Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কালো টাকা ও অর্থপাচার রোধে করণীয়

মো. বজলুর রশিদ
২৬ জুন ২০২৪ ১৯:০০

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে কালো টাকা ও অর্থপাচার একটি বড় বাধা। কালো টাকা বলতে মূলত সেই অর্থকে বোঝায় যা আইনি পন্থায় অর্জিত হয় না এবং যার ওপর কোন প্রকার কর দেওয়া হয় না। অর্থপাচার বলতে বোঝায় সেই প্রক্রিয়া যেখানে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থকে বৈধ বলে প্রদর্শিত করা হয়। এটি একটি জটিল এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া, যা অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে উৎপন্ন অর্থের প্রকৃত উৎস গোপন করে এবং সেই অর্থকে বৈধ আর্থিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করানোর চেষ্টা করে।

বিজ্ঞাপন

কালো টাকার উৎস প্রধানত তিনটি: কর ফাঁকি, দুর্নীতি এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ। কর ফাঁকি হলো সেই প্রক্রিয়া যেখানে ব্যক্তিরা বা প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের প্রকৃত আয়ের তথ্য গোপন করে কম কর প্রদান করে। দুর্নীতি বিশেষত সরকারি কর্মচারীদের দ্বারা করা হয় যেখানে তারা ঘুষ গ্রহণ করে এবং সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করে। অপরাধমূলক কার্যকলাপ যেমন মাদক পাচার, মানব পাচার এবং অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ও কালো টাকার বড় উৎস।

বিজ্ঞাপন

কালো টাকার ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হয়। সরকারের রাজস্ব হ্রাস পায়, যার ফলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অর্থায়নের সমস্যা হয়। কালো টাকার মাধ্যমে সম্পদ বিতরণে অসমতা সৃষ্টি হয় এবং এটি সামাজিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া, কালো টাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে তাদের ক্ষমতা বাড়ায়, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে।

অর্থপাচার একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া যেখানে বিভিন্ন ধাপে অবৈধ অর্থকে বৈধ বলে প্রদর্শিত করা হয়। প্রথম ধাপ হলো ‘প্লেসমেন্ট’, যেখানে অবৈধ অর্থকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করানো হয়। দ্বিতীয় ধাপ হলো ‘লেয়ারিং’, যেখানে বিভিন্ন লেনদেনের মাধ্যমে অর্থের উৎস গোপন করা হয়। তৃতীয় ধাপ হলো ‘ইন্টিগ্রেশন’, যেখানে অবৈধ অর্থকে বৈধ আয়ের সাথে মিশিয়ে সম্পদ হিসেবে প্রদর্শিত করা হয়।

অর্থপাচার দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস করে এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায়। বৈধ ব্যবসার সাথে অবৈধ অর্থের মিশ্রণ ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেয়, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া, অর্থপাচারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সন্ত্রাসবাদ এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপে ব্যবহৃত হতে পারে, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

কালো টাকা ও অর্থপাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর আইন এবং সেই আইনের কঠোর প্রয়োগ। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণেরও এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং সহযোগিতা করতে হবে।

প্রথমত, কর ফাঁকি রোধে সরকারের কর ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ এবং কার্যকর করতে হবে। কর ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন এনে কর প্রদানের প্রক্রিয়াকে সহজ এবং দুর্নীতিমুক্ত করা যেতে পারে। কর কর্তৃপক্ষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা জরুরি, যাতে তারা কর ফাঁকির বিভিন্ন পদ্ধতি সনাক্ত করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির বিধান রাখতে হবে। এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও স্বাধীন এবং শক্তিশালী করা প্রয়োজন, যাতে তারা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে পারে এবং দোষীদের শাস্তি দিতে পারে।

তৃতীয়ত, অর্থপাচার রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে সমন্বয় করে তথ্য আদান-প্রদান বাড়াতে হবে। বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
চতুর্থত, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কালো টাকা ও অর্থপাচারের কুফল সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

পঞ্চমত, ব্যাংকিং খাতকে আরও সতর্ক এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। সন্দেহজনক লেনদেনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে এবং সেই সংক্রান্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে, যা সন্দেহজনক লেনদেন সনাক্ত করতে সাহায্য করবে।

কালো টাকা ও অর্থপাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর আইন, স্বচ্ছ প্রশাসন এবং জনসচেতনতা। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণেরও এই ব্যাপারে ভূমিকা পালন করতে হবে।

কেবলমাত্র যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা একটি দুর্নীতিমুক্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারি। কালো টাকা ও অর্থপাচার রোধে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্বশীল ভূমিকা আমাদের দেশের উন্নয়নের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সারাবাংলা/এজেডএস

কালো টাকা ও অর্থপাচার রোধে করণীয় মো. বজলুর রশিদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর