Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষক এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা

অলোক আচার্য
২৮ জুন ২০২৪ ১৭:৫৯

‘শিশু বান্ধব প্রাথমিক শিক্ষা, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দীক্ষা’ এই স্লোগান নিয়ে এবারের প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০২৪ শুরু হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ধারণাটি নতুন কিন্তু স্বপ্নটি নতুন নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সাথেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। তার শুরু হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। আর শিশুরাই এ জাতির কান্ডারি। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক ধাপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। এটা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করেন। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশসাধন, আচরণিক পরিবর্তন,সামাজিক মূল্যবোধের প্রাথমিক স্তর শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। শিশুদের এই ইতিবাচক পরিবর্তনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তারা হলেন এই স্তরে নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষিকা। অন্য যেকোনো স্তরের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এই স্তরের প্রকৃতির কারণেই চ্যালেঞ্জ থাকে। এখানে যাদের সাথে নিয়ে কাজ করতে হয় তারা শিশু। সামাজিকীকরণের শুরুতে থাকে। তারা শিক্ষা স্তরের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রমের পর্যায়ে থাকে। এই শিক্ষাই পরবর্তী সময়ে তার ভেতর প্রবাহিত হয়। প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষক মান উন্নয়নে উপকরণ, ডিজিটালাইজেশন এবং প্রশিক্ষণসহ নানামুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে আধুনিকায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে আগের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটেছে। তারপরও প্রাথমিক শিক্ষা কাঙ্খিত অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। সময়ের সাথে সাথে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য করার উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। মানুষের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ধারণা বদলেছে এবং আগ্রহ বেড়েছে। ইতিমধ্যেই নতুন শিক্ষক যোগদান করেছে এবং আবারো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। ফলে শিক্ষক সংকটের যে বিষয়টি ছিল সেটি অনেকটাই কমে যাচ্ছে। তাছাড়া এখন প্রাথমিক শিক্ষায় নারী-পুরুষ উভয়ই উচ্চ শিক্ষিত এবং নামী-দামী সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শেষে এখানে আসছে। যদিও প্রশ্ন থাকে যে তাদের কতজনকে ধরে রাখা যাচ্ছে? আর যদি চূড়ান্ত মেধাবীদের ধরে না রাখা যায় তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা অগ্রগতির যে বিষয় তা অর্জনে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। এখানে প্রশ্ন হলো, খুব মেধাবীদের আগ্রহ এখনও প্রাথমিক শিক্ষায় কম কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে জানতে হবে প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি। আজও তারা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীতেই আটকে আছে।

বিজ্ঞাপন

এমনকি প্রধান শিক্ষক পদে নন ক্যাডার থেকে নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা অনেকেই থাকছেন না এমন সংবাদই গণমাধ্যমে পাওয়া গেছে। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। একই যোগ্যতায় তার সাথে কেউ ওপরের গ্রেডে চাকরি করছে, তাহলে সে পিছিয়ে থাকবে কেন? অর্থাৎ মাপকাঠি হলো গ্রেড বা বেতন কাঠামো। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে রয়েছে শিক্ষকদের জীবন। এই মানুষগুলোর হাতেই শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন নির্ভর করে। শিক্ষা উপকরণ, উপাদান বা পদ্ধতি সবকিছুর সফলতা নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। আজ শিক্ষা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। একটি নতুন কারিকুলাম প্রথম বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর আরও শ্রেণি অন্তর্ভূক্ত হবে। এই যে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন এটা করবেন শিক্ষকরা। সুতরাং তাদের সুবিধা অসুবিধার বিষয় বা দাবির বিষয় বিবেচনা করতে হবে। তাদের জীবনযাত্রার দিকে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে স্বল্প বেতনে একটি সংসার ব্যয় নির্বাহ করা যে কি কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ জানে না। যদিও সহকারি শিক্ষকদের বেতন গ্রেডের উন্নয়ন হয়েছে। আগে প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ বিহীন যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ তম গ্রেডে বেতন পেতো। এখন তা ১৩ তম গ্রেডে উন্নীত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। কিন্তু দেখতে হবে এখানে প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতার পুরোপুরি মূল্যায়ন হবে কি না বা মেধাবীদের এখানে টানতে হলে কি করা প্রয়োজন অথবা কেন তারা কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে যায়। অর্থ সবকিছুর মাপকাঠি না হলেও অনেকটা তো বটেই! সবচেয়ে বড় ফ্যাক্ট। প্রাথমিকের শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীই রয়ে গেছে। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয়। এমনকি প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদাও বেশি। অন্যান্য স্তরের সাথে এত ব্যবধান থাকার কথা না। একই শিক্ষাগত যোগ্যতা, রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে মেধা প্রমাণ করেই এখানে যোগদান করা, তারপরেও এই ব্যবধান দুঃখজনক। কেউ বলতে পারেন শিক্ষক অন্য পেশা থেকে ভিন্ন। ফলে অন্য পেশার সাথে মেলানো উচিত হবে না।

বিজ্ঞাপন

তবে বিনীতভাবে বলতে পারি, এই পেশা থেকেই তার সংসার অতিবাহিত হয়, শিক্ষার বিশ্লেষণ হয় এবং তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়। আর যার যা পাওনা তাকে যদি তা দেওয়া না যায় তাহলে তার কাছ থেকে কি কাঙ্খিত ফল আশা করা যায়? একই যোগ্যতায় যদি অন্য চাকরিতে দশম গ্রেডে বেতন পায় তাহলে প্রাথমিক শিক্ষকরা পেতে পারে না কেন? তাদের দুর্বলতা কোথায়। প্রশ্ন হলো যোগ্যতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়নের। বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় এই ভিন্নতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এমনকি মাধ্যমিকে একজন সিনিয়র শিক্ষক এবং প্রাথমিকের একজন সিনিয়র শিক্ষকের ভেতর এবং একই যোগ্যতায় অন্য কোনো যোগ্যতার মধ্যে এই পার্থক্য বেশ চোখে লাগে। কোনো নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স পাস করা একজন মেধাবী ছাত্রছাত্রী কেন স্বেচ্ছায় প্রাথমিকে চাকরি করবে যদি তাকে সেখানে যোগ্য সম্মান দেওয়া না হয়। তাকে কেন তৃতীয় শ্রেণির চাকরিতে যোগ দিতে হবে? মুখে যতই বলি প্রাথমিকেই মেধাবীদের আনতে হবে। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব হবে তা নিয়ে আলোচনা হলেও ফলপ্রসু হয়নি আজো। এই ক্ষেত্রে যারা সর্বোচ্চ যোগ্যতাধারী তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা জরুরি। এখন প্রাথমিকে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ডিগ্রী পাস করা হয়েছে। তবে মাষ্টার্স শেষ করে আসছেন বহু শিক্ষক-শিক্ষিকা। ফলে এরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং মেধাবী। একসময় প্রাথমিকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ থাকলেও এখন সে সুযোগ নেই। যোগ্যতার মূল্যায়ন প্রতিটি চাকরিজীবিই আশা করে। মানসম্মত শিক্ষাই আমদের লক্ষ্য। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্যতার মাপকাঠি সকল ক্ষেত্রে এক করতে হবে। প্রাথমিকে শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। একজন সহকারি শিক্ষক হিসেবে যখন কোন যোগদান করেন তখন তাদের ভেতর পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক বা সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বা তার থেকেও বড় পদে চাকুরির আশা করতে পারে। কারণ অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে এখানে তত গতিতে নেই।

সহকারি শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ। একজন শিক্ষক সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর যেন নির্দিষ্ট সময় পর প্রধান শিক্ষক এবং কমপক্ষে সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পর্যন্ত যেতে পারে সে পথ সুগম করতে হবে। এতে যা হবে তা হলো চাকরির প্রতি দায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং একটি লক্ষ্যে অগ্রসর হবে। প্রয়োজনে মেধা ভিত্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা চালু হতে পারে। বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে যারা মেধাবী তারা পদোন্নতির সুযোগ পাবে। এর ফলে মেধাবীরা তাদের মেধার দ্বারা দ্রæত কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে এবং চাকরি নিয়ে কোনো অসোন্তষ থাকবে না। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সকল শিক্ষাস্তরের ভিত্তি। সরকার এই স্তরকে শক্তিশালী করতে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি গুণগত মান উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। সরকার আন্তরিক আর সেই সাথে তাদের আন্তরিক হতে হবে যারা এই শিক্ষা দানের সাথে জড়িত এবং নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। সেই দায় শিক্ষকদের উপরেও বরতায়। প্রাথমিক শিক্ষকদের অনেকেই নিজের সন্তানকে নামী দামী কিন্ডারগার্টেনে পড়ান। এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন ভাবুন যে, আপনার সন্তানকে আপনি যদি কিন্ডারগার্টেনে পড়ান প্রাথমিকের পরিবর্তে তাহলে অন্য অভিভাবকের কাছ থেকে আপনি আপনার স্কুলে সন্তান ভর্তি আশা করতে পারেন? যদি সেই অভিভাবক প্রশ্ন করেন আপনার সন্তান কোথায় পড়ে, আপনি কি জবাব দিবেন? সুতরাং প্রথমে নিজের কাজের ওপর নিজের বিশ্বাস আনতে হবে। যদি না পারেন তাহলে অন্যরা আপনাকে কেন ভরসা করবে? নিজের সন্তানকে যদি নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানে দিতে আস্থা না থাকে তাহলে অন্য অভিবাবকদের দোষ দিয়ে লাভ কি? এটা একটা কারণ মাত্র কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের আস্থা অর্জন করতে হলে প্রথমে নিজেকেই করে দেখাতে হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে এটা করতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে গত কয়েক দশকে শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষকদের জীবন মান, শিক্ষার্থী উন্নয়ন বহুগুণে বদলে গেছে। সময়ের সাথে সাথে সেই পরিবর্তন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু সবকিছুর সাথেই শিক্ষকদের চাকরি এবং চাকরির সাথে জড়িত থাকে। সেখানে উন্নয়ন শিক্ষকের মানসিক প্রশান্তির কারণ হয়। প্রাথমিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর এ কথা সবাই স্বীকার করেন। সেক্ষেত্রে এই ক্ষেত্রে যে অসঙ্গতিগুলো রয়েছে তা দূর করতে হবে। শিক্ষকদের চাকরির সন্তুষ্টি অর্জন ও তাদের কষ্টের জায়গাগুলোতে পর্যায়ক্রমে পূর্ণ করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

অলোক আচার্য প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষক এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা

বিজ্ঞাপন

ফের দাপট দেখালেন সাকিব
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০৪

আরো

সম্পর্কিত খবর