Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারতের সঙ্গে রেল চুক্তি নিয়ে এত সমালোচনা কেন

শিতাংশু ভৌমিক অংকুর
২৭ জুন ২০২৪ ১৬:০৫

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর ২১ জুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত একটি ঘটনা। নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের পর এটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সফর।পাশাপাশি, আগামী জুলাই মাসে শেখ হাসিনা চীন সফরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, যেখানে চীন তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসকল প্রসঙ্গ মিলিয়ে এই সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে, শেখ হাসিনার ভারত সফর দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সুযোগের যথাযথ ব্যবহার করেন। কিন্তু একটি মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই সফরকে ঘিরে নানা বিভ্রান্তি ও গুজব ছাড়াচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়, যার মধ্যে ছিল ভারতীয় ভিসা সহজীকরণ, তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন এবং বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। সফরে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে যা দুই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করবে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্র অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতা: এই সমঝোতা স্মারকটি সমুদ্র অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে দুই দেশের সমুদ্র অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ডিজিটাল পার্টনারশিপের দুটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি: এই সমঝোতা স্মারকগুলো ডিজিটাল ইকোসিস্টেম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দুই দেশের মধ্যে পার্টনারশিপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সবুজ অংশীদারত্বের অভিন্ন ভিশন: এই সমঝোতা স্মারকটি পরিবেশ সুরক্ষা ও সবুজ প্রযুক্তির উন্নয়নে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি বহন করছে। রেল সংযোগের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতা স্মারক: দুই দেশের মধ্যে রেল সংযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই স্মারকটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সুবিধা বৃদ্ধি করবে।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রীর এই সফর ঘিরে সামাজিক যোগাগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনা শুধু রেল সংযোগের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতা স্মারক নিয়ে। ‘বাংলার বুক চিরে ট্রেন চললে ভারতই লাভবান হবে। বাংলাদেশের নতজানু সরকারের কারণে এ সুযোগ নিচ্ছে দেশটি। ভারতের একতরফা লাভ হলেও ক্ষতি হবে বাংলাদেশের’, ‘ভারতের কাছে বাংলাদেশকে বিক্রি করে দিচ্ছে সরকার। নেপাল-ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টাও মাটি হয়ে গেলো’ – এমন সব শিরোনামে ভিডিও আর হাস্যরস-কৌতুক বানিয়ে ফেসবুক-ইউটিউবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সরকার বিরোধী ঘরানার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বিষয়ে ট্রানজিট বিষয়ে নেতিবাচক পোস্ট দেখছি। তাই বিষয়টির বিশদ বিশ্লেষণ জরুরি। প্রথমেই আমাদের জানা উচিত ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, করিডোর কি?

ট্রানজিট_ প্রথম দেশ, দ্বিতীয় দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে যখন তৃতীয় দেশের জন্য পণ্য বহন করে নিয়ে যায়। তখন তা প্রথম দেশটির জন্য দ্বিতীয় দেশ থেকে পাওয়া ট্রানজিট সুবিধা বিবেচিত হয়৷

কোরিডোর_ একটি দেশের যানবাহন অন্য একটি দেশের উপর দিয়ে ,নিজের দেশের অন্য অংশে পৌঁছানোর সুযোগ পেলে যে দেশটির উপর দিয়ে গেল সেটা হলো তাদের জন্য করিডোর। যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাদের কোন যানবাহন বাংলাদেশের উপর দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে গেলে ‘বাংলাদেশ’ হলো তাদের জন্য করিডোর।

‘নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষণ ছাড়া রেল যোগাযোগ হবে। এখানে থাকতে পারে অস্ত্র-বোমা। ফলে আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হতে পারে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা; যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এমনকি আগেও ট্রানজিট দিয়ে কোনো শুল্ক পায়নি বাংলাদেশ। এবারও পাবে না। শুধুমাত্র ভারতকে খুশি করতেই এ সুবিধা দিচ্ছে সরকার।’ এসব কথাও ছড়াচ্ছেন কেউ কেউ। অথচ ট্রানজিট চালু হলে বাংলাদেশও যে বহু সুবিধা ভোগ করতে পারবে সে সম্পর্কে কোনো তথ্যভিত্তিক ডাটা জানেন না অধিকাংশ মানুষ। ফলে অপপ্রচারের একতরফা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনমনে।

বিভিন্ন তথ্যমতে, আধুনিক বিশ্বে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে সর্বপ্রকার যোগাযোগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। ট্রানজিট বা করিডোর এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটি সাধারণ বিষয় হলেও বাংলাদেশে সাধারণ্যে খুব বেশি ধারণা নেই। এজন্য রাজনৈতিক অপপ্রচারের কারণে শব্দ দুটিকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়, যা হাস্যকরও বটে।

সাধারণত তিন বা এর চেয়ে বেশি দেশের মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগকে ট্রানজিট বলা হয়। আন্তর্জাতিক আইনে এক্ষেত্রে কোনো শুল্কের বিধান নেই। তবে অবকাঠামো ব্যবহার করলে বিনিময়ে মাশুল ধার্য করা যায়। অন্যদিকে করিডোর হলো শুধুমাত্র দুটি দেশের মধ্যে যোগাযোগ; যার যাবতীয় মাশুল ধরার বিধান রয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ রেল করিডোর নিয়ে নয়া চুক্তি

চলতি মাসের ২২ জুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৩টি ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার এক নম্বর রয়েছে রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন ট্রেন সার্ভিস চালুকরণ, ভারতীয় রেল করিডোর নিয়ে নয়া চুক্তি। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৭৭ বছর পর রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে পুনরায় ট্রেন সার্ভিস চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। যেটি হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলাচলকারী চতুর্থ আন্তঃদেশীয় ট্রেন। এছাড়া এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতের কলকাতা থেকে ‘সেভেন সিস্টার্স’-খ্যাত সাত রাজ্যের ১২টি রুটে পণ্য ও যাত্রী চলাচলের সুবিধা। ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া ভারতীয় রেলওয়ের বক্তব্যে বলা হয়েছে, নতুন পরিকল্পনার আওতায় মোট এক হাজার ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের ১৪টি সেকশন থাকবে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে থাকবে ৮৬১ কিলোমিটার। আর নেপালে ২০২ কিলোমিটার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকবে ২১২ কিলোমিটার পথ। বাংলাদেশ সরকার দেশের ভেতরে ভারতকে রেলপথ স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নয়াদিল্লির পরিকল্পনা সহজ হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে মোট ৮৬১ কিলোমিটার, নেপালে ২০২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এবং উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জরিপ চালানো হবে। ভারতের সঙ্গে এই চুক্তির ফলে ভারতের মাটি ব্যবহার করে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেপালেও পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। ভারত ও নেপালের মধ্যে রেল সংযোগের জন্য অনুমোদিত রুট বিরাটনগরুনিউ মাল জং সেকশনে ১৯০ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণের প্রয়োজন হবে৷ আর গালগালিয়া-ভদ্রপুর-কাজলী বাজার সেকশনে সাড়ে ১২ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণের প্রয়োজন হবে। এই প্রকল্পগুলো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য যেমন বিকল্প পথ হবে, তেমনি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোকে সংযুক্ত করবে। যেমন, উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলাকে কোচবিহারের হলদিবাড়ির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য একটি রুট প্রস্তাব করা হয়েছে। আরেকটি রুট রাধিকাপুরকে গীতালদহের সঙ্গে সংযুক্ত করবে, যা যথাক্রমে উত্তর দিনাজপুর ও কোচবিহার জেলায় বিস্তৃত। ভারতের নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ের (এনএফআর) প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা সব্যসাচী দে বলেন, নতুন রুটগুলো চালু হয়ে গেলে প্রতিবেশী দেশ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের রেল যোগাযোগ উন্নত হবে। পাশাপাশি বাণিজ্য ও পর্যটন কার্যক্রমও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। ভারতীয় রেলওয়ের কর্মকর্তার মত, এসব রেলরুট ভারত ও প্রতিবেশী—দুই পক্ষের জন্য লাভজনক হবে। এটি উত্তর-পূর্বের সঙ্গে সংযোগ উন্নত করবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভালো রেল নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। দীর্ঘ মেয়াদে বাণিজ্য সম্পর্কসহ সামগ্রিক অর্থনীতির কর্মকাণ্ড বাড়বে।

ভারতের সঙ্গে রেল করিডোরে বাংলাদেশের লাভ কতটুকু

ভারত ও বাংলাদেশের রেল করিডোর নিয়ে চুক্তি হওয়ার পরেই সবচেয়ে চর্চিত বিষয় বাংলাদেশের লাভবান হবে কতটুকু! ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যে রেল সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে যোগাযোগের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে চায় তা আদতে একটি ‘ওপেন ডোর’ পলিসি। এ সম্পর্ক উন্নয়নের মূল কথা হলো, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের সুযোগ দেওয়া। কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে যাবে, এ নীতিতে আসলে উন্নয়ন স্থিতিশীল হয় না। আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি চমৎকার ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে। আমাদের কোস্ট লাইন বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এই সুযোগটি কিন্তু প্রতিবেশী ভারতের সেভেন সিস্টারস, নেপাল বা ভুটানের নেই। সে জায়গায় বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে। বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো বহুমাত্রিক। ভারত বাংলাদেশের যে রেলপথ দিয়ে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ করতে চায়, সে রেলপথের জন্য পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করতে হবে। অন্য একটি দেশের ট্রেন যখন দেশে ঢুকবে, তখন কিন্তু অপারেশনাল ডিজরাপশন তৈরি হবে। তারপর সিকিউরিটির জন্য খরচ আছে। আমার অবকাঠামো অবচয় কত হবে প্রতি বছর সেটি হিসাব করতে হবে। ভারত যে সুবিধা পাবে তা যেন বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানও সমভাবে পায়। আমি যখন আলোচনার টেবিলে বসব, মাশুল নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে, তখন জেনে নিতে হবে প্যাসেঞ্জার বা কার্গো রেল চলাচলে আমাদের হিস্যা কী হবে!

লেখক: সংবাদকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই

ভারতের সঙ্গে রেল চুক্তি নিয়ে এত সমালোচনা কেন মুক্তমত শিতাংশু ভৌমিক অংকুর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর