যার যার ছাগল সামলান
২২ জুন ২০২৪ ১৪:৫৫
গরু নিয়ে রচনা লিখেন নি, মুখস্থ করে নি এমন শিক্ষার্থী একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবেনা এদেশে। গরু সাহিত্যের কিয়দংশ দখল করে আছে। গরু নিরীহ। গৃহপালিত। উপকারী। এর দুধ আমাদের পুষ্টি জোগায়, বিশেষত বাচ্চাদের জন্য অতি আবশ্যকীয় তরল। বিশ্বব্যাপী গরুর মাংস জনপ্রিয় খাদ্য। গরু দিয়ে হালচাষ হয়। ধান মাড়াইয়ের কাজ হয়। সরিষার তেলের ঘানিতেও গরু আবশ্যক। এসব উপকারের জন্য গরুর প্রতি মনিবের দরদ অপরিসীম। তুলনায় ছাগল আকারে ছোট হলেও এর মাংস অতি স্বস্বাদু হয়ে থাকে। আর প্রজনন বৃদ্ধিতে এর জুড়ি কম। গরুর মত ছাগলও প্রবাদ প্রবচনে স্থান দখল করে আছে। মানুষজন হরহামেশাই বলে থাকেন যে, পাগলে কি না বলে আর ছাগলে কিনা খায়? আবার এও বলতে শোনা যায় যে, ছাগল দিয়ে হাল চাষ হয় না। গরু মাঝেমধ্যে হাম্বা হাম্বা করে তার উপস্থিতি জানান দিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ছাগল অনবরত ভ্যা ভ্যা করতেই থাকে। ছাগলের এই শোর চারিদিকের মানুষজনকে অতীষ্ঠ করে তুলে। পশু হিসেবে গরুর সাথে ছাগলের কোনভাবেই তুলনা চলে না। এ লেখার উদ্দেশ্যও তা না।
অতি সম্প্রতি একটি হৃষ্টপুষ্ট ছাগলের সাথে ততোধিক প্রকৃৃতির নাদুসনুদুস বালকের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। উপলক্ষ কোরবাণীর জন্য হালাল উপার্জনের দ্বারা নিঁখুত ও মনোমত পশু ক্রয়। এ নিয়ে এত হৈচৈ কেন হবে বোধে আসে না। আসার কারণ, প্রদর্শন উত্তেজনা। আজকাল আমাদেরকে প্রদর্শন দোষে পেয়ে বসেছে। কোন কিছু করে যেনতেনহেন প্রকারে ভাইরাল হওয়ার খায়েস আমাদের সমাজে এখন ঘটমান বাস্তব। আর কেউ না আসুক নিজেরাই নানা রংচং চড়িয়ে নিজেদের পেইজে বা ভøগে ভিডিও পোস্ট করে দেয়। এতে বেশুমার লাইক, কমেন্টস, ভিউ হয়। এগুলো করে নাকি ডলারও কামানো যায়। যাহোক, সেই বালকের ঈদ উপলক্ষে ক্রীত ছাগল সমেত ছবি মুহুর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। আর এতেই মিডিয়ার চোখ পড়ে। আমাদের জনজীবনে ছাগলের তেমন কোন প্রভাব পরিলক্ষিত না হলেও আলোচ্য ছাগল বেশ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। এক ছাগলের দাম পনের লক্ষ টাকা হতে পারে তা আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাচেতনার মাঝেও আসে না। আলোচনায় আসার আসল কারণ বালকের বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা। সেটা মিডিয়ার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। কিন্তু কাহিনীর এখানেই শেষ না, গ্র্যা- ওপেনিং মাত্র। আলোচিত বালকের পিতা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিবৃতি দিয়ে বালকের সাথে তার পিতৃত্বের কোন সম্পর্ক নেই বলে ঘোষণা দিয়ে বসেন। সাথে আরো যোগ করেন যে, তিনি কথিত সেই বালককে চিনেনও না। এতেই নেটিজেনরা নড়েচড়ে বসেছে। কেউ কেউ ডিএনএ টেস্ট করার দাবীও তুলেছে। এ নিয়ে ঈদ আনন্দ আরো কয়দিন প্রলম্বিত হবে সন্দেহ নাই। মন্দ কি? ‘ছাগল’ যেমন মিডিয়া কভারেজ পাচ্ছে তেমনি টক অব দ্য কান্ট্রি হিসেবেও আলোচিত হচ্ছে। ছাগলের কপাল বলে কথা।
আমরা একটা অসুস্থ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা সবাই উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়াদৌড়ি করছি। আমাদের একেকজনের বেদনা-যাতনা একেক রকম, অভিলাষ-উদ্দীষ্টও একেক রকম। মূল ট্র্যাকের বাইরে আমরা সবাই বাইপাস, আন্ডারপাস, ওভারপাস ব্যবহার করছি। এতে বহুবিধ সুবিধা। মূল পথে টাকা কামানো কষ্টকর ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। টাকাই এখন আমাদের আরাধ্য। আমরা সবাই টাকার পিছইু ছুটছি। তাই, বাইপাস, আন্ডারপাস, ওভারপাসের ব্যবহার বেড়েছে। আমাদের অনেক অনেক টাকার প্রয়োজন। দেশে রাখার মত ক্ষেত্র ও নিরাপত্তা না থাকায় বিদেশেই পাচার করছি অবাধে। দেখার কেউ নেই, বাধা দেওয়ার কেউ নেই। কেউ প্রকল্পের টাকা মেরে দিচ্ছে, কেউ ব্যাংক খালি করে ফেলছে, কেউ পাবলিকের টাকা নিজের মনে করে পগার পাড় হচ্ছে। কোন টেনশন নেই, কোন সাড়াশব্দ নেই। কপাল মন্দ হলে কয়েকদিন কথা চালাচালি হবে। এরপর আরেক স্ক্যা-াল এসে তার জায়গা করে নেবে। পাবলিক সিরিজ নাটক দেখতে মশগুল থাকবে। মিডিয়ার লোকজন এগুলোকে পাবলিকের কাছে তুলে ধরছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করছে। কেউ প্রতিবাদ করে আকাশ থেকে যেন পড়ছে। কেউ দেশ ছেড়ে নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে পারছে। কেউ দেশে বসেই বুক চিতিয়ে মিডিয়ার সাথে কাউন্টার করার চেষ্টা করছে। সাহস থাকা বীরের কাজ কিন্তু পৃষ্ঠদেশে মল নিয়ে আসর গরম করার বদলে দুর্গন্ধই ছড়াচ্ছে বেশি। মিডিয়া কোমর কেঁচে লেগেছে। পাঙ্গা নেওয়ার এই খেলায় শেষমেশ কী হয় দেখা যাক।
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, অর্থই অনর্থের মূল। ভাবসম্প্রসারণের এই কমন বিষয় রাত জেগে কণ্ঠস্থ, মুখস্থ, উদরস্থ করেন নি এমন শিক্ষার্থী পাওয়া দুষ্কর হবে। মীর মোশাররফ হোসেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিষাদ সিন্ধু’তে পাতকি অর্থের উল্লেখ করেছেন। মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় মুখস্থ করা ভিন্ন অন্য কোন টার্গেট থাকে না। এ থেকে প্রকৃৃত শিক্ষা আমরা অনেকেই নেই নি। তাই, অভাবের বিপরীতে, স্বাচ্ছন্দ্যের বন্ধু রূপে, বিপদের রক্ষাকবচ হিসেবে অর্থই এখন আমাদের কাছে একমাত্র সুজন হিসেবে দেখা দিয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভিত্তিই হচ্ছে ভোগবাদ। তাই কষ্টের মিনিমাইজেশন আর ভোগের ম্যাক্সিমাইজেশনের সাধারণ সূত্র ধরে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। এতে বিকল্প চিন্তার কোন অবকাশ নেই। ফলত: যার ঘটে বুদ্ধি আছে প্রচুর তার অধীনে বিত্ত ধরা দিচ্ছে। যার শিক্ষা যত বেশি, যার পদ-পদবী যত আকর্ষণীয় আর যার ক্ষমতার বলয় যত বিস্তৃত সে তত ধনকুবের। সেটাই স্বাভাবিক। বিত্ত অর্জনের এই নেশায় কোন ধরাবাধা নিয়ম নেই। প্রয়োজন শুধু প্রবল ইচ্ছে শক্তি, প্রচুর সাহস আর ক্ষমতা বলয়ের অংশী হওয়া।
পাকিস্তান আমলে বাইশ পরিবার আমাদের চক্ষুশূল ছিলো। তাদেরকে আমরা ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পেরেছি। এখন নব্য বাঙলাদেশি ধনিকুবেরের সংখ্যা কত তার পরিসংখ্যান আমাদের কারো কাছে নেই। এদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী যেমন আছে তেমনি আছে মিডিয়া, বিবৃতজীবি, পরজীবি, পাড়ার মাস্তান থেকে শুরু করে অজো পাড়া গাঁয়ের অশিক্ষিত জনও আছে। কার কাছে কত টাকা আছে তা ঠাহর করা আজকাল বেশ মুশকিল হয়ে পড়েছে। সামান্য যে পথের ছেলে তারও টিকটক করে ল্যাম্বারগিনি কেনার সামর্থ হয়েছে। সেগুলো তারা প্রদর্শন করেও বেড়াচ্ছে। সেলিব্রেটি নামে আজ যাদেরকে বিভিন্ন মিডিয়ায় চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতে দেখা যাচ্ছে তাদের হাতে কোন কাজ নেই, সিনেমা নেই, নাটক নেই, ভালো কোন একাধিক ব্র্যা- নেই। অথচ টাকা আছে। ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ আছে। তাদের টাকার উৎস কী? উত্তর নেই। অফিসের সামান্য যে পিওন সেও সোনার পাতে মোড়া কমোডে বসে মলত্যাগ করে। তার অর্থই বা আসে কোত্থেকে? উত্তর নেই। এভাবেই গোপনে গোপনে আংগুল ফুলে হঠাৎ কলাগাছ হয়ে যাওয়া কোটিপতিরা আছে হাজারে হাজার, লক্ষ লক্ষ। আমাদের কাছে তাদের কোন পরিসংখ্যান নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো নিষ্ক্রিয়। তাদেরও অনেকে হয়ত এক পালের গরু হয়ে মিলেমিশে স্বর্ণের ঘাস আহরণে ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ ধরা খাচ্ছে। তাদের মন্দ কপাল । কয়েকদিন বাদে সব কিছুই আবার আগের মত কোল্ড স্টোরেজের পণ্যবৎ হয়ে যাবে।
এর শেষ কোথায়, প্রতিকার কীভাবে কারো জানা নেই। মাথার উপরে কেউ নেই, সবাই সতীর্থ যেন, সহযোগী খেলোয়াড়সম। মাঠে খেলছে প্রচুর লোক, বাইরে সাইড লাইনে বসে নামার অপেক্ষায় আরো বহু। আর মাঠের বাইরে সাধুবেশে চোর অতিশয় অনেকেই দু’হাত ভরে কামিয়ে নিচ্ছে রাশি রাশি। দেখার কেউ নেই। ভাগেযোগে, ছেড়ে- ছুড়ে, দিয়ে-থুয়ে চলেছে সবাই। তাদের জন্য একটাই সতর্ক বাণী: যার যার ছাগল সামলান।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই