তিস্তায় পানি প্রবাহ কবে বাড়বে?
২৬ জুন ২০২৪ ১৫:২৭
ছোটবেলায় আমরা পড়েছি-পৃথিবীর তিন ভাগ পানি, আর এক ভাগ স্থল। পৃথিবীর উপরিতলের ৭১ শতাংশ পানিবেষ্টিত, বাকিটা স্থল। পৃথিবীতে এত পানির রহস্যটা কি! সিডনির মাকুয়েরি ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনেকদিনের গবেষণার বলেন যে প্রায় ৪৪০ কোটি বছর আগে অনেক গুলো উল্কাই পৃথিবীতে এতো পানির সঞ্চার ঘটিয়েছিল। পৃথিবীর সৃষ্টি কালে পৃথিবী অতিরিক্ত উত্তপ্ত ছিল আর আর সেই সময় পানি ভরা উল্কাপিণ্ড গুলো পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। তারপর জলীয় বাষ্প হয়ে বিশাল মেঘের সৃষ্টি করায় তা বৃষ্টি আকারে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে এত পানি যোগান দেয়। বিজ্ঞানীদের মতে, কিছু বিশেষ খনিজ পদার্থ ও জৈব পদার্থের মিশ্রণের কারণেই উল্কা গুলি থেকে এত পানি এসেছিল।
পৃথিবীতে মোট পানির পরিমাণ প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ঘন কিলোমিটার (প্রায় ৩৩২.৫ মিলিয়ন ঘন মাইল) অনুমান করা হয়। এই পানির সিংহভাগই সমুদ্রের নোনা। পৃথিবীতে ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ অনুমান করা হয় প্রায় ১০.৬ মিলিয়ন ঘন কিলোমিটার (প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ঘন মাইল)। এই মিঠা পানি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়, বিশ্বায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, পানি দূষণ ও অপচয়ের কারণে মিঠা পানির পরিমাণ কমছে।
প্রায় ১৫ বছর আগে গোল্ডম্যান স্যাক্স নামে একটি আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিল যে, পানিই হবে আগামী শতাব্দীর পেট্রোলিয়াম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনের দিনগুলোতে বিশ্বের প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ পানি সংকটে পড়বে, যার অর্ধেকই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার।২০১৬ সালে ভারতের কাবেরি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কর্নাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ হয় যে একই দেশের দুটি অঞ্চল একে অন্যের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেরও অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটি অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে রয়েছে ছোট-বড় ৪০৫টি নদী। যার মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশের নদীগুলোর ৪৮টি সীমান্ত নদী, ১৫৭টি বারোমাসি নদী, ২৪৮টি মৌসুমি নদী। হিমালয় থেকে উৎপন্ন হওয়া পানির ৯০ ভাগ এ দেশের ওপর দিয়ে সাগরে পতিত হয়। অথচ অধিকাংশ নদ-নদী শুকিয়ে প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর দেশে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব প্রকট হচ্ছে। তাই প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে পানি বণ্টন বাংলাদেশের মানুষের জীবন-মরণের বিষয়।
তাই ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন সমস্যর সধানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেমনটি করেছিলেন ১৯৯৬ সালে।দীর্ঘ ২১ বছরে যে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি, ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মাত্র ৯ মাসের মধ্যে সে সংকটের সমাধান করা হয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারতের সাথে অমীমাংসিত পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়। সে সময় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও আলোচনা হয়, যৌথ নদী কমিশনও গঠন করা হয়। কিন্তু কিছু বিষয় নিয়ে পারস্পরিক মতপার্থক্য থাকায় এ নিয়ে চুক্তি হয়নি।
গত ২১ ও ২২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে গুরুত্ব পায় পানি বণ্টন ইস্যু। নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সম্পর্কের সব বিষয়, বিশেষ করে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের বিষয়টি উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচনায় এসেছে।’ অভিন্ন নদ-নদী প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘৫৪টি নদী ভারত ও বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে। আমরা বন্যা ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা, পানীয় জল প্রকল্পে সহযোগিতা করে আসছি। বাংলাদেশে তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করতে একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।’
যৌথ ঘোষণাপত্রেও তিস্তার পানি বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ যে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তাতে ভারতও যুক্ত হবে। উল্লেখ্য, তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের চীনের কাছ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো নদী অববাহিকাকে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে পানি সংকট মোকাবিলা করা।
ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার বাংলাদেশের পানি সংকট সমাধানের বিষয়ে আন্তরিক। ৬৮ বছর ধরে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় সংকটের সমাধান আন্তরিকতার সাথে সমাধান করে মোদী সরকার। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি সহ নানা সংকটে বরাবর এগিয়ে এসেছে ভারত। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়াও রামপাল, রূপপুর ও জামালপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের বিনিয়োগ, ভারতীয় তেল পরিশোধনাগার থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আনা ব্যবস্থা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরেও নেপাল থেকে ভারতীয় গ্রিডলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনার সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এবার তিস্তার পানি সংকট সমাধানেও এগিয়ে এসেছে ভারত। তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্পে ভারত যুক্ত হলে ভারত থেকে পানি এনে তিস্তায় সংযুক্ত করে সংকটের সমাধান করা সহজতর হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে উত্তরবঙ্গের তোর্সা-দুধকুমার-সঙ্কোশ-ধরলার সহ আরও যে সব নদীতে উদ্বৃত্ত পানি আছে তা খাল খনন করে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ও ভারত দুই সরকারই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করতে চায়। কিন্তু দুই দেশের সরকারের আন্তরিকতা সত্ত্বেও আঞ্চলিক রাজনৈতিক কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ঝুলে আছে। তাই এবারের যৌথ ঘোষণাপত্রে অন্তর্বর্তীকালীন বিকল্প সমাধানের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যৌথ নদী কমিশন এ বিষয়ে প্রস্তাব করবে এবং তার পরেই বিকল্প সমাধানগুলো সুনির্দিষ্ট হবে। বাংলাদেশের পানি ও নদী বিশেষজ্ঞরা এরইমধ্যে ভারতের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ যে ভাবেই হোক তিস্তা অববাহিকায় পানি আসা বেশি জরুরি। ভারত থেকে খালের মাধ্যমেই আসুক কিংবা অন্য কোনো ভাবেই হোক না কেন, উত্তরবঙ্গের পানি সংকটের সমাধান হলে, তা বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন যেমন বাড়াবে, একই সাথে পরিবেশ-প্রকৃতি ও মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও উন্নত করবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই