Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশে ভূমিকম্প আতঙ্ক: প্রস্তুতি নিতে করনীয়

ড. মিহির কুমার রায়
২৭ জুন ২০২৪ ১৭:৪১

মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে বাংলাদেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সবশেষ ২৯ মে ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ইউএসজিএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তি ছিলো মিয়ানমারের মাওলাইকে। এর মাত্রা ছিলো ৫ দশমিক ৪। ভূমিকম্পের কেন্দ্রে এর গভীরতা ছিলো ১০ কিলোমিটার। দেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূগর্ভস্থ ফাটল বা চ্যুতি থাকার কারণে ওই কম্পন হতে পারে। সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা, সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা ও ঢাকার টাঙ্গাইল জেলা।

বিজ্ঞাপন

সব এলাকাই ঢাকা থেকে কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সেখানে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে তা ঢাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন শিক্ষকের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯টি থেকে ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৫টি ভবন ধসে বা ভেঙে পড়বে, যা মোট ভবনের ৪০.২৮ থেকে ৬৪.৮৩ শতাংশ। এছাড়া যদি সিলেট লাইনমেন্টে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়– তাহলে ঢাকার ৪০ হাজার ৯৩৫টি থেকে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৪২টি ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যা মোট ভবন সংখ্যার ১.৯১ থেকে ১৪.৬৬ শতাংশ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের অধীনে পরিচালিত গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে যা তুলে ধরেন রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল লতিফ হেলালী। তিনি জানান, রাজউক এলাকার অধীনে ঢাকায় ২১ লাখ ৪৭ হাজার ২১৯টি ভবন রয়েছে, যার মধ্যে পাকা ভবন ৫ লাখ ১৩ হাজার ৫০৭টি। ৩ হাজার ২৫২টি (পাকা) ভবনের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। এগুলোর মধ্যে অতি-ঝুঁকিতে থাকা ৪২টি ভবন সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী সতর্ক করে বলেন, মধুপুর ফল্টে যদি সকালের দিকে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়–তাহলে ঢাকায় ২ লাখ ১০ হাজার থেকে ৩ লাখ ১০ হাজার মানুষ নিহত হবে। দুপুরে হলে ২ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৪ লাখ এবং রাতে হলে ৩ লাখ ২০ হাজার থেকে ৫ লাখ মানুষ নিহত হবে। এদিকে, দেশের ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে তীব্র কম্পন অনুভূত হতে পারে, যা এই শহরের দুর্বল ভবনগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ঢাকার সম্প্রসারিত বা নতুন নতুন আবাসিক এলাকার মাটি নরম ও দুর্বল। এ ধরনের মাটিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনে বহুতল ভবন হলে তা মাঝারি মাত্রার কম্পনেই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। লালমাটির এলাকায় যেসব এক থেকে তিনতলা ভবন নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। ভূমিকম্পে মানুষের মৃত্যুর ৯০ শতাংশই হয় ভবনধসে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ভূমিকম্প গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে ১৩টি ভূগর্ভস্থ চ্যুতি রয়েছে। তবে তার সব কটি ঢাকা থেকে বেশ দূরে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে মাঝারি থেকে তীব্র ভূমিকম্প হলে ঢাকায় অনেক ভবন ভেঙে পড়তে পারে।

বিজ্ঞাপন

গত বছর, ২০২৩ এ বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১০০টি ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে এবং এর বেশির ভাগই নতুন এলাকায়। এটি এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যাকে প্রতিরোধ করার কোনো উপায় মানুষের আয়ত্তে নেই। সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনুযায়ী, ভূমিকম্প হয় প্লেট টেকটোনিকের (Plate Tectonic) সংঘর্ষের ফলে। পাশাপাশি দুটি মহাদেশীয় প্লেটের সীমান্ত অঞ্চলে যে প্রবল পীড়নের (Stress/Oppression) সৃষ্টি হয়, সেই পীড়ন যখন বড়সড় চ্যুতির (Faul) সৃষ্টি করে এবং তার অন্তর্নিহিত শক্তি বের করে দেয়, তখন ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। ভূপৃষ্ঠে বা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি গভীরতায় বড় মাত্রার বিস্ফোরণ ঘটলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের উত্পত্তি হতে পারে। তাছাড়া আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও অগ্ন্যুত্পাতের সময় সাধারণত ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। প্রায় এক ডজন ছোট-বড় অংশ নিয়ে ভূত্বক গঠিত। এই অংশগুলোকে প্লে­ট টেকটনিক (Plate Tectonic) বলে। এই প্লে­টগুলো নিচের অশক্ত ম্যান্টলের ওপর ভাসতে থাকে এবং প্লে­টগুলো একে অপরের সঙ্গে ঘষা খেতে থাকে। কখনো একটি প্লেট অপরটির ওপরে উঠে যায় কিংবা নিচে চলে যায়, যাকে অধোগামী অঞ্চল (Subduction Zone) বলে। কোথাও আবার একে অপর থেকে দূরে সরে যায়, যাকে অপসারী অঞ্চল (Spreading Zone) বলে।কোনো স্থানে অতিরিক্ত খনিজ (গ্যাস, তেল ইত্যাদি) উত্তোলনের কারণে শিলার স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে ধ্বংসের সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্প দেখা দিতে পারে। ১৯৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় খনিজ উত্তোলনের কারণে নিউক্যাসল ভূমিকম্প এর উত্কৃষ্ট উদাহরণ। প্রাকৃতিকভাবেই কার্বন চক্রের প্রভাবে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় হয় না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষণাগারে ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের মে মাসের মধ্যে ৪ মাত্রার ওপরে মোট ৮৬টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। এই ছোটখাটো কম্পনগুলো ভারী ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নির্দেশ করে। বাংলাদেশ মূলত ভারত ও মিয়ানমারের ভূ-অভ্যন্তরের দুটি ভূ-চ্যুতির (Fault Lines) প্রভাবে আন্দোলিত হয়। উল্লেখ্য, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ মূলত ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মিয়ানমারের টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় ও ইউরেশীয় প্লেট দুটি দীর্ঘদিন যাবত্ হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে। অপেক্ষা করছে বড় ধরনের নড়াচড়ার বা বড় ধরনের ভূকম্পনের। বাংলাদেশে আটটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা (Fault Zone) সচল অবস্থায় রয়েছে। বৃহত্তর সিলেটের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাউকী চ্যুতি অংশ ও শাহজীবাজার চ্যুতি (আংশিক ডাউকি চ্যুতি) উল্লেখযোগ্য।

ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইতিমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভূমিকম্পসহ সব দুর্যোগের সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের করণীয় নির্ধারণ করে ‘দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি, ২০১৯ (Standing Orders on Disaster, 2019)’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর অধীন দুর্যোগকালীন কার কী করণীয় তা নিরূপণ করা হয়েছে। উক্ত নীতিমালার অধীন প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল (NDMC) গঠন করা হয়েছে। উক্ত স্থায়ী আদেশাবলির অধীন মাঠ পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড পর্যন্ত অংশীজনের করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সে মোতাবেক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অধিকন্তু, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সমন্বয়ে জরুরি প্রতিক্রিয়া সংস্থাগুলোর জন্য জাতীয় কন্টিনজেন্সি প্ল্যান প্রস্তুত করা হয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (BNBC) অনুমোদন লাভ করেছে। ইতিমধ্যে ভূমিকম্প-পরবর্তী অনুসন্ধান ও উদ্ধারন্ত) সরঞ্জাম ক্রয়পূর্বক সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে হস্থান্তর করা হয়েছে।

ভূমিকম্পের ক্ষতি নিরসনে করনীয় কী এই মর্মে কিছু সুপারিস উপস্থাপিত হলো:

এক: বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন ভূমিকম্পের উৎসস্থল চিহ্নিত করা গেলে সেসব এলাকার ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনশীল করে নির্মাণ করার নির্দেশ দেয়া সহ সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলোর লোকবল ও পর্যাপ্ত উদ্ধার যন্ত্রপাতি প্রস্তুত রাখার আগাম ব্যবস্থা করা যাবে।

দুই: বড় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির নিরসনে বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে চলতে হব যেমন উচ্চতা ও লোডের হিসাব অনুযায়ী শক্ত ভিত দেয়া, রিইনফোর্সড কংক্রিট ব্যবহার, এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ী নিরাপদ দূরত্বে বাড়ি নির্মাণ, গ্যাস ও বিদুৎ লাইন নিরাপদভাবে স্থাপন, নরম মাটি কিংবা গর্ততে ভবন নির্মাণ না করা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংস্কার কিংবা ভেঙে ফেলা ইত্যাদি।

তিন: ভূমিকম্পের কোনো আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যায় না যা অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বেলায় সম্বব হয়। তাই জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সীমিত সম্পদ ও ক্ষমতার আওতার মধ্যেই এ দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি সম্ভব।

চার: ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পরিকল্পিত নগরায়ণ জরুরি। সত্যি বলতে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে ভূমিকম্প হলে মানবিক মহাবিপর্যয় ঘটবে, যা সহজেই অনুমেয়। ২০১৫ সালে নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর দেশে ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগে ভূমিকম্প মহড়া হলেও সেটি আর অব্যাহত নেই। এমনকি ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে যে ওয়েবসাইট নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেটিও হয়নি। এমন উদাসীনতার পরেও দেশটাকে সঠিক বাবে এগিয়ে নিতে হবে। এজন্য প্রশাসনের ভুমিক্রা জরুরি। প্রস্তাবিত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) যথাযথ অনুমোদন নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ হতে হবে।

পাঁচ: ভূমিকম্পে ক্ষতি নিরসনে মানুষকে সচেতন করতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে স্কুলভিত্তিক নানা কর্মশালার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো যায়। প্রতিটি কমিউনিটিতে প্রচার চালাতে যেতে পারে।

সর্বশেষে বলা যায়: যেহেতু ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার কোনো প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, তাই সচেতনতাই আমাদের একমাত্র সমাধান। ভূমিকম্প ও তত্সংশ্লিষ্ট ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ তার সক্ষমতা প্রমাণ করবে সেটাই আশা।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ

সারাবাংলা/এজেডএস

ড. মিহির কুমার রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প আতঙ্ক: প্রস্তুতি নিতে করনীয়

বিজ্ঞাপন

নতুন ইসির শপথ রোববার দুপুরে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর