Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিস্টেম ঠিক না হলে সে কী করবে

আবদুল হামিদ মাহবুব
২৬ জুন ২০২৪ ১৯:৪০

আমাদের শহরে সুজাত নামে একজন বাজার কর্মকর্তা ছিলেন। আমরা যেমন মাদক বিষয়ক কর্মকর্তাকে মাদকভাই, বন বিষয়ক কর্মকর্তাকে বনভাই, শিশু বিষয়ক কর্মকর্তাকে শিশুভাই; ঠিক তেমনি এই বাজার বিষয়ক কর্মকর্তা সুজাতকে বাজারভাই ডাকতাম। অবসরে উনাদের সাথে আমরা কয়েকজন সাংবাদিকের আড্ডা হতো। বিভিন্ন দপ্তরের ‘উপরি’ (ঘুষ) আয়ের বিষয় যখন আমাদের আলোচনায় আসতো, তখন আমাদের এই বাজারভাই প্রায়ই একটি কথা বলতেন ‘আমি সৎ নই, তবে রিজনেবল সৎ বলতে পারেন।’

বিজ্ঞাপন

তার মুখে এই রিজনেবল রিজনেবল কথাটি শুনতে শুনতে আমি একদিন তাকে প্রশ্ন করলাম; ‘ও বাজারভাই, আপনি রিজনেবল সৎ বলতে কি বুঝান? তার জবাবটা ছিলো, ‘আমি ঘুষ নিই, তবে কারো কাছে চেয়ে নিই না। কেউ স্বইচ্ছায় দিলে নিই। অন্যদের মতো ডিমান্ড করে ঘুষ না নেওয়াটা আমার কাছে রিজনেবল সততা!’ ব্যাটা ঘুষ খায়, তবে চেয়ে খায় না! তার অফিসে এমন সিস্টেম করে রেখেছে, সে না চাইলেও ঘুষ দিতে হয়। আর এটাকেই ‘রিজনেবল’ বলছে। তার কথা শুলে আমরা খুব হাসাহাসি করলাম।

বিজ্ঞাপন

মাদকভাই বললেন, আমাদেরটা উপর পর্যন্ত যায়। সিস্টেমেই আমার কাছে প্রতি সাপ্তায়, প্রতি মাসে খাম চলে আসে। বনভাই বললেন, গাছ চোররা গাছ কাটবে, কারো গাছ স্থানান্তরের জন্য পারমিট লাগবে, করাত কলের মালিকরা পরমিশন ছাড়া কল চালাচ্ছে, বনের ভিতর সরকারি উন্নয়ন কাজ আছে, সব কিছুর জন্য মাসোহারা আর পারসেনটেইজ ঠিক করা আছে। আমি না চাইলেও আমার অংশটা আমার কাছে আসবে। শিশু ভাই বললেন, আমরা কোনো সিস্টেমই চালু করতে পারিনি, আমার কাছে ভাই কিছু আসে-টাসে না। যদি আসতো তা হলে আমাকে ন্যায্য মূল্যের গাড়ি থেকে পণ্য কিনতে হতো না।
আমার পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ চারজনের মধ্যে একজন বাদে তিনজনের সিস্টেমে ‘উপরি’ আসে। এই থেকে ধারণা নেওয়া যায়, আমাদের দেশের প্রায় অফিসেই সিস্টেম করা আছে, কেউ না চাইলেও সিস্টেমে তার কাছে তার ‘উপরি’ অংশ চলে আসবে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আছে লোকাল রিকোয়ারমেন্ট ফান্ড (এলআরফান্ড)। এটাও সেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি সিস্টেম। যে কারো বন্দুক লাইসেন্স নবায়ন, ড্রাগ লাইসেন্স নবায়ন, জন্মনিবন্ধনের ভুল সংশোধন, এনজিওদের কোনো সনদ প্রয়োজন, বালু মহাল, বিল ইজারা, ভূমি লীজ, বাগান লীজ নবায়ন, ভূমি বন্দোবস্ত, বন্দোবস্ত নবায়ন, হুকুম দখলকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণ প্রদান, প্রদর্শনী, মেলা, ব্যবসায়ীদের কোনো লাইসেন্স কিংবা যে কোনো প্রয়োজনে জেলা প্রশাসক থেকে আপনি কোনো সনদ বা কোনো অনুমতির কাগজ সংগ্রহ করতে হলে এলআরফান্ডে বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতেই হবে। এই ফান্ড জেলা প্রশাসনের এনডিসি মাধ্যমে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিজে পরিচালনা করেন। কত জমা হয়, কত খরচ হয় কোনো হিসাব রাখতে হয় না। এই ফান্ডে টাকার কোনো অডিট নেই।

একবার একজন দুদক কমিশনার আমাদের জেলায় এসে দূর্নীতি বিষয় নিয়ে সুধি ও সাংবাদিকদের সাথে ডিসি’র সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভা করেছিলেন। আমিও ওই সভায় নগন্য এক সাংবাদিক হিসাবে উপস্থিত ছিলাম। আমার যখন বলার পালা আসলো, আমি তখন বলেছিলাম ‘আপনি এই যেখানে সভা করছেন, সেই অফিসের বৈধ(!) ঘুষের ক্ষেত্র হচ্ছে এলআরফান্ড। আপনি এই অফিসের এলআরফান্ডে চাঁদা গ্রহন বন্ধ করুন, আমি দৃঢ়তার সাথে বলছি, জেলা প্রশাসক অফিসের ঘুষ গ্রহণ বন্ধ হয়ে যাবে। এইভাবে সারাদেশের জেলা প্রশাসক অফিসের এলআরফান্ড গুলো বন্ধ করে দিলে ডিসি’রা অনেকটা সৎ হয়ে যাবেন।

আমার বক্তব্যের জবাবে সেই দুদক কমিশনার আমার প্রতি তাঁর উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন,‘আপনারা সাংবাদিকরা সব কিছু বেশি বুঝেন।’ পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ওই কমিশনার সার্কিট হাউসে থাকা-খাওয়া ও পরিবার নিয়ে জেলার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের যাবতীয় ব্যয় এই এলআরফান্ড থেকেই দেওয়া হয়েছে। পাঠক বলুন ‘যে শর্ষে ভূত থাকে, সেই শর্ষ দিয়ে কি ভূত তাড়ানো যায়?’

দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছি, সেই সুবাদে অনেক ডিসি’র সাথেই ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। একবার একজন ডিসি’র (যিনি দুইটি বিভাগে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে সচিব) কাছে এলআরফান্ডের টাকা খরচের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি খোলাখুলি ভাবে আমাকে বলেছিলেন, ‘এলআরফান্ডের আয়েও আমরা চলতে পারি না। সরকারি দিবসগুলোর ব্যয় ছাড়াও আমার থেকে উপরের পদে কর্মরত যারাই এই জেলায় আসেন, সার্কিট হাউসে উঠেন, (মন্ত্রী এমপি থেকে শুরু করে) তাদের সকলের সব খরচ এই ফান্ড থেকে বহন করতে হয়। যাবার সময় যে উপহার সামগ্রী দিই সেটাও এই ফান্ডের টাকায়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা কি সরকারি টিএ ডিএ কিছু পান না? তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘তারা কি কেবল একা আসেন? অনেকেরই পরিবার পরিজন সাথে থাকে। আর আমি কোনো উপজেলা সফরে গেলে সেখানেও তো সরকারি গাড়ি নিয়ে যাই। আমার ইউএনও’রা দুপুরে আপ্যায়ন করান, আসার সময় উপহার দেন, তার পরওতো আমি ডিএ’টা পাই।’

ডিসি কার্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এক নাজির (যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন) আমাকে জানিয়েছিলেন ডিসি’দের বাসার সকল খরচের অর্থ এই এলআরফান্ড থেকে দেওয়া হয়। এই সিস্টেম বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। সেই নাজির জানিয়েছিলেন তার চাকুরিজীবনে একজন ডিসি ব্যতিক্রম পেয়েছিলেন। ডিসি সাহেব যোগদানের প্রথমদিন তাঁর বাসায় এলআরফান্ডের টাকায় কেনা সওদাপাতি যাবার পর তিনি খুব রাগ করেছিলেন। তিনি সেই সওদাপাতি ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘দ্বিতীয়বার যেনো কেউ এমনটি করার চেষ্টা না করে।’

আমার জেনাজানা একটি পরিবারের বাবা মওলানা। উনার ছেলে-মেয়ে সাতজন। সকলেই মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস মওলানা। ওই পরিবারের এক ছেলে কামিল পাস করার পর একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তরে চাকুরি নিয়েছে। এই চাকুরিতে তার বাবা খুশি না। তিনি মনে করেছিলেন তার এই ছেলেও অন্য ছেলেদের মতো মাদ্রাসা লাইনে থাকবে। সে যখন শিক্ষা প্রকৌশলে চাকুরিতে যোগদান করলো; মওলানা বাবা বলে দিলেন, ‘চাকুরি করো,তবে হারামে যেনো হাত না পড়ে।’

ক’দিন আগে এক বিয়ের দাওয়াত দিতে ওই ছেলেটি আমার বাসায় এসেছিলো। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাবার কথা রাখছে কি না? সে আমাকে বললো, আমি অন্তর থেকে চাইলেও সিস্টেমের কারণে আমি বাবার কথা রাখতে পারছি না। সে জানালো, দৃঢ়তার সাথে ঘুষ প্রত্যাখান করলে তার অন্য সহকর্মীরা তাকে এমন ফাঁদে ফেলবে যে, তাকে চাকুরি হারাতে হবে। সে বললো, ‘আমি আমার বেতনের হালাল পয়সাতেই চলছি। ‘উপরি’ যা পাই তা গরীব অসহায়দের দিয়ে দেই। না, সেটা পূণ্যের আশায় নয়। আমি পরিশুদ্ধ থাকার জন্য।’

সে জানালো, ঠিকাদারদের সাথে যেসব অফিস কাজ করে, তাদের ঘুষ পাওয়ার সিস্টেমই করা আছে। যেমন: গণপূর্ত, সড়ক ও সেতু বিভাগ, এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন, বিদ্যুৎ বিভাগ। সেগুলোতে নীচ থেকে শুরু করে এক্কেবারে উপরের কর্মকর্তা পর্যন্ত কে কত টাকার কাজে কত ‘পার্সেন্ট’ করে পাবেন, সেটা ঠিক করা আছে। কেউ ব্যতিক্রম করতে চাইলে অফিসের অন্যরা তাকে ‘আজব চিজ’ হিসাবে গণ্য করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে এমন ফাঁদে ফেলে দেয় যে; সে যেনো এখান থেকে ছেড়ে যায়।

রাখঢাক না করে সে সত্যগুলো বলায় আমার বড় ভালো লাগলো। ঘুষ নেয়, কিন্তু নিজে সেটা ভোগ করছে না। গরীব অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দিচ্ছে। সিস্টেম ঠিক না হলে সে কী করবে? চাকুরি ঠিক রাখার জন্য এভাবেই যদি করে মন্দ কি? আমি অনুমান করি যে, ওইসব অফিসে কর্মরত যারা ভালো থাকতে চান, তারাও হয়ত ঘুষের টাকা তার মতোই গরীব অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে নিজেরা পরিশুদ্ধ থাকছেন।

এই লেখাটি যখন শেষ করবো তখন মনে পড়ে গেলো, ভারতের ‘দস্যুরাণী’ খ্যাত এক মহিলাদস্যু ফুলন দেবীর কথা। সে বড়লোকদের বাড়িতে ডাকাতি করে যে টাকা পয়সা ধন লুটে করে নিয়ে আসতো, সেটা গরীবদের মধ্যে বিলি করে দিতো। তার কাহিনী নিয়ে সিনেমাও হয়েছিলো। পরবর্তীতে ফুলন দেবী সাধারণ মানুষের কাছে এমন জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে, ভোটের মাধ্যমে ভারতের লোকসভার সদস্যও নির্বাচিত হন। অবশ্য শেষাবধি তাকে ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব

সারাবাংলা/এজেডএস

আবদুল হামিদ মাহবুব সিস্টেম ঠিক না হলে সে কী করবে

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর