অসুস্থ মস্তিষ্ক নিয়ে ভুগছে এই প্রজন্ম
২২ জুন ২০২৪ ১৪:৪৬
আমরা উন্নত বিশ্ব থেকে কত পিছিয়ে আছি তা অনলাইন জগত দেখলে বুঝা যায়। আমরা পড়ে থাকি ট্রল নিয়ে। আমরা ইতিবাচক সুন্দর সুললিত খবর গুলো ভাইরাল করি না। আমরা ভাইরাল করি পচা, বিশ্রী ও আনাড়ি নিউজ গুলো। আমরা অনলাইন জগতকে কত আপন করে নিয়েছি। সোজা রক্তে মিশিয়েছি। সেই জগত একদিন রক্ত চুষে নিবে। আমরা পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পরি না। আমার দেশের বিশ্ববিদ্যালয় হাজারের তলানিতে পড়ে থাকে। আমরা একটা অসুস্থ গুনে ধরা পোকার প্রজন্ম তৈরি হচ্ছি। এই ভাইরাল নেশায় মিশে থাকা প্রজন্মের কখন চোখ খুলবে জানি না। কখন আমরা আমাদের দেশকে সভ্য দেশে পরিণত করব! কখন বিশ্বমঞ্চে নেতৃত্ব দিব!
সাম্প্রতিক “রাসেল’স ভাইপার” নামক সাপ দেশের অধিকাংশ এলাকায় মাথাচাড়া দিয়েছে। বহু জায়গায় দেখা মিলছে। শত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বিষাক্ত সাপ আবারো দেখা মিলছে। আমরা তা নিয়েও মজা করছি। ফেইসবুক সহ বিভিন্ন অনলাইন সেক্টরে আমরা গুজব হৈ-হুল্লোড় করেছি। আমরা বিষাক্ত সাপ নিয়ে ব্যঙ্গ করছি। আমরা ইতিবাচক ও নেতিবাচক খবর বুঝি না। আগে হাইপ তুলতে হবে। আগে জনগণকে বেকায়দায় ফেলতে হবে। আমরা পজিটিভ বলি না। আমরা সুপরামর্শ কিংবা সাবধানতার কথার বুলি উড়ায় না। বারংবার আউল-ফাউল বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চাঙ্গা করে রাখি। অথচ আমরা চাইলে সুন্দর পরামর্শ ও ইতিবাচক কিছু তুলে ধরতে পারতাম। আমরা নিজেরা সেই সাপের চেয়ে বিষাক্ত এক জাতি। হ্যাঁ! আমরা আরো বেশি বিষাক্ত!
এইতো! কিছুদিন আগে যখন “রেমাল” ঘূর্ণিঝড় হলো আমরা তা নিয়েও মাস্তি করছি। মিডিয়া ও আবহাওয়া অধিদপ্তর যখন গলা ফাটিয়ে সতর্ক করছে ঠিক তখনই আমরা সমুদ্র সৈকতে ঘূর্ণিঝড় দেখতে গেছি। কতবড় বোকা জাতি ভাবুন! যেখানে মৃত্যুর ভয় সেখানে আমরা মজা করছি। সাংবাদিক ভাইরা যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সাহায্য করছে প্রচন্ড বৃষ্টি ও ঝড়ে। তখন কিছু মগজ-বিকলাঙ্গ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিউমার চড়াচ্ছে। একটি ক্লিপে দেখলাম সাংবাদিক ভাইয়ের ছাতা উড়ে গেছে। আমরা সেটা নিয়েও মজা করছি। হাসছি, ফানি মিম বানিয়েছি, হা হা রিয়েক্টের আশায় ফালতু গান এডিট করে বসিয়েছি। একবার সেই ভাইয়ের জায়গায় নিজেকে মনে মনেও উপস্থাপন করিনি।
রাস্তায় “বৃষ্টির” পানি টইটম্বুর হওয়ার পরে রিকশা উল্টে গেল। যাত্রী পড়ে গিয়ে মা মা বলে চিল্লাচ্ছে। আমরা সেটা নিয়ে মিম বানিয়েছি। রিকশাওয়ালার রিকশা উল্টে পানিতে ভেসে যাচ্ছে। আমরা “এএই কী হুয়া” হিন্দি গান দিয়ে মিম’স বানিয়েছি। ঘরবাড়ি ডুবে মানুষ আহাজারি করছে। গরু ছাগল ও বিভিন্ন পালক প্রাণী মারা গেছে। আমরা সেই মানুষের কান্নারত ভিডিও ক্লিপ নিয়ে মিম বানায়। হু হা হা করে হাসি। আমাদের মস্তিষ্ক কেমন জানি হয়ে গেছে। আমাদের সুস্থ মস্তিষ্ক গোবর বানালাম নাতো? কেনো আমরা এক সাথে এগিয়ে যেতে পারি না? কেনো হাতে হাত রেখে বিপদ মোকাবেলা করি না? কেনো নষ্ট, বেয়াদব, বোকা, বিকলাঙ্গ ও জরাজীর্ণ প্রজন্ম হয়ে বেড়ে উঠছি? আমাদের ভুল কোথায়? কখন ঘুম ভাঙবে আমাদের?
চলমান “মায়ানমার ও সেন্টমার্টিন” নিয়ে যখন ঝামেলা শুরু হলো আমরা ফের ঠাট্টা-তামাসায় ব্যস্ত। সেই সূত্র ধরে মুক্তিযুদ্ধের কোটা টেনে আনছি। সবুজ অনলাইন জগত রমরমা করে ফেলছি। আসন্ন বিপদ নিয়েও রঙ্গ করছি৷ ব্যঙ্গ করছি ত্যাগী মানব মুক্তিযুদ্ধাদের। আমাদের সাগর সম্পর্কে কী আইডিয়া আছে? আমাদের চারদিকের সীমানা নিয়ে কী আমরা খবর রাখি? আমার দেশের অহংকার পাহাড় নিয়ে ভাবনা করি? কুকি-চিন সম্পর্কে জানি? সেখানে কী হচ্ছে বুঝতে চেয়েছি? আমরা কেনো পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার নিয়ে ভাবি না? কেনো পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানি গুলো নিয়ে ভাবি না? পাশের দেশ “ভারতের” অন্তত বিশ জন মতো বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। অথচ আমরা পড়ে আছি অশ্লীলতা নিয়ে। ট্রল, ফানি, মিম, কৌতুক ও চ্যাংড়ামি নিয়ে। আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ সাদাকালো। একেবারে কুচকুচে অন্ধকার! আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।
আমরা ১৯-২২ পর্যন্ত “করোনা” মহামারি নিয়েও মজা করছিলাম। আমরা কেনো ভীত নয়? আমরা ছয়-সাত বছরের ছোট-ছোট কোমলপ্রাণ শিশুদের হাতে মোবাইল দেই। পরে এমন দূর্ঘটনা ঘটায় যার জন্য পুরো পরিবারকে কাঁদতে হয়। ব্রেকিং নিউজ হয়। মিডিয়া সয়লাভ হয়। আমরা ভালো কিছু শিখাতে পারি চাইলে। “চতুর্থ শিল্পবিপ্লব” সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন বর্তমান প্রজন্ম থেকে। কিছুই পারবে না। কিন্তু ভাইরাল গান ও মুভি নিয়ে জিজ্ঞেস করুন। চার ঘন্টা বক্তব্য দিবে। “জাতীয় সম্পদ” সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন কিছুই জানে না অথচ “সরকারি ও মানব সম্পদ” ঠিকই ধ্বংস করছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা আর কত? ভাইরাল, ট্রল, মিম, ফানি ও রঙ্গ-তামাসা এসব থেকে বের হয়ে নতুন দেশ সম্পর্কে ভাবতে হবে। না হয় ভয়াবহ অবস্থা হবে আমাদের। কালো সূর্য উঁকি দিচ্ছে চারদিকে।
আমরা শিক্ষা নিয়েও মজা করি। পরীক্ষাকে শুধু পাশের জায়গা হিসেবে ধরে নিয়েছি। স্যারদের নিয়ে ফানি ভিডিও বানায়। আমরা ধর্মীয় বাণী নিয়ে মজা করি। নিচে লিখে দেই শুধু মাত্র বিনোদনের জন্য! আমরা মৃত মানুষ নিয়ে তামাশা করি। হত্যাকারীর ভিডিও ক্লিপ নিয়ে হইহট্টগোল করি ফেইসবুকে। বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তি নিয়ে রঙ্গ করি। তাদের কথা ও বক্তব্য নিয়ে ইউটিউব গরম করি। ভুলে কোনো একটা কিছু ভাইরাল হলে তা নিয়ে মাস খানেক পড়ে থাকি। আর একটা কখন ভাইরাল হবে তা নিয়ে চিন্তিত থাকি। আমরা নষ্ট বিষয় নিয়ে পড়ে রয়েছি। অথচ, পৃথিবীতে আরো বহু দেশ আছে। তারা নয়া নব্য কিছু বানাচ্ছে। উন্নত হচ্ছে। দেশকে উদ্যমী করে গড়ে তুলছে। আর আমরা মিম বানায়। স্যাড সঙ যুক্ত করি। অনন্য জাতিরা আজ কত কিছু আবিস্কার করছে। আমরা বাঙালি জাতিরা রংতামাশা নিয়ে বেঁচে আছি।
আমরা ক্রিকেট ফুটবল নিয়ে পড়ে আছি। বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ি অনলাইনে। একজন আরেকজনের মা ও বোনকে অসভ্য ভাষায় গালিগালাজ করি। আহা! আমরা আর কত নিচু নামবো? আমরা কখন সভ্য হবো? আমাদের নতুন সূর্য কখন উদয় হবে? আমরা এসব হাবিজাবি বিষয় থেকে কখন বের হতে পারব? কেনো আমরা আমাদের দেশকে সুন্দর রাখতে পারি না। পরিস্থিতি বুঝে সাহায্য করতে পারিনা? শহর-নগর কেনো পরিস্কার রাখি না? কেনো বিশ্ববিদ্যালয় গুলো এই গ্রহের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা পায় না? কেনো আমাদের আবিষ্কারের নেশা নাই? আমার দেশের ছেলেরা বিশ্বমানের ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে না কেনো? গৌরবময়ী ডাক্তার হচ্ছে না কেনো? বিজ্ঞানি হয়ে বসুন্ধরাকে হতভম্ব করছে না কেনো? কেনো আমরা জাতি হিসেবে সামনে এগোতে চাচ্ছি না? আমাদের সামনে মহা বিপদ নয় কী? আমরা কী পরবর্তী প্রজন্মকে ধ্বংসের সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছি না?
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এসবিডিই