্ষেত্রে দলের অন্যান্য নেতাকেও শাখা-প্রশাখা হয়ে ক্ষমতার বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করা সুদিনের বন্ধুরা যেন আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
এ দেশে সময়ে সময়ে অনেক রাজনৈতিক দল এসেছে, আবার কালের গহ্বরে হারিয়েও গেছে। তবে টিকে রয়েছে জনগণের দল আওয়ামী লীগ। শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ ছিল জনগণের দল, সাধারণ মানুষের দল। জনগণের দল হয়ে, আওয়ামী লীগ টিকে থাকবে, বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে। ৫আওয়ামী লীগের বয়স ৭৫ পূর্ণ হচ্ছে। আওয়ামী লীগ বেঁচে থাকুক জনগণের অন্তরে— আওয়ামী লীগের জন্মদিনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মাণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। দলটির জন্মদিনে নিরন্তর শুভকামনা।
লেখক: শিক্ষাবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ মুক্তমত